কয়েকদিন ধরে ক্যাসপার নামটা ফেসবুকে তৈরি করেছিলো এক আলোড়ন। চার বছর বয়সী আদুরে চেহারার ছেলেটি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলো হাজারো দেশবাসীর। ট্রাভেলার কমিউনিটির ‘ছোট্ট ভূত’ ক্যাসপারকে সুস্থ করে তুলতে দেশের চিকিৎসকসহ দেশবাসীর চেষ্টার কোনো সীমা ছিলো না। কিন্তু সবার মন ভেঙ্গে, কাঁদিয়ে রোববার না ফেরার দেশে চলে গেলো মুহাম্মদ সাদমান ক্যাসপার।
ক্যাসপারের শোকে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ক্যাসপারের চেনা অচেনা সবাই প্রকাশ করছে তাদের মনের অভিব্যক্তি। তেমনি ক্যাসপার হারিয়ে যাওয়ায় মনের গভীর বেদনার কথা তুলে ধরেছেন এক বাবা। সিলেট টুডে ২৪.কমের প্রধান সম্পাদক কবির য়াহমদ তার ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তার অনুভূতি:
আমি এক বাবা বলে কি বাচ্চাদের প্রতি আকর্ষণটা একটু বেশি, জানি না! বাবা বলেই কিনা ক্যাসপারের মুখ যতবার দেখি ততবার আমার ছেলের মুখ ভেসে ওঠে। ক্যাসপার আর আমার ছেলে রাইআনের বয়সের ব্যবধান তিন বছর, অথচ এ কয়েক দিন থেকে মনে হচ্ছে দুজনই সমবয়েসী।
ক্যাসপারের আপডেট পাচ্ছিলাম ফেসবুক থেকে। বারবার আশায় বুক বাঁধছিলাম ফিরে এলো বলে। অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার সংবাদে বিশাল এক ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম চিকিৎসাবিজ্ঞানকে। কিন্তু এরপর মাত্র ঘন্টা কয়েক সময়, ক্যাসপার চলে গেল!
ক্যাসপারের মৃত্যু সংবাদ যখন নিউজফিডে আসল তখন ধুঁক করে কেঁপে ওঠল বুক। ভাবিনি এমন উচ্ছ্বল, প্রাণবেগে ভরপুর, বেঁচে ওঠার আকুতিভরা মুখ নিয়ে এ ছেলে মরতে পারে। একটা আপডেটে বিশ্বাস হচ্ছিল না, কেউ ভুল করছে না ত অথবা আমি ভুল দেখছি না ত? পরে নিশ্চিত হলাম আরও কিছু আপডেটে। বুকের মধ্যকার ধুকপুকানি বেড়ে গেল। মনে হলো কত আপন কাউকে হারিয়েছি।
ক্যাসপার আমার আপন ছিল কি কেউ, ক্যাসপারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল কি, ক্যাসপারের পরিবারকে আমি জানতাম নাকি? এর সরাসরি উত্তর হয়ত না, কিন্তু তারপর মনে হয় গত ক’দিনে আমি তাকে আপন করে নিয়েছি। চেহারা দেখে, মুখ দেখে, আর তার কষ্টের কথা জেনে নিজে কষ্ট পেয়েছি; ভেবেছি আমার ছেলে রাইআনের মত তাকে।
ক্যাসপারের এ চলে যাওয়া আমার পিতৃত্বকে জাগিয়ে দিয়েছে, ছেলেকে স্মরণ করিয়েছে ফের। ছেলে বাড়ি নাই, নানাবাড়ি বেড়াতে। কষ্টের তীব্রতায় বউকে ফোন দিলাম, ফোন ধরল না। দ্বিতীয়বারের মত চেষ্টায় ধরল। প্রথম ও একমাত্র জিজ্ঞাসা রাইআন কই? এরপর তেরো মাস বয়েসী ছেলের কানে মোবাইল দিতে বললাম, বাবা-বাবা, আব্বু-আব্বু, আব্বা-আব্বা করলাম কতক্ষণ। এটুকু ছেলে কী দেবে প্রত্যুত্তর? তবু তার মত করে জবাব দিলো! বুকের মধ্য থেকে একটা পাথর সরল। আবার ফিরলাম ক্যাসপারে।
