বাংলাদেশের ছড়াকাররা আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন এটা নতুন করে বলার কিছু নয়। সব বয়সী ছড়াকারের ঈর্ষণীয় প্রীতি ও ভালোবাসাধন্য আমি। এক জীবনে এ এক পরম পাওয়া। কিন্তু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়- কে আমাকে সবচে বেশি ভালোবাসেন তাহলে তার উত্তরে চট করে যে নামটা এক লাফে সবার সামনে এসে দাঁড়াবে সেই নামটা ‘নাসের মাহমুদ’। একটু আগে আমাকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে আমার পরম মিত্র পরম বন্ধু নাসের মাহমুদ চলে গেলেন! কোথায় গেলেন? যেখান থেকে কেউ কখনো ফিরে আসেন না।
ঘুম থেকে উঠেই মোবাইল স্ক্রিনে দেখি মানিক রহমানের মিস কল এবং মেসেজ- ‘নাসের ভাই মারা গেছেন’।
এলোমেলো হয়ে গেলো আমার সকালটা।
ঝাপসা চোখের দৃষ্টির সামনে একসঙ্গে হামলে পড়লো অজস্র স্মৃতির রেণুকণাগুলো।
আমি পেছনে তাকাই।
ফিরে যাই ২০০৮ এ।
২১ ফেব্রুয়ারি সকাল সাতটায় ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। এতো সকালে কেউ আমাকে কল করে না সাধারণত। ঘুম ঘুম আবেশে স্ক্রিনে নাম না দেখেই জড়ানো কণ্ঠে বলি- হ্যালো। ওপাশ থেকে আবেগে কাঁপতে থাকা একটা কণ্ঠস্বর- রিটন রিটন…। আমি বললাম- জ্বি বলছি। ওপাশে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। আমি জিজ্ঞেস করলাম- কে বলছেন আপনি? কাঁদছেন কেনো? কী হয়েছে?
কান্নার দমক ঠেলে ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা বাক্য- কাঁদছি আনন্দে।
একটু বিরতি দিয়ে বললেন- আপনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। পত্রিকায় নিউজটা দেখেই ঘুমিয়ে আছেন জেনেও ফোন করে ফেলেছি। সরি ভাই। ক্ষমা করবেন। অভিনন্দন আপনাকে। আমি নাসের। আপনি ঘুমান।
তিনি ফোন রেখে দিতে চান। আমি বাঁধা দিই- না নাসের ভাই। আপনার মতো একজন ভালো মানুষের ফোন কলে আমার সকাল শুরু হলো। দিনটা শুভ না হয়ে যাবে কোথায়?
এতোক্ষণ পর হাসি ফুটে উঠলো নাসের মাহমুদের কণ্ঠে- রিটন, আপনি বাংলা একাডেমি পেয়েছেন আর এদিকে আমার মনে হচ্ছে আমিই বুঝি বাংলা একাডেমি পেয়ে গেছি। এমন কেনো হলো?
– আপনি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন সেই কারণে এমনটা মনে হয়েছে।
– আপনাকে ভালো না বেসে উপায় আছে? আমি ছড়া লিখি আপনার কারণে।
– মানে? সে কী কথা?
– হ্যাঁ রিটন। আপনার ছড়া দেখে দেখে আপনার ছড়া পড়ে পড়ে কতো যে প্রেরণা পাই সেটা কোনোদিন বলা হয়নি। আপনি না লিখলে আমি হয়তো অনেক আগেই ছেড়ে দিতাম ছড়া লেখা।
– সে কী!
– হ্যাঁ রিটন। আপনি জানেন না। আপনি কতোটা প্রেরণা হয়ে আছেন।
২
ছড়া একাডেমি নামের প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ছয় ছড়াকারের (ফয়েজ আহমদ, এখলাসউদ্দিন আহমদ, সুকুমার বড়ুয়া, আবু সালেহ, লুৎফর রহমান রিটন এবং আমীরুল ইসলাম) সংবর্ধনা এবং নৈশভোজের আয়োজন করেছিলো। নৈশভোজে মনের আনন্দে কাচ্চি খাচ্চি। আমার ডানপাশের চেয়ারেই নাসের মাহমুদ। খাওয়া চলমান। এক পর্যায়ে নাসের মাহমুদ আমার প্লেটে থাকা লোভনীয় একটুকরো মাংসের দিকে হাত বাড়িয়ে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন- এটা নেই?
– আরে ন্যান ন্যান নাসের ভাই। আপনাকে আরেক প্লেট দিতে বলি?
