গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সরকার পরিবর্তনের জন্য নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। প্রত্যেকটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সরকার পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে নির্বাচনকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে সেই কাঙ্খিত নির্বাচন নামমাত্র হলে চলবে না, নির্বাচনকে হতে হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। অর্থাৎ যেখানে জনগণের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে, জনগণ তাদের প্রার্থীদের নিজেদের পছন্দানুযায়ী কোনো রকমের ভয় ভীতি ছাড়াই ভোট প্রদান করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্বশীল ও নিরপেক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। পাশাপাশি নির্বাচনের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার, গুরুত্বপূর্ণ এজেন্সি, নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ, দেশি বিদেশি পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক ও সর্বসাধারণকে নিরপক্ষেতা ও সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে।
এ বছরের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবতা সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছেন। নির্বাচন সংঘটনের স্বার্থকতা ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সম্ভাবতা নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত দলগুলো নির্বাচন সম্পর্কে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে, কেউবা পক্ষে আবার কেউবা বিপক্ষে। সুশীল সমাজ এবং বুদ্ধিজীবীরা সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন। কোনো কোনো দল ঘোষণা দিয়েছে, এ নির্বাচন কমিশনারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। আবার অনেকেই বেফাঁস মন্তব্য করে নির্বাচন কমিশনকে বেকায়দায় ফেলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সব কিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি নির্বাচন সংক্রান্তে সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হয় তা হলো: নির্বাচনের তফসিলের ঘোষণার পর থেকেই একটি বিশেষ মহল নির্বাচনোত্তর সহিংসতা ও ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে ওৎ পেতে থাকে। বিশেষভাবে বললে বলতে হয়; চার বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা কতিপয় গ্রুপ এবং তাদের নেতৃবৃন্দ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশি বিদেশি দোসরদের সহযোগিতায় কতিপয় সব প্রার্থীর হয়ে কাজ করে জনমনে ভয় এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে থাকে।
নির্বাচনোত্তর ভয়ের সংস্কৃতি বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া, প্রার্থীর হয়ে নির্বাচন পরিচালনা করা, জনসংযোগ করা, প্রার্থীর পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা, ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে নিজের ভোট দেওয়া ও অন্যকে ভোট প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা ইত্যাদি কাজে সম্পৃক্তায়ন হলে বিভিন্ন গ্রুপ এবং পক্ষ থেকে হুমকি এবং হামলার স্বীকার হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাছাড়া নির্বাচন সংক্রান্ত আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। জাতীয় দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ২৭২৩ টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে থাকে। প্রত্যেক বছর ৩৯.৭১% হারে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পায় এবং ২০১৩ সালে মোট ঘটনার ৪৩% সহিংসতা সম্পন্ন হয় এবং ঐ বছরটিই নির্বাচনের বছর ছিল। ২০১৩ সালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫০৭ জন হত্যাকাণ্ডের স্বীকার হয় এবং হতাহতের সংখ্যা অসংখ্য। এসব ঘটনা এবং সহিংসতার চিত্র নির্বাচনোত্তর ভয়ের সংস্কৃতি তৈরিতে মুখ্য প্রভাবক হিসেবে কাজ করে থাকে।