শত বছর ছুঁই-ছুঁই করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স। তার চেয়ে বয়সে মাত্র তিন বছরের ছোট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু’র বয়সটাও কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু বয়সকে ছাপিয়ে গত প্রায় তিন দশকে দেশের রাজনীতি এবং শিক্ষাঙ্গনে বরাবরই আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে ডাকসু। বিশেষ করে তার নির্বাচন নিয়ে। যদিও সেই আলোচনা মাঝে মাঝে যেমন চাঙ্গা হয়ে উঠে, ঠিক তেমনিই হঠাৎ করেই ঝিমিয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে সর্বশেষ নির্বাচনের পর এভাবেই চলছে সেই সমাপ্তিহীন আলোচনা।
বেশ কিছুদিন ঝিম মেরে থাকা ডাকসু আলোচনা হঠাৎ করেই বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। অবশ্য তা উচ্চ আদালতের আইনী তৎপরতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকারের স্বেচ্ছা উদ্যোগে নয়। বলতে গেলে অনেকটা বাধ্য হয়েই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে আলোচনা শুরু করেছে।
আমরা জানি, চলতি বছরের শুরুর দিকে ৬ মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টের সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন করেনি। অার এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আইনী নোটিশ পাঠান ওই রায়ের রিটকারীদের আইনজীবী।
বিষয়টা এখানেই থেমে থাকেনি। নোটিশেরও কোনো জবাব দেয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কৃর্তপক্ষ। তাই তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করা হয়। মামলার ঠিক পরেরদিনই ছাত্র সংগঠনগুলোকে আলোচনায় বাসার আমন্ত্রণ জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রোববার নির্বাচন নিয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে সেই আলোচনা শুরু হয়েছে।
এমন উদ্যোগকে আমরা ইতিবাচকভাবেই দেখছি। তবে গত জানুয়ারিতেই তা শুরু হলে নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পড়তে হতো না। আদালতের নির্দেশ না মানায় অভিযুক্ত হতে হতো না।
শেষবার ডাকসু নির্বাচনের পর অনেকেই বন্ধ থাকা ডাকসুকে সচল করার উদ্যোগ নিতে কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করেছেন, কেউ কেউ দাবি জানিয়েছেন। ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে একজন শিক্ষার্থীকে বেশ কয়েকদিন ধরে অনশন করতেও দেখেছি আমরা। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।
এমনকি গত বছর মার্চে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে চ্যান্সেলর ও রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও বলেন, ডাকসু নির্বাচন হতেই হবে, তা না হলে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব শূন্য হয়ে যাবে। কিন্তু তারপরও ডাকসু নির্বাচন হয়নি। অথচ রাষ্ট্রপতি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান। সেই প্রধানের কথাও গুরুত্বহীন করে তুলেছে প্রশাসন।
মূল বিষয় হলো ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্ব সবাই উপলদ্ধি করেন। কিন্তু প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য কারণে কেউই তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেন না। দেশের ইতিহাস বলছে, এই ডাকসুই বহু বড় বড় নেতার জন্ম দিয়েছে, যারা ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, দেশের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। দেশ পরিচালনায় অংশ নিয়েছেন বা নিচ্ছেন।
তাহলে নির্বাচন হচ্ছে না কেন? আমরা জানি, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী ডাকসু নির্বাচনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হলেই নির্বাচন হতে বাধ্য। এক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কারো মুখাপেক্ষী হবে কেন? কিন্তু বাস্তব হলেও সত্য, দলীয় আনুগত্যের কারণে বছরের পর বছর এই নির্বাচনকে ঝুলিয়ে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। তাদের ভয়, যদি বিরোধীরা ডাকসুর নিয়ন্ত্রণ নেয়?
আমরা মনে করি, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি নয়। কে জিতবে? আর কে হারবে? এসব ভেবে সময় নষ্ট না করে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা নিন।