রাত পোহালেই রাজধানীর দুইখণ্ডের সিটি করপোরেশন নির্বাচন। ঢাকাবাসী পেতে যাচ্ছেন একজোড়া নতুন নগরপিতা (সিটি মেয়র)। ইতিমধ্যে মাইকে প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়েছে। এতে রাজধানীবাসী সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। কারণ গত কয়েকদিন ধরে উচ্চস্বরে গান-বাজনা, স্লোগান শুনতে শুনতে মানুষের কান ঝালাপালা। এখন এই ‘শব্দ-সন্ত্রাস’ বন্ধ হওয়ায় সবাই যার পর নাই খুশি। আপাতত ভয়াবহ শব্দ দূষণ থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে।
এবার ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মাইক ও সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে উচ্চস্বরে গান বাজানোর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। অনেকে আবার নির্বাচনী প্রচারে মাইকের বদলে কাভার্ড ভ্যানে সাউন্ডবক্স বসিয়ে প্রচার চালিয়েছেন। সেখান থেকে বিকট শব্দে প্রার্থীর পক্ষে চটুল ভাষায় গান বাজানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, স্বতন্ত্র-সবাই নির্বাচনের প্রচারে একই পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে হাসপাতালের রোগী—কেউ–ই ওই বিকট শব্দের উৎপাত থেকে রেহাই পাননি। নির্বাচনকে ঘিরে রাজধানীবাসী এমন বিকট আওয়াজের প্রচারণা আগে কখনও দেখেনি।
এবারও মেয়র প্রার্থীরা যে যার মতো করে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন। কেউ বলেছেন, ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন নগরী করবো, কেউ বা বলেছেন সবুজ ঢাকা করবো, কেউ আবার বলেছেন আধুনিক ঢাকা গড়বো। এতোসব প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়িয়ে ভোটারদের মন পাবার চেষ্টা করেছেন হবু নগরপিতারা। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ক্ষমতা ও সাধ্য তাদের আছে কি নেই, তা কেউ তলিয়ে দেখেছেন বলে মনে হয় না। আদতে কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়রদের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। তারা অনেকটাই ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার।
বর্তমান বিধি অনুযায়ী সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ছাড়া একজন মেয়রের নিজস্ব কোনো ক্ষমতা বা শক্তি প্রয়োগের বিধান নেই। ঢাকাবাসীর অধিকাংশ সমস্যার সমাধানই মেয়রদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। শুধু মশা তাড়ানো, ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা আর লাইটিং করা ছাড়া বড় কোনো কাজ করার ক্ষমতা মেয়রের হাতে নেই।
সিটি করপোরেশন মেয়রের চাইতে বরং পৌর মেয়রের ক্ষমতা বেশি। যেমন পৌর মেয়র তার এলাকায় পানি সরবরাহের ক্ষমতা রাখেন, ভবন নির্মাণে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, ড্রেন সংস্কারের ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু এসব ক্ষমতা সিটি করপোরেশন মেয়রের নেই। তিনি যে ল্যাম্পপোস্টে বাতি লাগান ওই ল্যাম্পপোস্ট বসানোরও ক্ষমতা তার নেই। কারণ ওটাও করে অন্য একটা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। রাজধানী ঢাকাবাসীদের জন্য যে ৫৬টি সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলোর প্রত্যেকটিই আলাদা আলাদা সেবা দিয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানে সিটি মেয়রের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এমনকি সমন্বয় বিধানের ক্ষমতাও নেই।
ঢাকা সিটির অভিভাবক হিসেবে সিটি করপোরেশনকে ধরা হলেও মাত্র ২০টির মতো সেবা দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে তাদের। আর এসব সেবার মধ্যে অধিকাংশই দাফতরিক যা দৃশ্যমান নয়। সিটি করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ রাস্তা ও ফুটপথ নির্মাণ এবং সংস্কার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক বাতি রক্ষণাবেক্ষণ, মশা নিধন, কবরস্থান ও শ্মশানের মতো হাতেগোনা কয়েকটি দৃশমান সেবা দিয়ে থাকে সিটি করপোরেশন। এছাড়া, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, তালাক ও বিবাহ নিবন্ধন, নাগরিক সনদ বিতরণ, আবাসিক কর আহরণের মতো দাফতরিক সেবাও দিয়ে থাকে সিটি করপোরেশন।
