রাজনীতিতে লোভ আর ক্ষোভ বুঝি একসাথে হাত ধরাধরি করে চলে। লোভে পড়ে অনেকেই যেমন নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দেন, তেমনি ক্ষোভে পড়েও। এই লোভ আর ক্ষোভের কাণ্ড-কারখানাগুলো খুব করে দেখা যায় নির্বাচন এলে। কেউ লোভের আগুনে রাতারাতি আদর্শ বিক্রি করে দল বদলিয়ে ফেলেন। আর কেউ ক্ষোভের কারণেও দলত্যাগ করে ঠিক বিপরীতমুখী আদর্শের দিকে ধাবিত হয়। লোভ আর ক্ষোভ আছে বলেই যেনো রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। লোভ আর ক্ষোভের কাণ্ড-কারখানা শুরু হয়েছে এবারের জাতীয় নির্বাচন ঘিরেও।
নিজ দল থেকে মনোনয়ন না পাওয়ার সংকেত পেয়ে কেউ কেউ ঠিক বিপরীত আদর্শের দলে যোগ দিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ সুযোগ বুঝে মনোনয়ন কনফার্ম করছেন। এতে করে সাধারণ জনগণ বিস্মিত না হয়ে পারছেন না। রাজনীতিতে লোভ-ক্ষোভ এতটাই বাসা বেধেছে যে কেউ কেউ দুই দল থেকেও মনোননয়পত্র কিনেছেন। যেমন-এক এগারোর সময় ভীষণ আলোচিত ছিলেন লে. জে (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। ফেনী-৩ আসন থেকে তিনি নির্বাচন করার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপত্র কিনলেও দ্রুতই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। মাত্র পাঁচদিনের মাথায় ফের জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়নপত্র কেনেন। এ যেন লোভের রাজনীতির সিনেমাটিক মহড়া।
এবারের নির্বাচন ঘিরে লোভ এবং ক্ষোভের খেলা ভালোই জমে উঠেছে। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে জোট গঠিত হয়েছে সেখানেও আড়ালে আবডালে লুকিয়ে আছে লোভ আর ক্ষোভ। আর তাই সব কল্পনা আর অনুমান হার মানিয়ে গেছে। যে যত কথাই বুলক না কেন কদিন আগেও নিশ্চয় কারো কল্পনাতে ছিল না যে. ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ সন্তান খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, বঙ্গবন্ধুর স্নেহাভাজন মোস্তফা মহসীন মন্টুর মতো নেতারা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবেন। একইভাবে জাসদ নেতা আ স ম রব দল পরিবর্তন না করে সরাসরি ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবেন। কিন্তু এসব এখন দৃশ্যমান।
প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর নামে জপ তুলে বেড়ালেও লোভ আর ক্ষোভ মেটাতেই বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম এখন মহা তৎপর। নৌকা বা গামছা নয়, জিয়ার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবেন। এটি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় মনে হলেও এটিই সত্য হতে চলেছে। অথচ জিয়ার আমলে কাদের সিদ্দিকী দেশেই ফিরতে পারেননি। ডাকসুর সাবেক সভাপতি, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সুলতান মুহাম্মদ মুনসুরের পেছনে যারা মিছিল করেছেন, যারা তার জন্যে রাজপথে জীবন দিতে প্রস্তত ছিলেন তারা কোনো হিসাবই মেলাতে পারছেন না যে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর জিয়ার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারেন।
সাবেক জাসদ-বাসদ-আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নাতো ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনের কথা বলে মহা বিগলিত। মনে হচ্ছে রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম একটি আশা তার এখন পূরণ হওয়ার পথে।
এরশাদ জমানায় লোভের নিকৃষ্ট ইতিহাস গড়েছিলেন জাসদের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা আ স ম আব্দুর রব। সেসময় সারাদেশের ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার এরশাদের অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে রাজপথে লড়াই সংগ্রাম করলেও এরশাদের দুধে-ভাতে ছিলেন আ স ম আব্দুর রব। এরশাদের পতনের পর আ স ম আব্দুর রব ঘর থেকে বের হতে পারতেন না। তবে ৯৬ সালে তার ভাগ্যদুয়ার খুলে যায়। নানা সমীকরণে শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভায় তার ঠাঁই হয়। সেই আ স ম রব নতুন লোভের আশায় এবার ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়াই করবেন। অথচ এই প্রতীকের জন্মদাতা জিয়াউর রহমান তারই দলের অন্যতম নেতা এবং সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের নায়ক কর্নেল (অব.) তাহেরের ফাঁসির দায়ে আদালত কর্তৃক হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত।
