চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

নিরাপত্তাহীনতায় সুন্দরী

নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সুন্দরী। ভালো নেই গেওয়া, গরান, গোলপাতা। অজানা আশংকায় বানর, হরিণ, কুমির। বাঘের সেই গর্জন তো নেই-ই। কমেছে বুকে হাঁটা সাপও। কাদার মধ্যে লুকিয়ে কোনো রকম বেঁচে আছে কাঁকড়া। ভয়ে দিন পার করছে কচ্ছপ, ডলফিন।

মহিষ, ষাঁড়, গণ্ডার, চিতা যে এদের এক সময় স্বজন ছিল, তা ভুলতেই বসেছে। স্বজন হারিয়ে ভুলে খেয়েছে সাদা মানিক জোড়া কান ঠুনি, বোঁচা হাঁস, গগন বেড, জলার তিতির এর নাম। নিজেদের নিরাপত্তা শংকায় আগের এসব স্বজনদের মনে রাখা কষ্ট হয়ে উঠেছে।

মালঞ্চ, পশুর, রায়মঙ্গল নোনা পানি ঠেকিয়ে কিছুটা আগলে রেখেছে। তবু নানা শংকা পিছু ছাড়ছে না। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের সরাসরি অংশ নেয়া নতুন করে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলেছে এদের। মানুষ আর প্রকৃতির ইচ্ছে। উভয় মিলে নিরাপত্তাহীন আর বিপদ নিয়ে চলতে হচ্ছে।

সুন্দরবনে মিলেমিশে থাকা এসব গাছ ও প্রাণীকুলের শংকা খোলা চোখেই দেখা মিলবে।

খুলনা ও বাগেরহাটের সীমান্ত দিয়ে গেলে সুন্দরবনের শুরু করমজল থেকে। করমজল থেকে ৯০ কিলোমিটার হিরণপয়েন্টের নীলকমল। করমজল থেকে নীলকমল এই পুরো পথ পাড়ি দিলে মাঝে মাঝে সুন্দরীর দেখা মিলবে। অনেকক্ষণ পর পর সরু সাদা ডালের মতো, আকাশের দিকে উঠে যেতে দেখা যাবে। এগুলোই সুন্দরী। যে সুন্দরী সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য। যা থাকার কথা ছিল পুরো পাড় জুড়ে। বাঁশঝাড়ের মতো ঘন সারিতে। এখন থেকে দশ বছর আগেও পুরো পাড় জুড়েই ছিল সুন্দরীর ঘন ছায়া। এখন তা অনেকটা পাতলা, গা ছাড়া গা ছাড়া। 

পশুর নদকে উপজীব্য করে বনের মধ্যে যে ছোট ছোট খাল ঢুকেছে তাতে আর গা ছম ছম ভাব নেই। আগে গোলপাতা কাটতে অথবা কাঠ সংগ্রহ করতে অথবা মৌয়ালদেরকে যেতে হতো অনেক সর্তকতা নিয়ে। এখন আর তা নেই। যেন স্বাভাবিক স্থলভূমি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বনের মধ্যে পর্যটক বা অন্য কারও ঢুকতে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় যাতায়াত দিন দিন বেড়েই চলেছে। একই সাথে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ এলাকায় গড়ে উঠেছে স্থাপনা। এর সাথে আছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানি স্তর বেড়েছে। তাতে বনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে নোনা পানি। জোয়ার হলে বনের উঁচু মিঠা এলাকায় নোনা পানি ঢুকে যাচ্ছে। এতে বনের প্রাণী ও গাছের ক্ষতি হচ্ছে। এই দুই মিলিয়ে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য সুন্দরবনকে কিছুটা হলেও চিন্তায় ফেলেছে।

সুন্দরবনের শেষ সীমানা থেকে দশ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো স্থাপনা করা যাবে না বলে আইন করা হয়েছে। এই দশ কিলোমিটারকে নিরাপদ অঞ্চল (বাফার জোন) বলা হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে নিরাপদ অঞ্চলের মধ্যে বড় বড় কারখানা গড়ে উঠেছে। উঠেছে আবাসিক বসতিও। দশ কিলোমিটার তো নয়ই একেবারে বন ঘিরেই গড়ে উঠেছে বসতি ও কারখানা। আসছে নতুন নতুন কারখানা করার প্রস্তাবও। এতে পশুর নদী দিয়ে নৌ চলাচল বেড়েই চলেছে।

