ক. অহিংস আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তি
অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা হিসেবে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর নামই প্রথম আসে। শ্রীমদ রাজচন্দ্র নামে এক আধ্যাত্মিক গুরুর কাছ থেকেই গান্ধীর প্রথম ‘সত্য’ ও ‘অহিংসা’র দর্শণে দীক্ষিত হওয়ার সূত্রপাত। রাজচন্দ্র নিজেও ছিলেন একজন দার্শনিক, কবি ও লেখক।
প্রশ্ন আসতে পারে: ‘অহিংসা’ কী? যেকোন অবস্থায় নিজের এবং অন্যের প্রতি কোন ক্ষতির কারণ না হওয়ার অনুশীলনই ‘অহিংসা।’ ‘অহিংসা’ নীতি বিশ্বাস করে যে কোন লক্ষ্য অর্জনে মানুষ, প্রাণী বা প্রকৃতির ক্ষতি করার দরকার নেই এবং হিংসা বা সন্ত্রাসের পথ বর্জন করেও বড় লক্ষ্য এমনকি বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক বদলও অর্জন করা সম্ভব। গান্ধীর মত রুশ লেখক তলস্তয়ও সহিংসার পরিবর্তে ‘নাগরিক প্রতিরোধ’ বা ‘অসহযোগে’র মাধ্যমে দাবি দাওয়া অর্জনের প্রতি জোর দিয়েছেন। শিক্ষা, বিপুল গণ-অসহযোগ, সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক নানা কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন অহিংস আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। জার্মানিতে পেট্রা কেলি পরিবেশবাদী ‘গ্রীন পার্টি’ গড়ে তুলেছিলেন অহিংস নীতির ভিত্তিতেই।
ভারতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত, কয়েক দশকের বৃটিশ-বিরোধী অহিংস আন্দোলনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালো আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য নাগরিক নানা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র অহিংস আন্দোলনের নীতি গ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় খামার চাষীদের জন্য মানবিক আচরণ প্রাপ্তির আশায় সিজার শাভেজ পরিচালিত আন্দোলন বা ১৯৮৯ সালে চেকোশ্লোভাকিয়ার ‘মখমল বিপ্লব’ বা ‘ভেলভেট রেভল্যুশন’-ও বিশ্বের কয়েকটি বৃহত্তম, সফল অহিংস আন্দোলনের একটি। সাম্প্রতিক সময়ে লাইবেরিয়ায় ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের শেষে শান্তি অর্জনে সেদেশের নারী সমাজের গড়ে তোলা অহিংস আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে।
অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তারা বিশ্বাস করেন যে সহযোগিতা এবং সম্মতিই সব নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ভিত্তি। সবধরণের শাসন বা কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা, সে হোক আমলাতান্ত্রিক, আর্থিক বা সামরিক বাহিনী বা পুলিশের মত প্রতিষ্ঠান, তাদের বৈধতার জন্য নাগরিকদের সম্মতির প্রতি নির্ভরশীল। কোন কারণে শাসকশ্রেণির নানা আচরণ যখন নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায়, তখন সহিংসা বা রক্তপাতের পথে না গিয়ে শাসকের প্রতি অসহযোগ বা গণ-অসম্মতি জানানোর মাধ্যমে যেকোন নাগরিক অধিকার আন্দোলন বেগবান হতে পারে।
শুধুই প্রাচীন ভারতের হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন দর্শন নয়, নিকোলাস ওয়াল্টারের মতে, পশ্চিমা রাজনৈতিক চিন্তাতেও অহিংসা তত্ত্বের ধারণা বরাবরই ছিল। নিজের মতের স্বপক্ষে ওয়াল্টার ষোড়শ শতকে এতিয়েন দ্যু লা বোয়েতি’র লেখা ‘ডিসকোর্স অন ভল্যান্টারি সার্ভিচ্যুড- ১৮১৯’ বা পি.বি.শেলীর ‘দ্য মাস্ক অফ এ্যানার্কি-১৮১৯’-র কথা উল্লেখ করেন যেখানে হিংসা বা সন্ত্রাসের ব্যবহার ছাড়াই যেকোন জনবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। ১৮৩৮ সালে উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসন ‘নিউ ইংল্যান্ড নন-রেজিস্ট্যান্স সোসাইটি’ গঠনে ভূমিকা রাখেন। এই সোসাইটি বা সমিতির ভূমিকা ছিল যাবতীয় সহিংস আচরণের প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে জাতিগত ও লৈঙ্গিক সমতা অর্জন। আজকের শিল্পায়িত গণতন্ত্রের যুগে শ্রম, শান্তি, পরিবেশ ও নারী আন্দোলনে ‘অহিংস মতবাদ’ এক কার্যকর স্ট্র্যাটেজি হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। ফিলিপাইনে স্বৈরাচারী মার্কোজের পতনেও অহিংস আন্দোলন কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছিল।
ষাটের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কালোদের জন্য নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রবক্তা ও গান্ধীর ভাবশিষ্য মার্টিন লুথার বলেন, ‘অহিংস আন্দোলন এটাই দাবি করে যে আমাদের লক্ষ্যের মত লক্ষ্যে পৌঁছানোর পন্থাও যেন বিশুদ্ধ হয়।’ লুথার আরো বলেন, ‘অহিংস প্রতিরোধ শুধু বাহ্যিক, দৈহিক সহিংসাই প্রতিরোধ করেনা, আত্মা বা চৈতন্যের প্রতিরোধের কথাও বলে। একজন অহিংস প্রতিরোধকারী শুধুই যে তার প্রতিপক্ষকে গুলি করতে অস্বীকৃত হয় তা’ নয়- সে এমনকি তার প্রতিপক্ষকে ঘৃণা করতেও অসম্মত হয়।’ এই আন্দোলনের পথপ্রদর্শক গান্ধী অহিংস আন্দোলনের পন্থাকে বীজ ও লক্ষ্যকে গাছের সাথে তুলনা করেছিলেন। অহিংস আন্দোলনের সাথে জড়িত থাকে ‘সত্য’ বা ‘সত্যাগ্রহে’র প্রশ্নও। প্রত্যেকেই নিজের সত্যকে সত্য মনে করে। কিন্তু আমার বিরোধী বা প্রতিপক্ষ কি ভাবছে? বৃহত্তর সত্যকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের বিরোধী বা প্রতিপক্ষের মতকে শোনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিপক্ষের সাথে আলোচনা ব্যতীত বা প্রতিপক্ষের কথা না শুনে তাই সত্যকে অনুধাবন করা আদৌ সম্ভব নয়। বর্তমান পৃথিবীতে পশু অধিকার বা পশু সুরক্ষা, নিরামিষ আহার সহ নানা জীবনাচার ভিত্তিক অহিংস অনুশীলনের প্রবণতা অনেকের ভেতরেই দেখা যায়।
প্রাচীন ভারতে বেদে যজ্ঞে প্রচুর পশুবলির উল্লেখ থাকলেও ৫০০ অব্দ নাগাদ ‘অহিংসা’-র উপর গুরুত্ব আরোপিত হতে থাকে। ১০০০ থেকে ৬০০ অব্দ পর্বে রচিত যজুর্বেদে ‘পৃথিবীর সবাই আমাকে মৈত্রী বা বন্ধুত্বের চোখে দেখুক, আমিও যেন তাদের মৈত্রী বা বন্ধুত্বের চোখে দেখতে পারি এবং আমরা যেন একে অপরের দিকে মৈত্রী বা বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে তাকাতে পারি।’ ছান্দোগ্য উপনিষদেও ‘অহিংসা’র কথা আসছে। জাপানে ‘আইকিদো’ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা মোরিহেই উশিবা ‘অহিংসা’ দর্শনের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেই ‘আত্মরক্ষা’র অধিকার সম্পর্কে বলেন যে পৃথিবীটা বহি:স্থ আক্রমণ থেকে মুক্ত নয়। কিছু মানুষ তার ভয়, আতঙ্ক বা অজ্ঞানতা থেকে অন্যকে দৈহিক বা ভাষিক আক্রমণ করবেই। এই আক্রমণকারীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে আক্রমণকারীর উত্তেজনা প্রশমনের সুযোগ দিতে হবে। পৃথিবীতে সেরা আত্মরক্ষা হলো যেখানে নির্যাতিত আক্রমণকারীকেও সম্মান করেন। চীনে স্যুই রাজবংশ, তাং রাজবংশ এবং সং রাজবংশ প্রতি চান্দ্রেয় বর্ষের ১ম, ৫ম এবং ৯ম মাসে পশুবধ নিষিদ্ধ করেন। এমনকি বছরের কিছু সময় মাছ ধরাও নিষিদ্ধ করা হয়।
আজকের পৃথিবীতে অহিংস আন্দোলনে ‘অসহযোগ’ কর্মসূচী একটি বড় স্ট্র্যাটেজি হিসেবে কাজ করে। যেমন শ্রমিক ধর্মঘট, অর্থনৈতিক বয়কট, নাগরিক অমান্যতা, কর প্রদানে অস্বীকৃতি ইত্যাদি কর্মসূচীর কথা বলা যায়। এছাড়াও সড়ক অবরোধ, অনশন কিম্বা বিকল্প সরকার চালানোর মত নানা স্ট্র্যাটেজি রয়েছে। তবে, অহিংস আন্দোলনের নীতির অনেক কঠোর সমালোচকও রয়েছে। চে গুয়েভারা, লিও ট্রটস্কি, ফ্রাঞ্জ ফ্যানন বা সুভাষ চন্দ্র বসুর মত অনেকেই অহিংস আন্দোলনকে দেখেছেন প্রলেতারিয়েত বা ক্ষমতাহীন, নিপীড়িতের উপর বুর্জোয়া নৈতিকতা চাপিয়ে দেওয়ার পন্থা হিসেবে।
ম্যালকম এক্সের মতে, ‘নিষ্ঠুরতার শিকার কোন মানুষ যদি নিজের আত্মরক্ষার জন্য কিছু না করে সেই নিষ্ঠুরতাকে উল্টো মেনে নিতে থাকে, তবে সেটা একটা অপরাধ।’ পলিটিক্যাল স্যাটায়ার ও ইউটোপিয়া লিখে বিশ্বখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল বিশ্বাস করতেন যে গান্ধীর নীতি ‘স্বাধীন সংবাদপত্র ও সংসদ থাকা দেশেই শুধু বাস্তবায়িত হতে পারে।’ এ্যানার্কিস্ট বা নৈরাজ্যবাদী পিটার গেল্ডার্লুস তাঁর ‘হাউ নন-ভায়োলেন্স প্রটেক্টস দ্য স্টেট’ গ্রন্থে অহিংসা নীতি-কে অকার্যকর, বর্ণবাদী, জড় এবং পিতৃতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করেছেন।
খ. ‘নিরাপদ সড়ক চাই:’ ঢাকার শিশু-কিশোরদের নয় দিনের অহিংস আন্দোলন
ইতিহাসে কখনো কখনো এমন মাহেন্দ্রক্ষণ আসে যখন বহু দশকের জড়তা ও নিশ্চলতা, কর্তৃপক্ষ বা ব্যবস্থার নানা পীড়নের বিরুদ্ধে খুব সাধারণ মানুষই কোন সংগঠিত নেতৃত্ব ছাড়াই বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। ২৯ জুলাই রোববার দুপুরে ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থীরা যখন রেডিসন ব্লু হোটেলের পাশ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলো ও অনেক পথচারী বাসের জন্য ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখনি এক করুণ মৃত্যু বা ‘সড়ক হত্যা’র ঘটনা ঘটলো যা পরবর্তী নয় দিনের জন্য বাংলাদেশে এক অবিশ্বাস্য আন্দোলনের জন্ম দিল। হ্যাঁ, রোববার দুপুরের সেই বিশেষ মূহুর্তে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনের বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের একটি বাস এলে শিক্ষার্থীরা তাতে ওঠার চেষ্টা করার সময় একই পরিবহনের আরেকটি বাস বাম পাশ দিয়ে ঢুকে শিক্ষার্থীদের চাপা দিলে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির আবদুল করিম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী দিয়া খানম ওরফে মীম বাসচাপায় নিহত ও আরও ১৩ জন আহত হয়। সহপাঠীদের মৃত্যুর খবর পেয়ে প্রতিষ্ঠানের অন্য শিক্ষার্থীরা এসে বিমানবন্দর সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করে।
এরই মাত্র কয়েক ঘন্টা পরে, সাংবাদিকরা এক অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সভাপতি শাজাহান খানকে জিজ্ঞেস করেন এই ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া কী, তখন তিনি হাসিমুখে ভারতের একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন “ভারতের মহারাষ্ট্রে গাড়ি দুর্ঘটনায় ৩৩ জন মারা গেছেন। এখন সেখানে কী…আমরা যেভাবে এগুলোকে নিয়ে কথা বলি, এগুলো কি ওখানে বলে?” তার বক্তব্য দেশব্যাপী অত্যন্ত সমালোচিত হয় এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্ষোভের সৃষ্টি করে।
ঢাকাবাসী তথা বাংলাদেশের নাগরিক মাত্রই জানেন যে ঢাকা তথা সমগ্র বাংলাদেশের বাস চলাচল ব্যবস্থা কতটা আতঙ্কজনক ও অনিরাপদ। শুধু সড়ক নয়, নৌপথেও গত বেশ কিছু বছর ধরে ঘটে চলেছে শত শত প্রাণহানি ও দুর্ঘটনা যার কোনটির জন্যই নৌপরিবহন মন্ত্রী ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী সভাপতি শাজাহান খান কখনোই ক্ষমা চাননি। একটা সময় বামপন্থী ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)’-এর ত্যাগী শ্রমিক নেতা হলেও পরবর্তী সময়ে শাহজাহান খান হয়ে ওঠেন সম্পূর্ণ ১৮০ ডিগ্রি বিপরীত চরিত্রের এক মানুষ। আজকের শাহজাহান খান বাংলাদেশের কোটি কোটি নাগরিকের নিদ্রা হরণকারী এক আতঙ্কের নাম। তবে, পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকদের মাঝে এই ব্যক্তিই ভয়ানক জনপ্রিয়। বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনায় বাস বা ট্রাক চালকদের সহজ মুক্তির ব্যবস্থা করে দেয়াই সড়ক শ্রমিকদের ভেতর শাহজাহান খানের প্রবল জনপ্রিয়তার কারণ।
