একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, দেশের রাজনীতিতে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে বড় দুই দলের মতপার্থক্য ততই বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। কেননা নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতেই বিএনপি অনড়। পক্ষান্তরে এই দাবিকে অসাংবিধানিক বলছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
আগামী অক্টোবরেই ছোট আকারে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ইঙ্গিত দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও এরকম একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর এমপিদের নিয়ে। তখনকার বিরোধী দল বিএনপির কাছে নাম চাওয়া হলেও তারা ওই মন্ত্রীসভায় কারো নাম দেয়নি। বরং নির্বাচন বর্জন করে।
আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ছোট আকারের যে মন্ত্রীসভা গঠনের কথা বলা হচ্ছে, আইনত সেখানে বিএনপির কোনো প্রতিনিধি রাখার সুযোগ নেই। কেননা তারা সংসদের বাইরে। তাছাড়া এই সরকারের প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা ছাড়া অন্য কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে রাখার যে দাবি বিএনপি করছে,সেটিও যে শেষ পর্যন্ত তাদের অধরাই থাকবে, সে বিষয়ে আপাতত সন্দেহ কম।
ফলে প্রশ্ন উঠছে, বিএনপি কি আগামী নির্বাচনও বর্জন করবে নাকি শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যাবে? সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অবশ্য সরকার পতনে ৬৯ ও ৯০-এর মতো গণআন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে কখনও স্বৈরাচার সরকারকে অপসারণ করা সম্ভব হয়নি। এদেশেও এটি সম্ভব হবে না। ১৯৬৯ এবং ১৯৯০ সালের মতো আন্দোলনই বাংলাদেশে হবে। বিএনপির এই নেতা অবশ্য ১৯৯৬ অথবা ২০০৬ সালের আন্দোলনের কথা বলেননি। কারণ ওই দুটি আন্দোলন হয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে। আর ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী যে গণআন্দোলন হয়, তখন তিনি এরশাদের উপরাষ্ট্রপতি, মানে সেকেন্ড ইন কমান্ড।
কথা হচ্ছে, ৬৯, ৯০ আর ২০১৮ সালের বাস্তবতা এক কি না এবং ঊনসত্তর ও নব্বইয়ের গণআন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, ধরন ও চরিত্রও অভিন্ন ছিল কি না? ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এর দুই দশক পরে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের একটি জায়গায় মিল রয়েছে যে, এ দুটি আন্দোলনই ক্ষমতাসীনদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল এবং এ দুটি আন্দোলনেই ক্ষমতাসীনদের বাইরের সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এরপরে যেসব সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে, যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এবং ২০০৬ সালে এই দলের নেতৃত্বে লগি-বৈঠার আন্দোলনে সে ধরনের ঐক্য ছিল না। অর্থাৎ ঊনসত্তর ও নব্বইয়ের আন্দোলনে সমস্ত পেশাজীবী ও সাধারণ মানুষের যে দৃঢ় অঙ্গীকার ও ঐক্য ছিল, পরবর্তী আন্দোলনগুলো সেরকম কংক্রিট ছিল না।
ইতিহাস বলছে,১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি শেখ মুজিবুর রহমানকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে এই কর্মসূচিতে সমর্থন দেয়। তাতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে আইয়ুব সরকার। তারা বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবিসম্বলিত এই কর্মসূচিকে নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে লাগে এবং তারই ধারাবাহিকতায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান। যার অনিবার্য পরিণতি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের পেছনে ছিল বাঙালির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য, আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের ধাপ্পা এবং সবশেষ স্বায়ত্তশাসনের দাবি।
এর প্রায় দুই দশক পরে এ দেশের মানুষ আরেকটি বড় গণআন্দোলনের সাক্ষী হয় অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী এরশাদের পতন ইস্যুতে। তার ক্ষমতা গ্রহণের বছরখানেকের মধ্যেই মূলত দেশে আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে, যা সাত বছরে গিয়ে পূর্ণতা পায়। ১৯৯০ সালের ২০ নভেম্বর বিরোধী দলগুলো সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালন করে। ২৫ থেকে ২৭ নভেম্বর চরম আকার ধারণ করে ছাত্রঐক্য আন্দোলন। ৩০ নভেম্বর ৮,৭ ও ৫ দল যৌথ আন্দোলন ঘোষণা করে। ডিসেম্বরের শুরুতে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ে। সংবাদপত্র প্রকাশনা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সাংবাদিক ইউনিয়ন। আদালত বর্জন করেন আইনজীবীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ সব শিক্ষক পদত্যাগ করেন। বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও পদত্যাগ করেন। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত রেডিও-টেলিভিশনের অনুষ্ঠান বর্জনের ঘোষণা দেয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের আড়াইশো কর্মকর্তা সরকারের দমন-নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। অর্থাৎ এরশাদের বিরুদ্ধে তার দল বাদে পুরো দেশ ঐক্যবদ্ধ হয়।