এর বাইরে সিটি করপোরেশনের আর কোনো ভূমিকা নেই। অথচ প্রত্যেক মেয়র প্রার্থী প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। তারা দূষণমুক্ত ঢাকা নগরী গড়ে তুলবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এখানে বলা ভালো, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণ করেছেন প্রার্থীরা। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) থেকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচারে পরিবেশদূষণ নিয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়া ৩০ জন প্রার্থীর পোস্টারে ৯ থেকে ১৮ দশমিক ৫ গ্রাম করে পলিথিন ব্যবহার করা হয়েছে। ২৫ লাখ পোস্টারে পলিথিন ব্যবহার হয়েছে উল্লেখ করে জরিপটিতে আরও বলা হয়, এতে মোট ৩৩ দশমিক ৬৮ মেট্রিক টন পলিথিন ব্যবহৃত হয়েছে। পোস্টার ও পলিথিন মিলিয়ে নির্বাচন উপলক্ষে মোট ৭৩ দশমিক ২৫ মেট্রিক টন আবর্জনা তৈরি হবে।
শব্দদূষণ নিয়ে করা জরিপে বলা হয়েছে, প্রার্থীরা মাইক ও সাউন্ডবক্সের মাধ্যমে যে প্রচার চালাচ্ছেন, তা মারাত্মক শব্দদূষণ ঘটাচ্ছে। ধানমন্ডি, জিগাতলা, কাজীপাড়া, মুগদাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শব্দ মাপার যন্ত্র দিয়ে ওই দূষণ পরিমাপ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি স্থানে ১২০ ডেসিবেলের চেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ পাওয়া গেছে। এই মাত্রায় শব্দ কেউ যদি ঘণ্টাখানেক শোনে, তাহলে তার স্থায়ীভাবে বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমনিতেই ঢাকা শহর শীর্ষ এক দূষণের নগরীতে পরিণত গয়েছে। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-এর তথ্যানুযায়ী, এখানকার বায়ুদূষণ উদ্বেগজনক রূপ নিয়েছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকা বিশ্বের দূষিত বায়ুর শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ধূলিকণা। নগরবাসীর ওপর ধুলার বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বাতাসে অতিমাত্রায় ধুলার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শহরের গাছগাছালিও। গাছের পাতায় জমছে ধুলার আস্তরণ। এতে করে গাছের খাদ্য ও অক্সিজেন তৈরির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, পাতার পত্ররন্ধ্র ও সূর্যের আলোর মাঝখানে ধূলিকণার আস্তর প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। ফলে কার্বন ডাই–অক্সাইড গ্রহণ করতেও বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে গাছ।
বিষাক্ত এক নগরীর নাম ঢাকা, যানজট, বায়ু দূষণ, আবর্জনার স্তূপ, শব্দ দূষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, হত্যা, ছিনতাই, ধর্ষণ, তার উপর এখন আবার নির্বাচনী প্রচারণার জন্য পোস্টার লাগিয়ে জীবন যাত্রার মান খাদ থেকে আরো খাদে নামিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ যখন ‘যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু’ ইত্যাদি লিখেছিলেন, রূপকার্থেই লিখেছিলেন, বায়ুদূষণের কথা ভাবেন নাই। বায়ুদূষণের প্রকোপও তখন এমন ছিল না। অথচ কালক্রমে বায়ুদূষণ আমাদের জন্য ভয়াবহ বার্তা বয়ে আনছে। পুরো পৃথিবীর কাছে তা এক সাধারণ ও অভিন্ন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও তা আমাদের জন্য সবেচেয়ে মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে। বাতাসে বস্তুকণা এবং বিভিন্ন রাসায়নিকের আধিক্য কী ভাবে ফুসফুস মারফত শরীরের বিপুল ক্ষতি সাধন করে, বিভিন্ন মারাত্মক ব্যাধির প্রকোপ বাড়ায়, মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনে-এমন গবেষণালব্ধ তথ্য এখন প্রায়ই প্রকাশিত হয়। এই মর্মান্তিক সত্যও আজ আর কারও অজানা নয় যে, বায়ুদূষণের ফলে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুদের স্বাস্থ্য। অথচ এ ব্যাপারে আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি! আসলে তথ্য বা জ্ঞানের নয়, অভাব চেতনার। তার স্পষ্ট প্রমাণ—সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বিপুল প্রচার অভিযানে কথাসরিৎসাগর রচিত হচ্ছে, চিৎকারের ঠেলায় ব্রহ্মলোক অবধি প্রকম্পিত, কিন্তু পরিবেশ দূষণের কথা কেউ শুনবেন না, কারণ কেউ বলবেনও না। পরিবেশ, আক্ষরিক অর্থেই, অনাথ!
আমাদের হবু মেয়রগণ কী রাজধানীর বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, পরিবেশদূষণ, খাদ্যদূষণ, পানিদূষণসহ বিভিন্ন দূষণের বিরুদ্ধে সত্যিই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেবন? নিতে পারবেন? যারা নিজেরাই দূষণ সৃষ্টি করেছেন, তারা দূষণ বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন কোন নৈতিকতার জোরে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)