অতীতে বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস বা ‘জাসদ’ থেকেই বিএনপিতে যোগ দেয়া ও নেতা শাহজাহান সিরাজ ঢাকার পরিবহন সেক্টরের শ্রমিকদের ভেতর পেশী শক্তি ও সিন্ডিকেট ক্ষমতা পরিচালনা করতেন। সেই ক্ষমতার সাথে টক্কর দিতেই আওয়ামী লীগও একসময়ের তীব্র আওয়ামী বিরোধী দল ‘জাসদ’ থেকে শাহজাহান খানকে দলে নিয়ে নেয়। দেশে নানা ভাগে বিভক্ত বামদলগুলো দুর্ভাগ্যজনক ভাবেই পরিবহন সেক্টরে আদৌ কোন গণসংগঠন গড়ে তোলার কাজ করতে পারেনি।
‘ন্যাশনাল কমিটি টু প্রোটেক্ট শিপিং, রিসার্চ এ্যান্ড রেইলওয়েজে’র এক পরিসংখ্যান বা হিসাবমতে দেখা যায় যে, এক ২০১৭ সালে ঢাকায় বিভিন্ন ধরনের সড়ক দুর্ঘটনায় ৪,২০০-এর বেশি মানুষ মারা গেছে আর হতাহত হয়েছে ১৬,১০০ মানুষ। অদক্ষ চালক, লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন প্রায় ২৪ লক্ষ বাস-ট্রাক-টেম্পু প্রতিমূহুর্তে হত্যাকারীর বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢাকার রাজপথে। মানুষ এসবই মেনে নিয়েছিল- ‘প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে’ যেমন মেনে নেয়। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে গেছে জনৈক মন্ত্রীপুত্রের গাড়ি চাপা পড়ে প্রথমে পঙ্গু ও পরে মৃত্যু বরণ করা ছড়াকার বাপ্পী শাহরিয়ারের (১৯৮৫) অসহায় পরিবারের কাছে, খ্যাতনামা অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হবার পর থেকে এই অভিনেতা সম্পূর্ণ একা একা বহু বছর ধরে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ শীর্ষক আন্দোলন করে চলেছেন। এমনকি বর্তমান সরকারের মন্ত্রীপরিষদ সদস্য, আইনজীবী ও এককালের জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারানা হালিম সড়ক দূর্ঘটনায় অকাল প্রয়াত বোণের ছেলের জন্য শোক করেছিলেন কিছুদিন আগে। তবু প্রতিকার নেই।
সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রেটি- সবাই যখন কাঠামোগত সড়ক হত্যাকে নিয়তির বিধিলিপি বলেই মেনে নিয়েছিলেন, এক ঝাঁক শিশু-কিশোর চ্যালেঞ্জ জানালো সেই ‘বিধির বিধান’-কে। স্কুল বা কলেজ ইউনিফর্ম পরে, কাঁধে ব্যাগ আর টিফিনের বাক্স বা ওয়াটার বটল নিয়েই অসংখ্য শিশু ও কিশোর-কিশোরী নেমে পড়লো ঢাকার যানজট আকীর্ণ, অচল সড়কে। তারা পরীক্ষা করতে লাগলো লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চলছে কিনা, গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে কিনা? সড়ক পরিবহনে দুর্দান্ত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলো তারা মাত্র ক’দিনে। বড়রা অবাক হয়ে হার মেনে গেলো। সেই সাথে ব্যানার বা প্ল্যাকার্ডে ‘নিরাপদ সড়ক পথে’র দশটি দাবি তারা তুলে ধরলো। সেই দাবিগুলো হলো:
১. বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে দুজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জন্য দায়ী চালককে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে হবে এবং এই বিধান সংবিধানে সংযোজন করতে হবে।
২. দুর্ঘটনার পর করা নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানের বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
৩. ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না।
৪. বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়া যাবে না।