সাদমান ক্যাসপার, যাকে অনেকে ফেসবুকে ‘ছোট্ট ভূত’ নামে ডাকত। অনেক আগের দেখা এক কার্টুন চরিত্রের সে ক্যাসপারের মত মনে হতো তাকেও। মনে হতো কার্টুন চরিত্রের সে ক্যাসপারের মত সাদমান ক্যাসপারও সবার বন্ধু হতে চেয়েছিল। হয়েছিলও ধারণা করি- কারণ তার অসুস্থতাকালিন সময়ে সোশ্যাল সাইটগুলোতে যে হাহাকার দেখেছি এটা আগে আর কখনও কারও ক্ষেত্রে হয়েছে কিনা জানি না। মনে হয়েছিল একটা রেকর্ড বুঝি করতে যাচ্ছে সাদমান ক্যাসপার। ভালোবাসা পরিমাপের কোন স্কেল নাই বলে আসলে পরিমাপ করার সাধ্য নাই অনলাইন-অফলাইনে কত মানুষ কীভাবে তাকে ভালোবেসেছিল।
সোশ্যাল সাইট মারফত জেনেছি ক্যাসপারের বাবা ট্রেকার। ঘুরে বেড়ানো তার শখ, ঘুরেছেন দেশের এখানেওখানে। তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। আমি নিজে ঘোরাঘুরির কোন দলের সদস্য নই বলে জানা নাই উনাদের কথা। তবে গত ক’দিনে ছেলেকে দিয়ে বাবাকে চিনেছি। চার বছরের ছোট্ট এক ছেলে তার পরিচিত বাবাকে চেনাচ্ছে মানুষের কাছে যেখানে বাবাও অনেক পরিচিত তার মহলে। অসাধারণ এ অর্জন ছোট্ট ক্যাসপারের জন্যে।
অনলাইনের মাধ্যমে আরও জেনেছি ক্যাসপারের ইচ্ছা ছিল বড় হলে বাবার মতো ট্রেকার হবে। ডিসকভারি চ্যানেলে প্রদর্শিত বিয়ার গ্রেইলে মতো হতে চাইত সে। বিয়ার গ্রেইলের মতোও হতে পারে, ওই শো’টার সবগুলো পর্ব ক্যাসপারের মুখস্ত তার। তাই সে নিজের কাজ এখন থেকেই নিজে করে। এটুকু একটা ছেলে এই বয়সে এত কিছু বুঝে, হায় প্রকৃতি বুঝল না তাকে। তাই অকালে ফিরিয়ে নিলো, সব আশা অপূর্ণ রেখে।
ফেসবুকে ঘুরছে ক্যাসপারের ছবিগুলো। দৌড়াচ্ছে ক্যাসপার, হাঁটছে ক্যাসপার, অচেনা এক রেলস্টেশনে বাবার পাশে শুয়ে আছে ক্যাসপার, ভেঙচি কাটছে ক্যাসপার, সাইকেলে ক্যাসপার, পেছনে পাহাড়, পাশে নদী, জঙ্গল সবখানে ক্যাসপার তার মত করে- আহ, আহা! এত এত দৃশ্য, সবখানে তার মত করে ক্যাসপার- এতকিছু দেখে আর নিজেকে সংবরণ করা যায় না, যায় কি?
আমার সঙ্গে রক্তের কোন বন্ধন নেই তার। তার চলে যাওয়াতে কেন এত আবেগাপ্লুত আমি- জানি না। শুধু জানি সাদমান ক্যাসপার নামের যে ‘ছোট্ট ভূত’ ছিল সে চলে গেছে, কিন্তু যাওয়ার আগে আমাদের আত্মা মাঝে কোমল এক ছোঁয়া দিয়ে গেছে। সে ছোঁয়াতে ভালোবাসা ছিল, আমরা ভালোবাসার জন্যে ব্যথিত হচ্ছি, হবো!
এত মায়া, এত মায়া, এত মায়া কেন মানুষের জন্যে? ক্যাসপার, ক্যাসপার, ক্যাসপার- তুই সত্যি সত্যি টনের্ডোরূপ এক হাহাকার! ভালো থাকিস বাবা!