দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণ পুনঃতফসিলের মহোৎসব লেগেছে। ব্যাংক ও গ্রাহক উভয়ই এতে জড়িত। ফলে গত ৩ মাসের ব্যবধানে ঋণ পুনঃতফসিল বেড়েছে ৪ হাজার ৪শ ২০ কোটি টাকা। শতাংশের হারে যা ৩০৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। দেশের প্রায় সব জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ঋণ পুনঃতফসিলের হুজুগ দেখা যায়।
আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, নজিরবিহীনভাবে গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ই নিজেদের স্বার্থে ঋণ পুনঃতফসিল করছে। ব্যাংকগুলো ব্যালান্সশিটে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে গিয়ে ঢালাওভাবে কিছু গ্রাহককে ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা দিচ্ছে। এতে ব্যাংকের মুনাফা কৃত্রিমভাবে বেশি দেখানো হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে চাপের মুখেও প্রভাবশালী গ্রাহকদের এই সুবিধা দিতে বাধ্য হচ্ছে ব্যাংক।
গ্রাহকেরাও ঋণ পুনঃতফসিলের সুবিধা নিতে ভিড় করছে ব্যাংকগুলোর দ্বারে দ্বারে। কেউ নতুন করে ঋণ পেতে এবং কেউ জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য নিজেকে খেলাপি মুক্ত দেখাতে এই কৌশল নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
এসব কারণে বছরের পর বছর একই গ্রাহকের কোনো কোনো ঋণ ১০ থেকে ১২ বারও পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এরপরও এসব গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংকের টাকা আদায় করা যাচ্ছে না। ঋণ পুনঃতফসিল ও খেলাপি ঋণের বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন না হলে আগামীতে ভয়াবহ রূপ নেবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেনঃ রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক বিবেচনায় এবং ব্যাংকারদের যোগসাজশে যেসব ঋণ দেয়া হয়, সেগুলোর অধিকাংশই খেলাপি হয়ে যায়।
ঠিক একই কৌশলে গ্রাহকরা তা আবার পুনঃতফসিল করে নেয়। সাধারণত দুটো কারণে ঋণ পুনঃতফসিল করে গ্রাহকরা।
যেমন, ঋণ খেলাপি থাকলে নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না। এছাড়া পুনরায় ঋণ নেয়ার জন্য আগের নেয়া ঋণ পুনঃতফসিল করে বলে মনে করেন সাবেক এই গভর্নর।
তিনি বলেনঃ এভাবে ঋণ পুনঃতফসিল করা ব্যাংকিং খাতের জন্য খারাপ লক্ষণ। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মুনসুর চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেনঃ ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছে গ্রাহকেরা। তাই সুবিধামত খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করে নিচ্ছে।
“তবে এটা দুঃখজনক, ছোট গ্রাহকদের ঋণ আদায় হচ্ছে। কিন্তু বড় গ্রাহকেরা একই ঋণকে ১০/১২ বারও পুনঃতফসিল করেছে।”
তিনি বলেনঃ সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাই অনেকেই প্রার্থী হওয়ার জন্য ঋণের সামান্য অংশ পরিশোধ করে তা পুনঃতফসিল করছে। নির্বাচনের আগে পর্যন্ত এটা আরো বাড়বে। এটা ব্যাংকিং খাতে বাজে চর্চা।
এর থেকে উত্তরণের উপায় কি জানতে চাইলে এই অর্থনীতিবিদ বলেনঃ সরকারি ব্যাংকগুলোতে সাধারণত পুনঃতফসিল বেশি হয়। কিন্তু সরকার যদি ঋণ খেলাপিদের পুনঃতফসিলের সুযোগ দেয় তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কিছু করার থাকে না। তাই সরকারকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এছাড়া প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ দিয়ে ড. আহসান এইচ মুনসুর বলেনঃ ভারতে বড় ঋণ খেলাপিদের জমি ও সম্পদ ক্রোক করেছে ব্যাংক। তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। অচিরেই বাংলাদেশেও এসব নিয়ম করতে হবে।
অগ্রণী ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইউসুফ আলী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেনঃ সাধারণত বছরের শেষ দিকে ঋণ পুনঃতফসিল বাড়ে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এটা অব্যাহত থাকবে। কারণ পুনঃতফসিল করতে গ্রাহককে কিছু ডাউন পেমেন্ট দিতে হয়। এই অর্থ সরবরাহ করা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আসতে সময় লেগে যায়। এ কারণে বছরের শেষদিকে এর চাপ বেশি থাকে।
তবে ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংক গ্রাহকদের লেনদেনে পরিস্থিতি দেখে সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানান তিনি
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুনে ঋণ পুন:তফসিলের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ৪৫৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৮শ ৭৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা। সেই হিসেবে ৩ মাসের ব্যবধানে বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার ৪২০ কোটি টাকা বা ৩০৩ শতাংশ।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই সময় সবচেয়ে বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলোতে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে এসব ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল ৩৪৭ কোটি ৪৪ লাখ। ৩ মাসের ব্যবধানে জুনে তা ১ হাজার ৬শ ৭৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ২৬ কোটি ২৪ লাখ। অর্থাৎ ৫৮৩ দশমিক ১৯ শতাংশ বেড়েছে।
এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে মার্চ মাসে ঋণ পুনঃতফসিলের পরিমাণ ছিল ৭৫৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। আলোচ্য সময়ে ২ হাজার ৯১৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা বেড়ে তা হয়েছে ৩ হাজার ৬৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ৪৮৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এই সময় বিদেশি ব্যাংকগুলো মাত্র ৩ লাখ টাকা পুন:তফসিল করা হয়েছে।
তবে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে না বেড়ে উল্টো কমেছে। মার্চে যেখানে এসব ব্যাংকের ঋণ পুনঃতফসিল ছিল ৩৫২ কোটি ৬১ লাখ টাকা সেখানে জুনে ১৭৬ কোটি ১০ লাখ কমে তা হয়েছে ১৭৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ বছরে মোট ৮৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৪১ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। রাইট অফ বা অবলোপন করা ঋণের পরিমাণ যোগ হলে খেলাপি ঋণ দাঁড়াবে এক লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা।