রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে লক্ষ্মীপুর টিবি হাসপাতাল। হাসপাতালের চত্বরে ঢুকতেই পূর্ব পার্শ্বে নার্সেস হোস্টেল। পাশেই আছে পুকুর। এই হোস্টেলের পাশেই চোখে পড়বে নিতান্ত সাধারণ অবস্থায় অসংরক্ষিত একটি কবর। না গণ কবর। এখানে একই কবরে শুয়ে আছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের তিন শহীদ। পথচারীদের কৌতূহল নিবারণের জন্য বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ কেউ বা তাদের কাছ থেকে অবহিত উত্তরসূরি হয়তো এখনো স্মরণে রেখেছেন এই কবরের ইতিকথা। এগিয়ে গেলে দেখা যাবে কবরের ফলকে খোদাই করে লেখা- ” ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল বুধবার মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গুলিতে শাহাদাত বরণকারী দেশমাতৃকার জন্য চরম উৎসর্গ সাক্ষ্য হয়ে পরম নিশ্চিন্তে এখানে ঘুমিয়ে আছেন- শহীদ আবদুল বারী হাওলাদার, শহীদ আবদুল কাইয়ূম ও শহীদ মোহাম্মদ সেলিম। তাদের প্রতি সালাম ও শ্রদ্ধার্ঘ ।
১৯৭১ সাল। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে শুরু হয় একটি দেশের জন্ম-যন্ত্রণা। চারদিকে শুধু গুলির শব্দ। আর্তনাদ। চিৎকার। গোটা বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চলছে বাঙালির প্রতিরোধ লড়াই। মুক্তিযুদ্ধের বাঁধভাঙা ঢেউ আছড়ে পড়ল শিক্ষা শহর রাজশাহীর নীরব উপকণ্ঠেও।
ভয়াল ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে গণহত্যা সংঘটিত করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। গোটা বাংলাদেশে নিরপরাধ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জংলি প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে সারা দেশ। রাজশাহীতে ৭ এপ্রিল অকস্মাৎ তীব্র হয়ে ওঠে হানাদার বাহিনীর নৃশংস তৎপরতা। টিবি হাসপাতাল স্টাফ কোয়ার্টারের পেছন দিয়ে রেললাইন। সকাল থেকেই দেখা যাচ্ছিল ফৌজি বোঝাই ট্রেন চলছে উপশহর ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এদিকে ট্রাকে করে ইপিআর সদস্যদের একটি দল এসে নামল টিবি হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টারের সামনে। ইপিআর বাঙালি অফিসার শাহ আলম এসে আমাদের বাসার দরজায় কড়া নাড়লেন। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। আমার আব্বা আবদুল বারী হাওলাদার দরজা খুলে দিতেই তারা উল্লাস করে বলে উঠলেন, ‘এই এলাকা আমার আজ সারা দিন যুদ্ধ করে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত করেছি। খুব ক্ষুধার্ত আমরা। যা আছে খেতে দিন।’ এই দলের প্রায় ৪০জন সদস্যের জন্য মা দ্রুত ভাত-তরকারি রান্না করে দিলেন। আশপাশের বাড়ী থেকেও কিছু কিছু খাবার এসে গেল। তখন সবার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা দেশের স্বার্থের কাছে বিলীন হয়ে গেছে। এপ্রিলের ৭ থেকে ১৪ তারিখ পর্যন্ত রাজশাহীতে প্রবল প্রতিরোধ যুদ্ধ চলল। এই এক সপ্তাহ ধরে স্থানীয় যুবকদের সক্রিয় সহযোগিতা নিয়ে ইপিআর সদস্যদের প্রতিরোধ চরম আকার ধারণ করে। সেনানিবাসে তারা বন্দি করল পাকিস্তানী সৈন্যদের। ১৪ তারিখে কার্যত গোটা রাজশাহীর প্রতিরোধ ভেঙে পড়ল। বোমা মেরে গ্রাউন্ড রেজিস্ট্যান্স ভাঙা ছাড়াও পাকিস্তানি সৈন্যরা বিমানে করে এসে উত্তর বাংলার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান নিল। প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার সাথে সাথে ইপিআর বাহিনী পিছু হাটতে থাকল। যাওয়ার সময় তারা শহরবাসীকে তাদের সাথে নিরাপদ স্থানে সরে পড়ার আহ্বান জানালেন।
