‘একই নদীতে দুইবার স্নান করা যায় না’- যোগাযোগবিদ্যার ‘প্রথমপাঠ’-এ গ্রিক দার্শনিক হিরাক্রিটাসের এই অমিয় বচনটি পড়ানো হয়। যোগাযোগবিদ্যার আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো আমিও ১৬ বছর আগে অর্নাস প্রথম বর্ষে ‘যোগাযোগের ধারণা’ কোর্সের ক্লাসে এক শিক্ষকের মুখে শুনেছিলাম উক্তিটি। একই নদীতে দুইবার স্নান করা যায় না? শুনে অবাক হয়েছিলাম ক্লাসের সবাই। ক্লাস নিচ্ছিলেন আমাদের রসিক ম্যাডাম, উক্তিটি বলে চুপ করেছিলেন। তাতে কিছুটা ক্লাইমেক্স এসেছিলো বটে ক্লাসরুমে। আমি কিছুটা অবাক, এত এত মানুষ নদীমাতৃক বাংলাদেশে হররোজ গোসল করছে, তাহলে একই নদীতে দুইবার গোসল করা যাবে না কেন?
যোগাযোগের নিরবচ্ছিন্ন সজীব প্রবাহমানতা বোঝাতে ম্যাডাম আমাদের পড়িয়েছিলেন হিরাক্রিটাসের সেই উক্তি। অর্থাৎ, নদীর সঞ্চরণশীল প্রবাহমান জল অ-স্থির; যে পানিতে আমি ডুব দিলাম, একটু পর আবার ডুব দিলে ওই একই পানি আমি পাবো না। কারণ, নদীর পানি গতিশীল! প্রবাহমান নদীর মতো যোগাযোগও যে একটি নিরন্তর গতিশীল প্রক্রিয়া, সেটিই ছিলো আমাদের সেদিনকার শ্রেণীকক্ষের শিক্ষা।
পোস্ট-করোনা নিউ নরমাল লাইফের প্রবেশমুখে ১৬ বছর আগের ক্লাস লেকচারটির কথা মনে পড়লো। গবেষকরা বলছেন, করোনার পর বদলে যাওয়া পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই হবে, যা আগে হয়নি। শত সাধনা করেও আমরা এখন বিগত অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর মাসের আমেজকে আনতে পারবো না। সর্বনাশা করোনা চীনের উহান থেকে যে বিশ্বায়নের যাত্রা শুরু করেছে নারদমুণির মতো, তাতে সে সবাইকে বদলে যেতে বাধ্য করছে।
চট্টগ্রামের মতো জমজমাট শহরে শীত বিদায়ের ক্ষণে বসন্ত বিদায়ে বর্ষালগ্ন সমাগত কিন্তু মার্চ, এপ্রিল, মে ঘরবন্দি হয়ে থাকাটাই বড় শাস্তি। আজ থেকে ৭০ দিন আগে মাত্র ‘কটা দিনের জন্য ঘরে ঢুকেছিলাম’, অথচ লকডাউনে আটকে গেলাম। আমি পড়াই ইউনিভার্সিটিতে, শিক্ষার্থীদের সাথে হৈহল্লা, আড্ডা, গবেষণায় কাটে সময়। ফেব্রুয়ারির শেষে ব্যাকপ্যাকও গুছিয়ে রেখেছিলাম, হলিডে মুডে হই হই করে বেড়িয়ে আসবো কাছেপিঠে কোথাও। অথচ শ্রী শ্রী মা করোনাময়ীর কল্যাণে পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়াল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সত্তর দিনের গৃহবন্দীত্বের পর আজ শুনতে হচ্ছে নিউ নরমাল লাইফে এডজাস্ট করে নিতে হবে। এ যেন এরেঞ্জ ম্যারেজের মতো, প্রথম প্রথম কষ্ট হয়- পরে ঠিকই মানিয়ে নিয়ে কথিত সুখী জীবনযাপন করা। লকডাউনের শুরুর দিকে মনে হয়েছিল আমরা সবাই ঘরে থাকলে ও খুব করে নিয়ম পালন করলে করোনা ঘেঁষতে পারবে না কাছে। কিন্তু বিধি বাম। জনে জনে বিচ্ছিন্ন হতে পারলাম না, করোনা সংক্রমণের শৃঙ্খল ভাঙলো না, বরং আক্রান্তের গ্রাফ উর্ধ্বমুখি হলো। শুরু হলো অতিমারি। সংক্রমণের গ্রাফ ঊর্ধমুখী থাকা অবস্থায় কিছুটা হতাশায় শুনতে হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংশয়বাণী- এ বার ধীরে ধীরে অদৃশ্য এই শত্রুর সঙ্গে বসবাসের কৌশল শিখে নিন। যেমনভাবে ডেঙ্গু এবং এইডসের সঙ্গে মিলেমিশে আছেন, সে ভাবে।