খুলনার এক নম্বর কাস্টম ঘাট থেকে লঞ্চে উঠে যেতে যেতে চোখে পড়বে নদীর দুপাশেই বড় বড় কারখানা। ভৈরব নদীতে শুরু হয়ে পশুর পর্যন্ত। অনেকটা সরল রেখায় সুন্দরবনের বুক চিরে পশুর চলে গেছে সাগরে। পশুরের পাড়ে নিরাপদ অঞ্চলের মধ্যে ঢুকলে চোখে পড়বে কারখানার সারি।

উজান থেকে আরও ভেতরে গেলে আকরাম পয়েন্ট। এর দু’পাড়েই ঘনবন। এখান থেকেই নদীর গভীরতা তুলনামূলক বেশি। সেখানে মিলবে সারি সারি বিশাল বিশাল জাহাজের মাস্তুল। নোঙ্গর করা এসব জাহাজ এসেছে মালামাল নিয়ে। ফেলে আসা সারিবাধা কারখানার জন্য। ছোট ছোট জাহাজে মালামাল নামিয়ে দেয়া হচ্ছে এখান থেকে। সব সময় লাইন দিয়ে বড় বড় জাহাজ নদীর মাঝখানে নোঙর করে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজ বলে কথা। রাতে দূর থেকে দেখে মনে হবে আলোকসজ্জায় ভরা কোনো দশ তলা বাড়ি দাড়িয়ে। একটু পরে পরেই এমন জাহাজের নোঙর। জাহাজগুলো তাদের সকল ময়লা এই নদীতে যেমন ইচ্ছে মতো ফেলছে। তেমনই প্রতিনিয়ত পড়ছে জ্বালানি তেল বা অন্য রাসায়নিক বর্জ্যও। আর সেই বর্জ্য পশুর নিজে বহন করে ফেলে দেয় সুন্দরবনের মধ্যে। কিছু চলে যায় সাগরে। এই কাজে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করে জোয়ার ভাটা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী স্থাপনা নিষিদ্ধ ঘোষিত এলাকায় এখন পর্যন্ত ১৪৯টি শিল্প কারখানা আছে। এরমধ্যে ২৭টি অতি দূষণকারি, ৬৬টি দূষণকারি এবং ৬৫টি কারখানা অপেক্ষাকৃত কম দূষণকারি শিল্প কারখানা। এই তালিকায় নতুন করে যোগ হচ্ছে বড় সড় একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার অবস্থান রামপালে। সুন্দরবন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। 

পশুরের পূর্ব পাড় ধরে আগাতে থাকলে একে একে চোখে পড়বে শিল্পকারখানার সারি। এগুলো সুন্দরবন থেকে একটু দূরে হলেও একেবারে নিষিদ্ধ এলাকার মধ্যে গড়ে উঠেছে। 

এলাকাবাসীর ভাষ্য, পশুর নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে। এতে লবণাক্ত গাছের ক্ষতি না হলেও মিঠা পানির গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে হুমকির মুখে পড়বে মিঠা পানির গাছগুলো। আগে প্রায়ই হরিণ চোখে পড়তো। এখন হরিণও খুঁজে ফিরতে হয়। বানরও আগের মতো দেখা যায় না। করমজলের সরু খাল দিয়ে নৌকা করে যারা মাছ ধরতে যান, তাদের কথাও একই। চিংড়ির পোনা আগের মতো এখন আর মেলে না। অন্য মাছের সংখ্যাও কম।

ইউনেস্কো ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনকে ৭৯৮তম ‘বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান’ (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট) ঘোষণা করে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের ৩০শে আগস্ট সুন্দরবনের সংরক্ষিত বনের চারদিকে ১০ কিলোমিটার ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়াস-ইসিএ) বা নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের পাঁচ জেলার ১১টি উপজেলার ৬৩টি ইউনিয়নের ২৭২টি মৌজাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

এই এলাকায় প্রাকৃতিক বন ও গাছপালা কাটা ও আহরণ, সবধরনের শিকার ও বন্যপ্রাণী হত্যা, বন্যপ্রাণী ধরা ও সংগ্রহ, প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংস বা সৃষ্টিকারি সব ধরনের কার্যকলাপ, ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট ও পরিবর্তন করতে পারে এমন সব কাজ, মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতিকারক যে কোনো প্রকার কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অথচ এসব এলাকা ঘুরলে দেখা যাবে নিরাপদ এলাকা বা প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নয় শুধু বনের মধ্যেও কোথাও কোথাও এসব লংঘন করা হয়েছে এবং হচ্ছে।

তাই নতুন যে কোনো স্থাপনা নিয়ে ভয়ের শংকা থেকেই যায়। আর তাই বিপদে থাকা সুন্দরী নতুন স্থাপনার জন্য নতুন বিপদের শংকা তুলতেই পারে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)