– আরে নাহ্ আরেক প্লেট লাগবে না। আমার তো লাগবে রিটনের আধ খাওয়া মাংসের এই টুকরোটাই। রিটনেরটাই আমি ভাগাভাগি করে খাই…
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো তখনও। আমার প্রিয় কাচ্চি বিরিয়ানির পোড়া পোড়া আলু আর সিনার মাংস আর আলুবোখারার চেহারাটাও কেমন ক্লাউডি বা মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিলো। বিরিয়ানির গন্ধে মৌ মৌ মাতোয়ারা সেই কক্ষে হঠাৎ যেনো বা ঢুকে পড়েছিলো একদল কুয়াশা। আমার বন্ধু নাসের মাহমুদের মুখটাও হয়ে উঠেছিলো চশমার কাচে বৃষ্টির ছাট পড়া আবছা দৃষ্টির অচেনা মানুষের মুখ।
সেই সন্ধ্যার মতো এই যে এখন লিখতে বসেছি, আবারো ওরকম ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। এরমকম ভালোবাসা দেবার মানুষটা পৃথিবীতে আর নেই কথাটা ভাবতেই বুকটা কেমন ভারী হয়ে ওঠে! নাসের ভাই, কী হতো আর ক’টা দিন থেকে গেলে!
জানি খুবই কষ্টে ছিলেন। কিন্তু তারপরেও বেঁচে তো ছিলেন! খুব কাছের মানুষের ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত হয়েছি যখন, তখন তো আপনিই ছিলেন নেপথ্যসাহস- রিটন আপনারই জয় হবে দেখবেন। হায়, এখন আমি আর কার কাছে যাবো?
কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে গিয়ে মাংসের টুকরোয় কামড় বসাতে গেলেই তো ভেসে উঠবে আপনার মুখটা প্রিয় নাসের মাহমুদ!
৩
শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে ‘বাংলার মুখ’ নামে একটা বইয়ের দোকান ছিলো নাসের মাহমুদের। বিক্রিটিক্রি কিছুই হতো না সেই দোকানে। সারাদিন খালি আড্ডাই হতো ওখানে। বিশেষ করে বিকেল হলেই ওখানে বসতো বিরাট মজমা। কানাডা থেকে ঢাকায় গেলে নাসেরের দাবি ছিলো- কয়েকটা বিকেল আমাদের দেবেন না রিটন!
আমি যেতাম। প্রায়ই যেতাম। ওখানে গিয়ে দেখতাম তাকে ঘিরে অজস্র ছড়াবন্ধু। নানান বয়সী। লোকজন আসছে। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে বসছে। চা-সিঙ্গারা-ডালপুরি খাচ্ছে। একদিন আমি খুব মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলাম- এই যে অবিরাম চা-সিঙ্গারা আর ডালপুরির যোগান সেটা নাসেরের পকেট থেকেই হচ্ছে। আমি আপত্তি জানিয়ে শরিক হতে থাকলাম। নিয়ম বেঁধে দিলাম- যেদিন আমি থাকবো আড্ডায় সেদিন চা-ডালপুরির সমস্ত খরচ আমার। আপত্তি সত্বেও নাসের সেটা মেনে নিতে বাধ্য হতেন।
একদিন দেখলাম আমাকে বারান্দায় দেখা মাত্রই প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি নিচতলায় চা-ডালপুরির টাকাসহ। এরপর থেকে আমি আজিজে ঢোকার মুখেই বড় ঠোঙাভর্তি পর্যাপ্ত ডালপুরি হস্তগত করে তারপর ফোন করতাম তাকে-নাসের ভাই পাবলিক ধইরা রাখেন। কেউরে যাইতে দিয়েন না। আইতছি ডাইলপুরি লইয়া।
আমাকে ডালপুরির ঠোঙা হাতে দেখে কী মিষ্টি হাসিতে যে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতেন নাসের মাহমুদ! একদিন নিরালায় আমাকে বলেছিলেন- কী সুন্দর করে কতো আনন্দের মাধ্যমে আপনি খাওয়াতে চান আমাদের সবাইকে। কিন্তু টাকার গরম দেখান না কোনোদিন। অথচ আমাদের কেউ কেউ আড্ডায় এসে খুব অশ্লীল ভঙ্গিতে টাকা ছুঁড়ে দিয়ে জোর করে শামিল হন। আমরা যে অপমানিত হচ্ছি সেদিকে খেয়ালই করেন না। আপনি জানেন না আপনি কতো ভালো। এই ভালোমানুষ রিটনকেই আমরা ভালোবাসি।
অতুলনীয় ভালো মানুষ ছিলেন নাসের মাহমুদ। আর তাই অন্যের মাঝেও ভালো মানুষকে খুঁজে পেতে চাইতেন।
৪
নাসের ভাই ভীষণ রকম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মাঝখানে এক বছর আমি ঢাকায় বইমেলায় যাইনি। কিন্তু মানিকের কল্যাণে আমি নিয়মিত খবর পাচ্ছিলাম বন্ধু নাসেরের। একদিন মানিক বললো- রিটন ভাই আপনার বন্ধু নাসের মাহমুদ কী রকম শিশুর মতো হয়ে উঠেছেন। রাতদিন শুধু খেলেন মোবাইল ফোন নিয়ে। বাচ্চাদের মতো।