প্রশ্ন হলো, এই সময়ে এসে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে এরকম ঐক্য গড়ে ওঠার কোনো বাস্তবতা বা সম্ভাবনা আছে কি না? এ মুহূর্তে শিক্ষক-চিকিৎসক-সরকারি কর্মকর্তারা কি পদত্যাগ করবেন? সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মীরা কি ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজপথে নামবেন? এসবের কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ এরশাদের সময়ে দেশের যে রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল, ২০১৮ সালের বাস্তবতায় তার চেয়ে অনেক ভিন্ন। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি ছাড়া আর কোনো ইস্যুতে এখন সরকারের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার সম্ভাবনা কম। আবার এই ইস্যুতে বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য যে রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়োজন, তাও নেই এবং সংসদের বাইরে থাকা সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপির পতাকাতলে অন্য সব দল এসে একতাবদ্ধ হবে––তারও কোনো লক্ষণ নেই। ফলে যে গণআন্দোলনের কথা মওদুদ আহমদ বলছেন, সেটি একধরনের রাজনৈতিক ফাঁকাবুলি ছাড়া কিছু নয়।
কী ধরনের আন্দোলন বিএনপি গড়ে তুলতে পারবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতি যে আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে,তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের দাবির সঙ্গে এবার খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিও যুক্ত হবে। কেননা নির্বাচনের আগে যে বেগম জিয়া মুক্তি পাচ্ছেন না, তা মোটামুটি পরিষ্কার। ফলে আগামী কয়েকটা মাস দেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধানে অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের সুস্পষ্ট রূপরেখা না থাকলেও এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত রয়েছে। ৫৬ (৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে,সংসদ ভেঙে যাওয়া এবং সংসদ-সদস্যদের অব্যবহিত পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তীকালে কাউকে মন্ত্রী নিয়োগ করার প্রয়োজন দেখা দিলে সংসদ ভেঙে যাওয়ার অব্যবহিত আগে যারা সংসদ-সদস্য ছিলেন, তারা বহাল থাকবেন। ফলে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচন সামনে রেখে যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় অথবা সংসদ বহাল রেখেই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়, তারপরও সংসদ সদস্যরা তাদের পদে বহাল থাকবেন। আর ওই অন্তর্বর্তী মন্ত্রীসভার সদস্য নিতে হবে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকেই। একটা বিতর্ক এরকম আছে যে, সংসদীয় ব্যবস্থায় সংসদ ভেঙে দিলে সরকার থাকবে কি না? এই প্রশ্নের জবাব আমাদের সংবিধানের এই ৫৬ অনুচ্ছেদ দিচ্ছে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যদি সংসদ ভেঙেও দেয়া হয় তারপরও সংসদ সদস্যরা স্বপদে বহাল থাকবেন। শুধু ওই সময়ে সংসদের অধিবেশন বসবে না। কিন্তু সংসদ সদস্য হিসেবে তারা যেসব সুযোগ-সুবিধা এবং প্রিভিলেজ (বিশেষ সুবিধা) ভোগ করেন, সংসদে ভেঙে দেয়ার পরও সেগুলো অব্যাহত থাকবে কি না, তা পরিষ্কার নয়।
তবে সংসদ বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন নিয়ে যাতে জটিলতার সৃষ্টি না হয় সেজন্য সংবিধানের ৭২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি অধিবেশন শেষ হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে পরবর্তী অধিবেশন শুরুর বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্বাচনের পূর্ববর্তী (যে সময়কালকে বলা হচ্ছে নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকারের সময়)
৯০ দিনের মধ্যে সংসদের অধিবেশন বসবে না। অর্থাৎ আদতে সংসদ থাকলেও এর কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। কিন্তু সরকার তার রুটিনকাজ চালাতে পারবে।
প্রশ্ন হলো, বিএনপি কেন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে অনড়? কারণ তারা মনে করে ক্ষমতাসীনদের অধীনে নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন হবে না। যে কারণে ১৯৯৬ সালে বিএনপির বিরুদ্ধে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। এই ব্যবস্থায় পরপর তিনটি নির্বাচন হলেও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই বিধান বাতিল করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক, নির্দলীয়, নির্বাচনকালীন, অন্তর্বর্তী––শব্দ যাই বলা হোক না কেন, মূল উদ্দেশ্য একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন যদি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে, যদি সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারে, তাহলে আর এই নিরপেক্ষ সরকারের দাবির যৌক্তিকতা থাকে না। তর্কটা ঘুরেফিরে বারবার এ কারণে আসে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন কতটা নিরপেক্ষ থাকতে পারে? এটিও এক অদ্ভুত যুক্তি, কিন্তু নির্মম বাস্তবতা। আমাদের প্রতিবেশী ভারতেই দলীয় সরকারের অধীনেই সব নির্বাচন হয় এবং তাদের নির্বাচন কমিশন এতই শক্তিশালী যে, সেখানে নির্বাচনে কারচুপি অভিযোগ ওঠে না। ফলে নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের দাবি কিংবা গণআন্দোলনের হুমকি––সবকিছু ছাপিয়ে মূল প্রশ্ন আসলে কারা নির্বাচনটি পরিচালন করবেন এবং তারা কতটা নিরপেক্ষ থেকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)