জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নারী’ কবিতায় লিখে গিয়েছিলেন: সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মূল প্রতিপাদ্য সবার জন্য সমতা। আর নারী দিবসের হ্যাশট্যাগ ‘ইচ ফর ইক্যুয়াল’। নারীর অধিকার সংরক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ‘পাওয়ার অব শি’ কাজ করে যাচ্ছে।
‘পাওয়ার অব শি’র প্রজেক্ট প্রধান হিসেবে কাজ করছেন গণমাধ্যমকর্মী সাবিনা স্যাবি। বর্তমানে তিনি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস্ (বিইউপি)-এ প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সহ ‘পাওয়ার অব শি’র কার্যক্রম নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবিনা স্যাবি।
দেশ ও সমাজের জন্য প্রয়োজন নারী পুরুষের সমতা
সাবিনা স্যাবি বলেন: আন্তর্জাতিক নারী দিবসে নারী দিবসে পাওয়ার অব শি’র একটাই বার্তা, আর তা হলো- নারী পুরুষের সমতা প্রয়োজন। কারণ আমাদের ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি)’ বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় লিঙ্গ সমতার বিষয়টি আছে, যা আমাদের পূরণ করতে হবে। নারী পুরুষের সমতা এখন দেশ ও সমাজের জন্য প্রয়োজন।
আজকের উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখতে পাই, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নারীরাও সমানতালে কাজ করছেন। নারী-পুরুষের সমতায় আমরাই শুধু পিছিয়ে আছি। তবে অনেক ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়নে সব সেক্টরেই দক্ষতা বাড়াতে হবে
বর্তমান ডিজিটাল যুগে সব সেক্টরেই নারীদের সমান অংশগ্রহণ থাকতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা একটা ধারায় কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমরা সিটি আলোর সঙ্গে ‘উইমেন এম্পাওয়ারমেন্ট মিট’ আয়োজন করি যেখানে এসিড সারভাইভারস, প্রতিবন্ধী ও তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের তৈরি করা পণ্য নিয়ে মেলার আয়োজন করি।
‘এ সময় আমরা অন্যান্য নারী উদ্যোক্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করে দেখেছি যে নারী অনলাইনে পোশাক বিক্রি করছে সে শুধু সেটা নিয়েই ব্যস্ত আছে। কিন্তু আরো যে সেক্টর রয়েছে সেটা কিন্তু তার অজানাই রয়েছে। সব সেক্টরে যদি নারীরা যায় তাহলেই সুযোগ সৃষ্টি হবে। লক্ষ্য করা যায়, আমাদের তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে শতকরা ৫ শতাংশের বেশি নারী নেই।’
সাবিনা বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীকে সব সেক্টরে নিজের দক্ষতা অর্জন বাড়াতে হবে। সেজন্য চাই নিজের অদম্য ইচ্ছা শক্তি। সেই সাথে নিশ্চিত নিরাপত্তা এবং পরিবার এবং সমাজের সহযোগিতা। আমাদের দেশে কর্মস্থলে শীর্ষ পর্যায়ে নারীরা আছে কিন্তু বলতে গেলে অনেক কম। রাজনৈতিক দলগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি সেক্টরে মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীর অংশগ্রহণ খুবই কম। বাংলাদেশের ট্রান্সপোর্ট সেক্টরে কোনো নারী মালিক নেই, তাহলে নারী বান্ধব ট্রান্সপোর্ট কিভাবে হবে?
মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু
সাবিনা স্যাবি বলেন, মেয়েরা নিজেদের একটা জায়গায় বন্দি করে রাখতে পছন্দ করে, আবার মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু। যে কর্মস্থলে নারীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তারা তাদের অধঃস্তন কর্মীদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেন না। আবার অনেক মেয়ের মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব রয়েছে। এগুলো একটা মেয়ের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই জায়গাগুলো যদি আমরা ভেঙে দিতে পারি, তাদের বোঝাতে পারি তাহলে মেয়েরা আরও বেশি এগিয়ে যাবে।
নারী স্বাস্থ্য গুরুত্ব দিচ্ছে ‘পাওয়ার অব শি’
বর্তমানে নারীর স্বাস্থ্যের বিষয়টা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে ‘পাওয়ার অব শি’। সংগঠনটির প্রজেক্ট প্রধান বলেন: নারীর পিরিয়ডকালীন সুস্থতাকে আমরা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ওই সময় যদি সঠিক সুস্থতা তারা না পায় তাহলে দীর্ঘমেয়াদী নানান ধরণের অসুস্থতার মধ্যে পড়ে।
আমাদের দেশে যদি আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের কথা ধরি, এরমধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি মেয়ে। কিছু গার্মেন্টস আছে যারা নারী শ্রমিকদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ গার্মেন্টসে এ ব্যবস্থা নেই। নারী শ্রমিকরা এখনো কাপড় ব্যবহার করছে ফলে তারা অসুস্থতায় ভুগছে। এবং গার্মেন্টসও প্রোডাকশন কমে গিয়ে গার্মেন্টসও ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে।