আরেকদিন মানিক বললো- রিটন ভাই আপনার বন্ধু এখন আর কথা বলেন না। শুধু তাকিয়ে থাকেন। কাউকে চিনতেও পারেন না।
আরেকদিন বললো- রিটন ভাই আমার মোবাইল স্ক্রিনে আপনার ছবি দেখিয়েছি নাসের ভাইকে। আপনার ছবি দেখে কী রকম হেসে উঠলেন নাসের ভাই। জিজ্ঞেস করেছি আপনি চেনেন এই মানুষটাকে? নাসের ভাই মাথা ঝাঁকিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন- হ্যাঁ চিনি।
কানাডা থেকে একদিন মানিককে বললাম- নাসের ভাইকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। তুমি তার বাসায় গেলে আমাকে একটা কল দিও। ভিডিও কল। আমি তাকে একটু দেখতে চাই।
মানিক কল দিলো। আমি নাসের ভাইকে দেখে চিৎকার করে উঠলাম খুশিতে। জবাবে নাসের ভাই খুব মিষ্টি করে হাসলেন আমার দিকে তাকিয়ে। কিন্তু কোনো কথা বললেন না। কারণ কথা তিনি বলতে পারেন না।
মানিক জানালো পারকিনসন্স-এ আক্রান্ত হয়েছেন নাসের মাহমুদ। কখনো কখনো কাউকে কাউকে চেনেন। কখনো কখনো চেনেন না। নড়াচড়া চলাফেরা সব বন্ধ।
এবার ঢাকায় গিয়ে মানিককে বললাম- আমাকে নিয়ে চলো নাসের মাহমুদের কাছে। এক দুপুরে মানিক আমাকে নিয়ে গেলো মোহাম্মদপুরে নাসের মাহমুদের এপার্টমেন্টে।
আমি ড্রয়িং রুমে বসে আছি। বেড রুমে বিছানায় শুয়ে ছিলেন নাসের মাহমুদ। আমার কথা বলা হলো তাকে। অস্থির চঞ্চল হয়ে উঠলেন তিনি। তার স্ত্রী তাঁকে শোয়া থেকে বিছানায় বসালেন। আমি পায়ে পায়ে তার কাছে গেলাম। আমাকে দেখেই কী রকম আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন নাসের ভাই। আমি হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। তিনি আমার দিকে ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। তারপর কেঁদে ফেললেন। সেই কান্না সংক্রমিত হলো আমার মধ্যেও। দু’জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের কান্নার দৃশ্য মোটেই শোভন নয়। দ্রুত নিজেকে সম্বরণ করলাম। মুগ্ধচোখে তিনি শুধু তাকিয়ে থাকেন আমার মুখের দিকে। এতো খুশি তিনি নাকি হননি বহুদিন।
একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাকে নিয়ে আসা হলো ড্রয়িং রুমে। এই জায়গাটা অনেক বেশি খোলামেলা। আমার সামনে হুইল চেয়ারে নাসের মাহমুদ। লাগোয়া একটা সোফায় বসে আমি তার সঙ্গে অবিরাম কথা বলে যাচ্ছি একতরফা। বলছি ছড়ার কথা। আজিজ মার্কেটের কথা। বাংলার মুখের কথা। চা-সিঙ্গারা আর ডালপুরির কথা। আমার কথাগুলো তাকে খুব আনন্দ দিচ্ছিলো। চোখের তারা নেচে উঠছিলো তার, বারবার। বললাম-দ্রুত সুস্থ হন মিয়া। আজিজ মার্কেটে আবার ডালপুরির আসর বসাইতে হবে না!
এই পর্যায়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন নাসের ভাই। আমি ওঠে গিয়ে তার চোখের পানি মুছে দিই। কিন্তু চোখ তার ভিজে ওঠে আবারও। মানিক উঠে গিয়ে টিস্যু পেপার দিয়ে মুছে দেয় অগ্রজের চোখ। তার ঘামে ভেজা গাল। ঘামে ভেজা কপাল।
আমি মানিককে দেখি। এই মানিকের কাছেই জেনেছিলাম আমি- খুব ছেলেবেলায় বাবাকে হারিয়েছে ওরা। বাবাহীন ওদের সবক’টা ভাইবোনের বাবার দায়িত্ব পালন করেছেন এই নাসের মাহমুদ।
আমাদের উঠতে হবে।
আমি বিদায় নিই নাসের মাহমুদের কাছ থেকে- ওস্তাদ যাইগা। ভালো থাইকেন। জয় বাংলা।
আমার কণ্ঠে জয় বাংলা শুনে কী রকম অস্থির হয়ে উঠলেন নাসের মাহমুদ। তার বাম পা সেলাই মেশিনের সূঁচের মতো দ্রুত উঠানামা করছে। দুই হাতে শক্ত করে হুইল চেয়ারের হাতল চেপে ধরে অশ্রু ভরা টলটলে চোখে ঘামে ভেজা মুখ আর কপালে অজস্র এলোমেলো বলিরেখা এবং শিরা-উপশিরা উজিয়ে ভীষণ জড়ানো কণ্ঠে অনেক কষ্টে তিনি উচ্চারণ করলেন- জ্জজ্জজ্জজ্জজজজজজয় বাংলা!
মানিক অবাক হয়ে গেলো- রিটন ভাই শুনলেন জয় বাংলা বললো তো নাসের ভাই!
জয় বাংলা বলা নাসের ভাইয়ের সেই ঘামজর্জর মুখটা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না।
গুডবাই ছড়াবন্ধু।
ছবি: মানিক রহমান।