অনেক স্টাফ হাসপাতাল থেকে চলে গেলেও রোগীদের ফেলে রেখে কর্তব্যরত আবদুল বারী হাওলাদার হাসপাতাল ত্যাগ করতে পারলেন না। তিনি বাসা বদলে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে নার্সেস হোস্টেলে সরে গেলেন এবং স্থান নিলেন ডাইনিং রুমে।
১৪ এপ্রিল। বাংলা পহেলা বৈশাখ। সেদিন ছিল বুধবার। আবদুল বারী হাওলাদার হাসপাতাল থেকে এসে গোসল করে বাসার সবাইকে নিয়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে তিনি দুজন স্টাফ সাথে নিয়ে জোহরের নামাজে দাঁড়িয়েছেন। সে সময় হঠাৎ পাকিস্তানী সৈন্যরা এসে বুটের লাথিতে ঘরের দরজা ভেঙে ফেলে ঘরে ঢুকলো। হিংস্র হানাদাররা চায়নিজ রাইফেলের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল নামাজরত তিনজনকে। তারা পাশের ঘরে ঢুকে বারী সাহেবের ছেলে মাহমুদ হোসেন বাদল, হাবিবুর রহমান ও মোহাম্মদ সেলিমকেও গুলি করে। এই ছয়জনের মধ্যে কাইয়ুম ও মোহাম্মদ সেলিম ঘটনাস্থলেই শাহাদত বরণ করেন। আবদুল বারীর দেহ ঝাঁঝরা হয়ে যায় গুলিতে। ঘটনার আকস্মিকতায় তার স্ত্রী ও পুত্রদের সজ্ঞা হারানোর মতো অবস্থা হলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আবদুল বারী সংজ্ঞা হারাননি।পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী চলে গেলে মুমুর্ষ আবদুল বারীকে স্বজনেরা যৎসামান্য চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। বিদায়ের শেষ সংলাপেও তিনি জীবনের জমা-খরচের শেষ হিসাবটুকু বুঝিয়ে দেন স্ত্রী-পুত্রদের। শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের আগে শেষবারের মতো তিনি পবিত্র কোরআনের বাণী শুনতে চান । তারপর সব শেষ…। সকল চেষ্টা বিফল করে হাজারো আন্তরিক চেষ্টার পরও সন্ধ্যায় তিনি দেশের জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে শাহাদাত বরণ করেন। বাকী অন্য তিনজন মারাত্মক জখম নিয়ে ও দু:সহ স্মৃতি বুকে ধারণ করে আজও বেঁচে আছেন।
ওই হত্যাযজ্ঞের পর সন্ধ্যায় রাজশাহীতে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। মৌসুমী কাল বৈশাখীর দাপটে কেঁপে উঠেছিল গোটা রাজশাহী। কোথায় জানাজা? কোথায় দাফন? বাইরে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি! প্রকৃতির তাণ্ডব। অন্যদিকে পাকিদের আতংক। নিরুপায় এক শহীদ পরিবার প্রাণ বাঁচাতে তিন শহীদের লাশ ঘরে ফেলে রেখেই রক্তমাখা কাপড়েই বেরিয়ে পড়লাম প্রাণভয়ে। মায়ের হাত ধরে পাঁচ ভাই ও এক বোন সেই নিশুতি রাতেই গ্রামের পথ ধরলাম। মাইলের পর মাইল আম বাগানের ভিতর দিয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, গহীন অন্ধকারে পথ চলতে চলতে অবশেষে গভীর রাতে গিয়ে উঠলাম এক গ্রামে। গ্রামের নামটি এখন আর মনে পড়ছে না। রাতটা আশ্রয় নিলাম অচেনা এক পরিবারে। পরদিন স্থানীয় হাটে জানাজানি হয়ে গেল আমাদের আশ্রয়ের কথা। হাসপাতালেরই এক স্টাফ নূর মোহাম্মদ সাহেব এসে নিয়ে গেল তার গ্রামের বাড়ি মাঙ্গুইনপুর। পরিচয়ের সূত্র ধরে স্থানীয় চেয়ারম্যানের বাড়িতে আমরা আশ্রয় পেলাম। সেখানে আমরা থাকলাম আগস্ট পর্যন্ত।