ভাবছি আর অবাক হচ্ছি। কিভাবে সম্ভব বদলে যাওয়া? মনে মনে অভিশাপ দিই বসন্ত ঋতুকে। ওর মত বাজে একটা ঋতু কিভাবে ঋতুরাজ হলো, সেটাই ভাবছি। গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার হতে সময় লেগেছে ১৮৪ বছর। করোনার টিকা কত বছর সময় নেবে ‘খোদা’ ছাড়া কেউই জানে না। যে ‘বসন্ত’ বাতাসে বাতাসে অণুজীব ছড়ায়, সেই বসন্তের মাঝে ভালোবাসা খুঁজে পাওয়া একধরনের বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। এবারের বসন্তও আমার/আমাদের জন্য একটা দগদগে ঘা ছাড়া কিছুই নয়! আজ থেকে দশ বছর আগে স্বচক্ষে দেখেছিলাম ইউরোপের বসন্ত। তুষারপাত শেষে স্নিগ্ধ একটি রোদেলা বেলা শুরু হলো, চারপাশের উদ্ভাসিত টিউলিপ ফুটলো। চারপাশ মাতলো বসন্তকে নিয়ে। আর আমাদের বাংলাদেশের জলবায়ুতে বসন্ত মানে আতঙ্ক। বায়ুবাহিত রোগের প্রকোপ! যে বসন্তে পাতাঝরা বৃক্ষরা নিঃসঙ্গ হয়। আর তাকে আমরা বলি, ঋতুরাজ! এ কেমন উল্টা কথা? রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে/ একটুকু কথা শুনি/ তাই দিয়ে মনে মনে/ রচি মম ফাল্গুনি’। অথচ বসন্তেই আমাদের দেশে ছোঁয়াচে রোগের প্রকোপ বাড়ে। এমনকি এবারও করোনাভাইরাস এসেছে বসন্ত বাতাসে, ফলে পোস্ট করোনা নিউ নরমাল লাইফে এই গানটি খারিজ হয়ে যাচ্ছে। তাই, বসন্ত নয়, বর্ষাই হোক ঋতুরাজ! কারণ, বসন্ত কেবল রোগ ডেকে আনতে জানে। আর বর্ষা জানে কিভাবে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে হয়; এমনকি ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর শান্তনা হিসেবে কিছুটা উর্বরা পলি সে রেখে যায় বীজ বুনতে!
বর্ষা হলো এমন এক ঋতু যা আপনাকে বলবে, যে যত দ্রুত “নিউ নরমাল” এর সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে সেই টিকে যাবে। সেক্ষেত্রে ছাতা, রেইনকোট, ছাদ যেকোনো কিছু দিয়েই আপনি এডজাস্টমেন্ট করতে পারছেন! করোনাক্রান্তির পর পৃথিবীতে অনেক কিছুই আগের মত থাকবে না, বদলাতে আমাদের হবেই। বর্ষায় যেভাবে ঘনঘন পোশাক বদলাই, সেভাবেই বদলে যেতে হবে এখন। পোস্ট করোনা নিউ নরমাল লাইফের দিকে ইঙ্গিত করেই বোধহয় মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি বলেছিলেন, “গতকাল আমি চালাক ছিলাম তাই পৃথিবীটাকে বদলাতে চাইতাম, আজ বুদ্ধিমান হয়েছি তাই নিজেকে বদলাতে চাই’’। আর দার্শনিক কার্ল মার্কস তো বলেছেনই, ‘পৃথিবীতে নানা দার্শনিক নানাভাবে এ সমাজকে ব্যাখ্যা করেছেন। এখন দরকার সমাজটাকে বদলানো’! তাই ভাবছি বদলে যাওয়া এই সময়ে এখন নতুন দেয়াললিখন লেখার ভাষা এসেছে- ‘দিন বদলের বইছে হাওয়া, নিউ নরমাল-ই প্রথম চাওয়া!’ করোনাক্রান্তির অভিশাপ নিয়ে ‘নিউ নরমাল’-এ ফিরতে না পারলে কিন্তু ভারী বিপদ। টিকে থাকার প্রশ্ন! এখন একমাত্র ‘নরমাল’ থাকতে পারবেন হয়তো তারাই, যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ‘নরমাল’-এ আগে থেকেই বসবাস করে আসছেন! হ্যাঁ, বদলে যেতেই হবে- কারণ, ‘একই নদীতে দুইবার স্নান করা যায় না’!
১৭ নভেম্বর থেকে ধরলে করোনাভাইরাসের বয়স দুইশ’ দিন সন্নিকটে প্রায়। আর কিছুদিন পরেই যার ডাবল সেঞ্চুরি মানবজাতিকে হয়তো আরো বিপর্যস্ত করবে। উহান সীমান্ত পেরিয়ে নারদমুণির মতো নয়া রোগের বিশ্বায়ন ঘটিয়ে চলছে এই ভাইরাস। কখন, কোথায়, কিভাবে বধ হবে এই করোনা, ভবিষ্যৎ বলে দিবে হয়তো। তবে ভবিষ্যৎ যাই হোক, বর্তমানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভবিষ্যত। বর্তমানে পৃথিবী বিপর্যস্ত করতে করোনা তার চরিত্র পাল্টিয়েছে। দেশে দেশে গিয়ে ভোল পাল্টিয়েছে। হিমশিম খাচ্ছে বিজ্ঞানীরা। করোনা ভাইরাস যদি বদলাতে পারে, তবে বদলাতে আপানাকে হবেই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)