লোভ দমিয়ে রাখতে পারেনি আসম রবকে। আবার লোভ আর ক্ষোভের কারণেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে এসে হাজির হয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। বিএনপি থেকে বের হয়ে তিনি বেশ আগে বিকল্প ধারা নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। লোভ আর ক্ষোভ মেটাতে সেই দলে কদিন আগে নাম লিখিয়েছেন বিএনপির সাবেক নেতা শমসের মোবিন চৌধুরী, জাতীয় পার্টির নেতা গোলাম সারওয়ার মিলন। ক্ষোভ থেকে তারা যে লোভ মেটাতে এসেছেন তা বলাই বাহুল্য।
এদিকে ক্ষোভ নয়, নিতান্তই রাজনৈতিক লোভ থেকে আওয়ামী দরবারে ঘুরাঘুরি করছেন সাবেক বিএনপি নেতা নাজমুল হুদা। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর প্রেসক্লাবে বসে কটাক্ষ করে যিনি বলেছিলেন একটা গ্রেনেডতো শেখ হাসিনার শরীরে ফুটলো না। সেই নাজমুল হুদা আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়নও কিনেছেন। আরও মজাটা হলো তার মেয়ে আবার বিএনপি থেকে মনোনয়ন কিনেছেন।
তবে লোভ আর ক্ষোভের রাজনীতিতে যেনো খানিকটা নতুন চমক নিয়েই এসেছেন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া। গণফোরামে যোগ দিয়ে তিনিও ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করবেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। রেজা কিবরিয়া ক্ষোভ থেকেই যে লোভের পথে পা বাড়িয়েছেন এতে সন্দেহ নেই। গণফোরামে যোগ দেওয়ার সময় তিনি পিতা হত্যার বিচার পাননি বলে ক্ষোভ ঝেড়েছেন। কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশ করলেও পিতার খুনের দায়ে যারা অভিযুক্ত তাদের সাথে হাত মিলিয়ে নির্বাচনে দাঁড়ানোর কতোটা শোভন হয়েছে তা ইতিহাস বলে দেবে।
অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়ার বাবা প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়া ৯৬ সালে শেখ হাসিনার কেবিনেটের সফল অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালে হবিগঞ্জ-১ আসন (নবীগঞ্জ-বাহুবল) থেকে তিনি ৮৩১১০ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার কাছে পরাজিত হয়েছিলেন বিএনপির আবু লেইস মবিন চৌধুরী। কিন্তু ২০০৫ সালে ঘাতকরা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
লোভ ও ক্ষোভের রাজনীতির একটি ঘটনা ২০০১ সালে সবাইকে চমকে দিয়েছিল। সেসময় নিজ দলের এক সংসদের লোভ আর ক্ষোভের আগুন দেখে চমকে গিয়েছিলেন খোদ শেখ হাসিনা। নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে দুই দুই বার জয়ী নড়াইলেন ধীরেন্দ্রনাথ সাহা শেষে দল ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দিয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই প্রার্থী হয়েছিলেন। ৯১ সালে ধীরেন্দ্রনাথ সাহা নৌকা প্রতীক নিয়ে ৪৭ হাজার ১৫৮ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর ৯৬ সালে ৫১ হাজার ১৬৭ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন।
কিন্তু ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ থেকে তার দলীয় মনোনয়ন দূরহ হয়ে ওঠে। ক্ষোভ থেকে এক পর্যায়ে তিনি দল ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেন। এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই তিনি ধানের শীষ নিয়ে প্রার্থী হন। নির্বাচনে শেখ হাসিনা ৭৮ হাজার ২১৬ ভোট নির্বাচিত হন, ধীরেন্দ্রনাথ সাহা পান ৬১ হাজার ৪১৩ ভোট।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত ডা. আলাউদ্দিনের কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে। ৯১ সালে রাজশাহী ৫ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে ৪৬ হাজার ১১৬ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হন। ৯৬ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দূরহ হয়ে উঠলে তিনি সবাইকে অবাক করে আকস্মিকভাবেই যোগ দেন বিএনপিতে। এবং যথারীতি মনোনয়ন লাভ করে ৬৫ হাজার ৫৯৪ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। পরে অবশ্য এই বর্ষীয়ান নেতা আবার আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। রাজনীতিতে এরকম আরও অনেক উদাহরণ আছে। তবে এবারও লোভ আর ক্ষোভের কারণে বিপরীত আদর্শের সাথে যারা হাত মেলালেন তাদের বেশিরভাগই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য নেতারা। লোভ আর ক্ষোভ রাজনীতিতে নতুন কী পরিবর্তন নিয়ে আসে সেটাই দেখার বিষয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)