৫. শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬. প্রত্যেক সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে।
৭. সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
৮. শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে।
৯. শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
১০. পরিবহন সেক্টরে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
অনেক মজার মজার স্লোগান লিখলো তারা। যেমন, ‘বাস মামা- আস্তে যাও। মারা গেলে মা কাঁদবে’ বা ‘এখানে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কার হচ্ছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য দু:খিত।’ হ্যাঁ, একইসাথে দু:খজনকভাবে বয়সের তুলনায় অনেকটাই প্রাপ্তবয়ষ্কদের মত অশালীন, যৌন সহিংসামূলক গালিসম্বলিত ব্যানারও এদের কেউ কেউ ব্যবহার করেছে। কিশোরীদের কারো কারো হাতে নারীর প্রতি অবমাননামূলক যৌন সহিংসার ভাষা সম্বলিত ব্যানার বাস্তবিকই পীড়াদায়ক লেগেছে। তবে, সেটা সম্পূর্ণ চিত্রের খন্ডাংশ মাত্র। অভিভাবকেরা অনেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে ছিলেন। অনেক মা খাইয়ে দিচ্ছেন আন্দোলনরত কিশোর-কিশোরীদের- এমন ছবি মুগ্ধ করার পাশাপাশি আট-দশ বছরের শিশুর হাতে অত্যন্ত অশ্লীল গালি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড আর তাকে ধরে তার মা গর্বিত মুখে হাসছে এটা আমাদের এতদিনের গড়ে ওঠা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধকে খানিকটা হলেও ধাক্কা দিয়েছে। তবে, সেই সাথে এটাও বুঝতে হবে যে দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভও এসবকিছুর পেছনে কম দায়ী নয়।
আন্দোলনের দানা বেঁধে ওঠা ও আন্দোলনকে ‘ব্যবহার’ করার অপচেষ্টা
আন্দোলনের পঞ্চম দিনে, ২ আগস্ট ঢাকাসহ সিলেট, চট্টগ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জ, বান্দরবান- সারাদেশে শিক্ষার্থীরা সংহতি সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে।
আন্দোলনের ষষ্ঠ দিনে, ৩ আগস্ট রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির জিগাতলা এলাকায় শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মানববন্ধন করার সময় কিছু যুবক শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে যাতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়। প্রতক্ষ্যদর্শী ও স্থানীয়দের অভিযোগ, যুবকরা আওয়ামী যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
আন্দোলনের সপ্তম দিনে, ৪ আগস্ট রাজধানীর ধানমন্ডি ও মিরপুর এবং নারায়াণগঞ্জ ও ফেনীতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত কয়েক’শ শিক্ষার্থী হামলার শিকার হন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ও ককটেল ছোড়ে এবং রড, লাঠি ও বাঁশ দিয়ে তাদের বেধড়ক পেটায়। এছাড়া তারা পুলিশ-এর বিরুদ্ধে হামলাকারীদের পক্ষ নেওয়াার অভিযোগ করে।
তবে, এটা মুদ্রার একটি দিক। মুদ্রার অপর দিকটি হলো সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের পাশে একাধিক বাম সংগঠনের ছাত্র-ছাত্রীরা গুরুতরভাবে আহত হলেও বিএনপি-জামাত-হিযবুত তাহরির সহ সরকার বিরোধী উগ্র ডানশক্তিও সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের এই আন্দোলনকে ‘ম্যানিপুলেট’ বা ‘অপব্যবহার করা’র চেষ্টা করেছিল। ‘ঢাকা টাইমস’ নামে এক অন-লাইন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায় যে আকস্মিকভাবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে স্কুল ইউনিফর্ম বিশেষত: লার্জ সাইজ স্কুল ইউনিফর্মের চাহিদা বেড়ে যায়। দর্জিরা এঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেন। নকল আইডিকার্ডের স্তুপের ছবিও ভাইরাল হয়েছে। ভাইরাল হয়েছে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতার ফোনালাপ।