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্রিমিনালাইজেশন অব পলিটিক্স প্রত্যয়টি স্থানীয় নির্বাচন থেকে শুরু করে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত দাপটের সাথে সম্পৃক্তায়ন ঘটেছে। রাজনীতিতে ক্রিমিনালদের অনুপ্রবেশ সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। খবরের কাগজের কল্যাণে রাজনীতিবিদদের অনুকম্পায় সন্ত্রাসীদের লালনের বিষয়টি আমাদের গোচরীভূত। প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদেরা যখন নির্বাচন পরিচালনা কিংবা প্রচার প্রচারণায় সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে থাকে তখন সামগ্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনগণের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়। ভয়ের কারণে অনেক সচেতন নাগরিকেরা তাদের ভোটাধিকার প্রদানে বিরত থাকেন। শুধু কি ভোটার, পাশাপাশি নির্বাচনে প্রার্থীরাও ভয়ের মধ্যে থাকেন। কারণ, বিভিন্ন মাধ্যম এবং প্রান্ত থেকে জনপ্রিয় প্রার্থীদের নিকট হুমকি এবং হামলা এমনকি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হওয়ার বিষয়ে হুমকি চলে আসে। অনেক প্রার্থীই এবং তাদের সমর্থকরা হুমকি এবং হামলার ভয়ে প্রচার প্রচারণায় নিরব ভূমিকা পালন করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকে না। বিষয়টি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ক্ষেত্রে তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হুমকিস্বরূপ।
তাছাড়া, নির্বাচনের ভোট গ্রহণের তারিখকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসে অত্যাচার ও নির্যাতনের নির্মমতা এবং ভয়াবহতা। স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনগুলোতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা সকলের গোচরীভূত। অর্থাৎ প্রত্যেকটি নির্বাচনেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের কালো থাবা নেমে এসেছে। তাই জাতীয় নির্বাচন এলেই একটি বিশেষ শ্রেণী হামলার স্বীকার হবার ভয়েই থাকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই নির্যাতনের ভয়ে দেশ ছেড়েছে বিভিন্ন সময়ে। পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের হুমকিকে উপেক্ষা করে যারা ভোট দেওয়া কিংবা সন্ত্রাসীদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট না দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে পরবর্তীতে তাদের উপর নানা রকম অত্যাচারের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে দেশের দলিত সম্প্রদায়ের উপর নির্বাচনোত্তর নির্যাতনের মাত্রা সাম্প্রতিক সময়ে সকলের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। সমাজের নিম্নশ্রেণির এবং নিম্ন সম্প্রদায়ের মানুষের উপর অঘোষিত নির্যাতনের ছায়া নেমে আসে। পুলিশের অভিযোগ আমলে না নেওয়ার বিষয়ও ভয়ের সংস্কৃতির চলমান অবস্থা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
সন্ত্রাসীরা দেশের কোন বিশেষ জায়গায় কিংবা এলাকায় হতাহতের ঘটনা ঘটিয়ে ফেললে সে ঘটনা সারাদেশে নির্বাচনের সঠিকতাকে বাধাগ্রস্থ করে এবং একই সময়ে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টিতে ইতিবাচক হিসেবে কাজ করে। কারণ, হুমকি এবং হামলার সম্ভাবতা নিয়ে সাধারণ ভোটাররা ভোট প্রদানে বিরত থাকেন। ফলে জনমতের সঠিক প্রতিফলন হওয়ার সম্ভাবনা বাধাগ্রস্থ হয়। কাজেই, ভয়ের সংস্কৃতির দৌড়যাত্রায় সারাদেশে প্রভাব বিস্তারের জন্য দু একটি ঘটনাই যথেষ্ট।
পরিশেষে অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান পরিস্থিতি সামনে রেখে নির্বাচনোত্তর ভয়ের সংস্কৃতি দূর করার জন্য এখন থেকেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে স্বার্থক ও অর্থবহ করার জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই নির্বাচনোত্তর ভয়ের সংস্কৃতি যে কোন মূল্যে দূর করতে হবে। তার ভিত্তিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রতিনিধিত্বশীলদের অবশ্য দায়িত্ব। দেশের কোথায় কোথায় নির্বাচনোত্তর সহিংসতার হবার সম্ভাবনা রয়েছে সে বিষয়ে চক আউট করে বিশেষ করে পূর্ব ঘটনা যাচাই বাছাই করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সময়োপযোগী পদক্ষেপ ভোটার, প্রার্থী এবং সংশ্লিষ্টদের সাহসী এবং আশান্বিত করে তুলবে নিঃসন্দেহে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা সমাজের দলিত শ্রেণির বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রার্থীর যোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা দেখে মনোনয়ন নিশ্চিত করতে হবে। সন্ত্রাসীদের অনুগত এবং সংশ্লিষ্ট প্রার্থীকে মনোনয়ন বঞ্চিত করতে হবে। পত্র পত্রিকার মাধ্যমে মনোনয়ন বাণিজ্য সংক্রান্ত খবরের শিরোনামের অনুপস্থিতি ভোটারদের ভোট প্রদানে আশ্বস্ত করবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)