নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে মতভিন্নতার স্পষ্টতা বাংলাদেশে আগেও ছিল উল্লেখ করে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লক্ষ্য রাখতে হবে, এ মতভিন্নতায় যেন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব না হয়।
‘এখানে যেন সুস্থ্ ও সাংবিধানিক চর্চা হয়,’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।
দুই বিভাগের মধ্যে মতভিন্নতায় উদ্বেগের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সব ক্ষমতা একই জায়গায় কেন্দ্রীভূত হলে সেই সরকার গণতান্ত্রিক হয় না।
শনিবার সকালে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের জন্য নির্মিত বহুতল আবাসিক ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, আশা করি বিচার বিভাগকে আপনি আপন করে দেখবেন। একটি গোষ্ঠী সরকার ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে ঝামেলার সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন: রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ একে অপরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করবে; কেউ কাউকে অতিক্রম করে বা শক্তি দেখিয়ে নয়। ক্ষমতা কারোরই কম নয়। এখন কে কাকে সম্মান করবে, কে কাকে করবে না, কে কার সিদ্ধান্ত নাকচ করবে, কে কার সিদ্ধান্ত মানবে- এই দ্বন্দ্বে যদি আমরা যাই, তবে একটি রাষ্ট্র সুষ্ঠুভাবে চলতে পারবে না। রাষ্ট্রকে সুষ্ঠুভাবে চলতে এই তিন অঙ্গকেই যথাযথভাবে তাদের কর্মপরিকল্পনা চালাতে হবে।
দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে সংসদে পাশ করা আইন দু’জন (বিচারপতি) যদি বাদ করে দেন তাহলে সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে মতভিন্নতা শুধু আমাদের দেশে নয়; ভারত ও আমেরিকাতেও হয়েছে।
‘ভারতে আইন পাস করে নাগরিকের মৌলিক অধিকার বাতিল করা হলে আদালত হস্তক্ষেপ করেছে। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট কাজই করতে পারেননি। কাজ করতে চেয়েছেন কিন্তু ওখানকার প্রধান বিচারপতি করতে দেন নাই। সু্প্রিম কোর্ট অব আমেরিকা বলেছে বিচারপতিরা যা বলবেন সেটাই আইন।’
বাংলাদেশে একটা সময় গণতন্ত্রের নামে গণতন্ত্র হয়নি, হয়েছে দলীয় স্বৈরাচার এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন: একেকটা দল জোট করে ২০১ আসনে আবার কখনো ২৬০টায় জয়ী হয়ে দলীয় স্বৈরাচার কায়েম করেছে।
সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ এখানে তিনটা বিভাগের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন: আমাদের নির্বাহী বিভাগ সরকার সব নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। একটা দল যখন সরকার পরিচলনা করবে তখন তাদের মূলত উচিত হবে সকল মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা এবং সরকারের ভেতরে যতগুলো বিভাগ রয়েছে সবার স্বার্থ রক্ষা করা।
‘কিন্তু সরকার পুলিশ, আমলা ও র্যাবের স্বার্থ রক্ষা করছে। এর বাইরে ডাক্তার, কৃষিবিদ, প্রকৌশলী কারো স্বার্থ রক্ষা করা হচ্ছে না। ক্ষমতায় গিয়ে কারো উপর ভর করে ক্ষমতা চর্চা করবেন,আর কারো স্বার্থ রক্ষা হবে না– এটা হতে পারে না।’
সাম্প্রতিক সময়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা, বিচার বিভাগের যে পেশাগত আধিপত্য রয়েছে সেটা রক্ষা করার জন্য প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বেশ ভালো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন উল্লেখ করে এর প্রশংসা করেন হাফিজুর রহমান।
নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে মতভিন্নতা সময় সময় উদ্বেগের উল্লেখ করে তিনি বলেন: বিচারপতির ভালো পদক্ষেপগুলোকে সরকার মনে করেছে তার একচ্ছত্র ক্ষমতা সেটার চ্যালেঞ্জ হিসেবে। এটা হওয়া উচিত না। সব ক্ষমতা একই জায়গায় কেন্দ্রীভুত হলে সেই সরকার গণতান্ত্রিক হয় না।
‘আমরা একটা ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্র চাই, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই যেখানে সকল মানুষের, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।’
তিনি বলেন: যেখানে আমাদের একটা লিখিত সংবিধান রয়েছে সেখানে বিবেকের ভূমিকা পালন করে বিচার বিভাগ। বিচার বিভাগের নানা সমস্যা রয়েছে। তারপরও সেটা চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের জন্য দরকার।
‘সর্বোপরি আইনের শাসনের বিকাশের জন্য, সাংবিধানিকতা বিকাশের জন্য, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যদি নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে মতভিন্নতা হয়ে থাকে তাহলে সমস্যার কিছু নেই।’