২০০৮-এ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে নির্বাচিত হলেও ২০১৪-এর বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। প্রধান বিরোধীদল বিএনপির বিনা অংশগ্রহণেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে, ২০১৫ সালে এক মাসব্যাপী পেট্রোল বোমায় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে হতাহত করা ছাড়া দলটি কোন জনস্বার্থমূলক প্রশ্নে একটিও বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন নেতার দুর্নীতি থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যঙ্কের ভল্টের স্বর্ণ হ্রাস পাওয়া বা বড়পুকুরিয়ার কয়লাখনির কয়লা হ্রাস পাওয়া জনমনে স্বস্তি দিচ্ছে না। তবে, সরকারবিরোধী সেন্টিমেন্টের গরিষ্ঠ অংশটি দু:খজনকভাবেই জনস্বার্থ আন্দোলনের চেয়েও ধর্মীয় প্রণোদনা থেকেই চালিত হচ্ছে বেশি। এমনকি এই ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে’র মত জনস্বার্থ আন্দোলনকেও যখনি বিএনপি-জামাতের মত উগ্র ধর্মীয় শক্তিগুলো ব্যবহার করতে চাইছে, তখনি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি শাসনের সময়ে দুর্নীতি, সাংবাদিকদের প্রতি আক্রমণ, সংখ্যালঘু নির্যাতন বা জঙ্গীবাদের ভয়াবহ বিস্তার, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়ার লাগামছাড়া দুর্নীতির রেকর্ড আরো দু:সহ ছিল।
যাহোক, ৪ আগস্ট দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার অন-লাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদন জানায় যে প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোয় বিশেষত: নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্টসহ একাধিক ভার্সিটি ক্যাম্পাসে পুলিশ ও ছাত্রলীগের আক্রমণে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী অনেকে যেমন আহত হয়েছে, আবার স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা গত বৃহস্পতিবার থেকেই আর এই ক্যাম্পাসগুলোর সামনে আসেনি। চল্লিশোর্ধ্ব কিছু বহিরাগত, লাঠিসোটাধারী ব্যক্তিও পুলিশকে আক্রমণ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে নর্থ সাউথসহ একাধিক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে হিযবুত তাহরির বা জামাত-শিবির সহ উগ্রবাদী সংগঠনগুলোর প্রভাব বেড়েছে। এছাড়া মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ঘটনা বা সাম্প্রতিক ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনে’র সময়ের মতই অনেক গুজব ছড়ানো হয়েছে। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছোটভাইয়ের পুত্রবধূ ও অভিনেত্রী নওশাবা এক ভিডিওতে ছাত্রলীগের ছেলেরা আন্দোলনকারী চারজন ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুন করেছে এবং আন্দোলনরত ছাত্রদের কয়েকজনকে খুন করেছে বলে ফেসবুকে লাইভ করায় ৪ঠা আগস্ট সারা দেশে গুজব মারাত্মক আকার ধারণ করে। গুজবগুলো সবই পরে ভুল প্রমাণিত হয়। দিল্লি-মুম্বাই-কলকাতা সহ ভারতের একাধিক স্থানে ধর্ষিতা স্কুলছাত্রীদের ছবি ফটোশপ করে বাংলাদেশে ছাত্রলীগের হাতে করা হয়েছে বলে ফেসবুকে প্রচার করা হয়। এক ছাত্রের চোখ উপড়ে নেবার গুজবও ছড়ায় যা সত্য নয়। তবে, এতকিছুর পরও প্রচুর সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী আহত হয় যা সত্যিই অনভিপ্রেত ও দু:খজনক। বিশেষত পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা, জনদূর্ভোগ নিরসনের মত জনস্বার্থমূলক দাবিতে তারা যখন আন্দোলন করছিল!