একদিন রেডিওতে ঘোষণা শুনলাম, পক্ষত্যাগী সব সরকারি কর্মচারীকে কাজে যোগ দিতে হবে। ২১এপ্রিল হাসপাতালের কজন স্টাফের সাথে আমরাও শহরে ফিরে এলাম। তিন শহীদের গলিত দেহ তখনো সেই ঘরেই পড়ে আছে। অথচ পুরা ঘর লুটেরাদের হাতে সাফাই সারা। ঘটি-বাটি সহ সব লুট করে নিয়ে গেছে। কাফন দেয়ার মতো কাপড়ও খুঁজে পাওয়া গেল না। অগত্যা পুরানো ছিঁড়া বিছানার চাঁদর, পর্দার কাপড় মুড়িয়ে দিয়ে কাফনের কাজ সারা হল। দাফনের পর কবরের উপরে দেয়ার মতো কিছু না পেয়ে পাক-বাহিনীর লাথি দিয়ে ভাঙ্গা দরজাটি দিয়েই কাজ সরাতে হল। তিনটি মরদেহ হাসপাতাল চত্বরে একই কবরে দাফন করা হলো। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভাইবোনদের নিয়ে প্রাণান্তকর কষ্ট করতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আমরা ঢাকায় চলে আসি। এরপর থেকে প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল এলেই শহীদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিতে ও দোয়া করতে আমরা রাজশাহী আসি।
মুক্তিযুদ্ধে বাবা শহীদ হয়েছেন। স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকায় টকটকে লাল সূর্যে বাবার রক্তও মিশে আছে ভাবতেই আমরা এ জন্য গর্ববোধ করি। তবে আজো অনেক অব্যক্ত কষ্টই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর সাতচল্লিশটি বছর কেটে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদদের নিয়ে কত কিছুই হয়, হচ্ছে। অথচ আমাদের একটি ঐকান্তিক বাসনা আজও পূরণ হয়নি। আজও কর্তৃপক্ষ তিন শহীদের কবরটি পাকা করার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। আজও কাঁচা কবরটি আমরা পারিবারিক উদ্যোগেই রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছি। কবরের সামনে তিন শহীদের নাম সংবলিত একটি ফলক ১৯৯৭ সালে লাগানো হয়। গতবছর রাজশাহী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমানের উদ্যোগে রাজশাহীর সাংবাদিক সমাজ এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ মিলে গণকবরের সামনে এক আলোচনা সভা ও দোয়ার আয়োজন করে। এবারো শহীদদের স্মরণে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে এমনই আয়োজনের কথা আমাকে জানিয়েছেন সুহৃদগণ। কিন্তু আমাদের সাথে সাথে শহীদের ঘটনা অবহিত সকলেই আজো খুব মনো কষ্ট অনুভব করেন গণহত্যায় শহীদদের নামের তালিকায় আজো এই তিন শহীদের নাম ওঠেনি বলে। গণকবরের তালিকায়ও গণ কবর হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি। আজো সকল ব্যাপারে সহযোগিতা করেন হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। কিন্তু কবরটি আজও পাকা করা গেল না, অথচ মুক্তিযুদ্ধের এই আত্মত্যাগী শহীদদের কবরটি পাকা করে গণকবরের মর্যাদা দান এবং জাতির মুক্তির জন্য আত্মত্যাগের এই ঘটনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যেন অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে তাঁর উদ্যোগ গ্রহণ করাটা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।