তিনি জানান: আমরা নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে এখনো পিছিয়ে আছি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যখন আমরা নারীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের কথা বলতে চেয়েছি অনেকেই লজ্জায় মুখ ঢাকে। এসব পরিস্থিতির থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এজন্য আমরা বেশকিছু ক্যাম্পেইন প্রোগ্রাম করেছি। যার মাধ্যমে আমরা তাদের সচেতন করতে পেরেছি।
ক্যাম্পেইন হ্যাশট্যাগ ‘হ্যাপি পিরিয়ড’ এর মাধ্যমে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, গার্মেন্টসে হ্যাপি পিরিয়ড নামে প্রোগ্রামের আয়োজন করেছে। এই সচেতনতামূলক প্রোগ্রামের মাধ্যমে মেয়েদের ঋতুকালীন সচেতনতা বাড়ানো হয়।
জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী নারীদের প্লাটফর্ম ‘পাওয়ার অব শি’
যেসব নারীরা নানা প্রকার প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে স্বপ্ন দেখছেন, দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে লক্ষ্যে স্থির থাকতে চান, তাদেরকে আমরা অনুপ্রেরণা দেওয়ার কাজটি করছে ‘পাওয়ার অব শি’।
নারীরা যেন তাদের স্বপ্নের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে সেজন্য বিভিন্ন গাইডলাইন এবং বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ফেসবুকে লাইভে যায় সংগঠনটি। লাইভে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা তখন নারীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন গাইডলাইন দিয়ে থাকেন।
সাবিনা স্যাবি বললেন: আমরা নারীদের সামজিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতেও বিভিন্ন ক্যাম্পেইন করেছি। হ্যাশট্যাগ সেনো করা হয়েছিল মেয়েরা ঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। সেজন্য সারা জীবনের জন্য তাকে ভুক্তভোগী হয়ে থাকতে হয়। ভুলের মাশুল তো সারা জীবনই তে হয়। আমরা সংগঠন থেকে গবেষণা করে দেখেছি মেয়েদের বাল্য বিবাহে না বলা উচিত, যে কোন প্রকার সাইবার ব্লাকমেইলিং, পারিবারিক নির্যাতনকে না বলা উচিত।
পারস্পারিক সহযোগিতার জন্য ‘শি-ক্লাব’
বিভিন্ন পেশার নারীদের নিয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য পাওয়ার অব শি গড়ে তুলেছে শি ক্লাব। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য মূলত- সংগঠনের সব সদস্যদের পারস্পরিক প্রয়োজনে নানা পরামর্শ, সহযোগিতা করা। বিভিন্ন পেশার সরকারি কর্মকর্তা, ডাক্তার, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, নারী উদ্যোক্তাসহনারীরা নানা পেশার নারীরা যুক্ত আছেন শি-ক্লাবের সদস্য হিসেবে। বর্তমানে শি-ক্লাবের সদস্য ৫০০ জন।
সম্প্রতি আমরা ট্রাভেল আর্টের সঙ্গে একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি, যেখানে শি-ক্লাবের মেম্বাররা ভ্রমণে বেশ ছাড় পাবেন। এছাড়াও নারী ট্রাভেলারদের নিরাপদ ভ্রমণের নিশ্চয়তা, ভ্রমণ বিষয়ক যে কোন প্রকার সহযোগিতা তাদের কাছ থেকে আমরা পাব।
সুরক্ষিত স্বাস্থ্য উজ্জ্বল তারুণ্য
ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন: আমরা দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্যাড ব্যাংক করার বিষয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। সেখানে ফার্স্ট এইড বক্সের সাথে কয়েকটি স্যানিটারি ন্যাপকিনের প্যাকেট রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
মা ও সন্তানের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হন সাবিনা স্যাবি
পাওয়ার অব শি’র শুরুর গল্পটা জানতে চাইলে এক বাক্যে তিনি বললেন, নিজের মা ও সন্তানের কাছ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
সাবিনা স্যাবি জানান: আমার মেয়ে যখন থ্রিতে পড়ে তখন তার স্কুলে একটি ফ্যাশন শো’তে নাম দেয়। ফ্যাশন শো নিয়ে উচ্ছ্বাস আনন্দে ছিল সে। হঠাৎ একদিন মন খারাপ করে স্কুল থেকে বাসায় ফিরল। কিন্তু কারণ কিছুতেই বলবে না। কয়েকদিন পর অনেক কষ্টের পর মেয়ে বলল, ‘মা টিচার বলেছেন আমি আর আমার বান্ধবী কালো তাই আমরা বাদ। কালোদের দিয়ে নাকি ফ্যাশন শো হয় না।’
তিনি বলেন: আমি অনেক কেঁদেছিলাম কারণ এতো অল্প বয়সেই আমার মেয়ে বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিল। ছোটবেলায় আমার মাকেও দেখেছি অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে। মা বিহারের মেয়ে ছিল, বাবার সঙ্গে বিয়ের পর বাংলাদেশে এসেছে, আমাদের সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সব কিছুর সঙ্গে তার লড়তে হয়েছে। আমাদের লালন পালন করেছে। সব কিছুর মধ্যেই তার সংগ্রাম ছিল।
মেয়ের বৈষম্য আর মায়ের সংগ্রাম থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাওয়ার অব শি কার্যক্রম গ্রহণ করি, এমনটাই জানালেন সাবিনা স্যাবি।