এছাড়া আর একটি প্রশ্নও কেউ কেউ বিবেচনা করছেন: আমাদের মত বেসিক লাইফ-স্কিল প্রশিক্ষণহীন একটি দেশে এত দ্রুত এত কিশোর-কিশোরী এমন প্রবল দক্ষতায় সড়ক ব্যবস্থাপনা শিখে গেল, এটা সত্যি সত্যি তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা? নাকি তৃতীয় কোন শক্তি তাদের ব্যবহার করেছে?
সবকিছুর পর বর্তমান সরকারও সড়কপথের ধারাবাহিক কাঠামোগত হত্যা ও নৈরাজ্যের দায় এড়াতে পারেনা। শিশু-কিশোরেরা নিষ্পাপ ছিল বলেই তারা অমলিন এক আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল যা ব্যর্থ ডানপন্থী বিরোধীদলগুলো নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে নষ্ট করে দেয়। পাশাপাশি এদেশের বাম আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের ভেতর মতদ্বৈধতা, অনৈক্য ও জনবিচ্ছিন্নতার কারণে যে বৈপ্লবিক কর্মসূচী গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে, সেই সাংগঠনিক হতাশার কোন কোন জায়গা থেকে স্বত:স্ফূর্ত আন্দোলনগুলোয় তাদের অংশগ্রহণ অন্তিমে উগ্রতর ডানশক্তিকে পরিপুষ্ট করবে কিনা সেটাও বিবেচনায় রাখা ভাল। এ প্রসঙ্গে ইরানে শাহ শাসনের বিরুদ্ধে খোমেনির পক্ষে ইরানি বামদের অবস্থান তাদের জন্যই গণ-ফাঁসি ও হত্যার বিধান নিশ্চিত করেছিল। খোমেনি এসেই ‘তুদেহ’ বা ইরানি কম্যুনিস্ট পার্টির ৬৪,০০০ সভ্যকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখা প্রয়োজন। তবে, একটি বিষয় নিশ্চিত। আমাদের কিশোর-তরুণদের ভেতর নতুন শক্তি বাসা বাঁধছে। জোর করে নগর ভবন ঘুরিয়ে আনার পর ভিকারুন্নিসার ছাত্রীদের পরীক্ষা বর্জন বা থানা ঘেরাও করে সহপাঠীদের মুক্ত করা তারই লক্ষণ। ছাত্ররা মিলে ছাত্রীদের চারপাশে ব্যারিকেড গড়ে পাহারা দেয়া কিম্বা ‘সন্ত্রাস করে তিন দল/লীগ-শিবির-ছাত্র দল’-এর মত শ্লোগান দেয়াসহ অসংখ্য ভাল দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করেছে। তাজা ও উদ্দীপক এই কিশোর বসন্তের টাটকা বাতাসকে এদেশের প্রগতিশীল শক্তিগুলো বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবে নাকি প্রতিক্রিয়াশীল উগ্রতর ডান ও মৌলবাদী শক্তির ক্রীড়নক হিসেবে তারা ব্যবহৃত হবে সেটাই দেখার পালা।
সরকারকে বলি: আপনারাও সংযমী হোন। সতর্ক ও আন্তরিক হোন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)