২৫ নভেম্বর ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর দ্য এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন’ বা আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পর্যন্ত পৃথিবীর দেশে দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এ দিবস পালিত হবে। বাংলাদেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি নিয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারীর উপর যৌন নির্যাতন: প্রতিবাদ করুন, প্রতিরোধ গড়ুন।’
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকায় নারীদের এক সম্মেলনে ২৫ নভেম্বর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটিকে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং সমাজের উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তারপরও সাধারণভাবে তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকারের দিক দিয়ে এখনো পুরুষের সমকক্ষ নয়। অথচ এই নারীর কারণেই একটি সন্তান পৃথিবীর আলো দেখতে পায়, একটি সুন্দর জীবনের শুভ সুচনা হয়।
নারীদের জীবন আমাদের সমাজে বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত। অথচ নারী পুরুষ উভয়ই সমান অধিকারী। কিন্তু এই অধিকার নারীরা কতটুকু পায়? তারা জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে অধিকার থেকে বঞ্চিত। আইয়্যামে জাহেলিয়াত যুগে কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করা ছিলো লজ্জার বিষয়। ফলে লজ্জা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কন্যা সন্তানকে জীবিত কবর দিতে লজ্জাবোধ করতো না। হিন্দু ধর্মে যত তাড়াতাড়ি অর্থাৎ ১৬ বছরের পূর্বে বিয়ে দেয়াকে বলা হতো ‘গৌরী দান’।
আমাদের দেশে নারী নির্যাতন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ক্ষুধা, দারিদ্র, অপুষ্ঠি, অশিক্ষা, বেকার সমস্যা এই সকল সাধারণ সমস্যার পাশাপাশি নারীদের আরো কিছু মারাত্মক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এ নির্যাতনের কোনো শেষ নেই। এসিড সন্ত্রাস, ইভটিজিং, পারিবারিক সন্ত্রাস, যৌতুক, ধর্ষণ, ফতোয়া, গৃহ পরিচারিকা নির্যাতন এরকম আরো বহু নির্যাতনের কথা উল্লেখ করা যায়।
নারী নির্যাতনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রূপ হচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতন। এক গবেষনায় দেখা গেছে, প্রতি ৩ জন নারী’র ১ জন তার স্বামীর হাতে নির্যাতিত হয়। যে নারী ও পুরুষ জীবনে সুখী হওয়ার জন্য সংসার জীবন গড়ে তুলেছেন, তাদের কাছে এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত দুঃখজনক।
নারী নির্যাতনের যে ভয়াবহ রূপটি ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের ওপর মারাত্মক ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলে সেটি হচ্ছে শ্লীলতাহানী। দুঃখজনকভাবে গত কয়েক দশকে এই বিষয়টি পশ্চিমা দেশগুলোতে ভয়াবহ রকমভাবে বেড়ে গেছে। পাশ্চাত্যে প্রতি ৫ জন নারী’র ১ জন জীবনের কোন না কোন সময়ে ধর্ষণ বা ধর্ষণের হুমকির শিকার হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৩২ হাজার বলাৎকারের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে যারা ধর্ষণের খবর প্রকাশ করেন না, তা হিসেব করলে এর পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
এদিকে ধর্ষণের যে মারাত্মক ক্ষতিকর দিকটি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে দেখা যায়, তা হচ্ছে কথিত সম্মান রক্ষার জন্য নারী হত্যা। কখনো কখনো ধর্ষিত নারী’র বাবা, ভাই, স্বামী বা অন্যান্য নিকটাত্মীয় পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য ধর্ষিতাকে হত্যা করে। এক্ষেত্রে নারী ২ বার নির্যাতনের শিকার হয়। একবার অপরিচিতজনের কাছে নিজের সম্ভ্রম হারায়। এরপর পরিচিত জনদের হাতে জীবন বিসর্জন দেয়।
জাতিসংঘের এক হিসেব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর এ ধরনের কথিত সম্মান রক্ষার বলির শিকার হয় প্রায় ৫ হাজার নারী। নারী নির্যাতনের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তার লিঙ্গ নির্ধারণ। দুঃখজনকভাবে এই একবিংশ শতাব্দিতে এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যারা গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হলে তাকে মায়ের পেটের মধ্যেই মেরে ফেলতেও কুণ্ঠিত হয় না। একে জন্মের আগেই হত্যা বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কখনো কখনো জন্মের আগে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা না গেলে জন্মের সাথে সাথে শিশুকন্যাকে হত্যা করা হয়।
নারী নির্যাতনের এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়,বিশ্বের বিশেষ কোনো একটি দেশে নারীদের ওপর যেমন নির্যাতন চালানো হয় না, তেমনি এ নির্যাতনের ধরণও এক এক জায়গায় এক এক রকম। যেমন নারীদের সম্ভ্রমহানী ও তাদের যৌন ব্যবসায় বাধ্য করার ঘটনা পশ্চিমা দেশগুলোতে বেশী দেখা যায়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও অন্যায় সামাজিক প্রথার কারণে নারীরা বেশী নির্যাতনের শিকার হয়। এছাড়া নারীরা অনেক সময় সহিংস হামলার শিকার হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র বহনের অনুমতি থাকায় নারীদেরকে যত্রতত্র হত্যা করা হচ্ছে। রাশিয়া ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে অতিরিক্ত মাত্রায় মদ পান করার কারণে মাতাল স্বামীরা স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। আর বাংলাদেশে এখন ইভটিজিং একটি সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরই মধ্যে ইভটিজারদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে নাম জানা-না জানা বহু কিশোরী। শুধু তাই নয়, ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করায় অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে নাটোরের কলেজ শিক্ষক মিজানুর রহমানকে, মেয়ের জন্য প্রাণ হারাতে হয়েছে মা চাঁপা রানী ভৌমিককে, নাতনিকে ইভটিজিং করার প্রতিবাদ করায় প্রাণ দিতে হয়েছে নানাকে। আর আত্মহত্যার ঘটনা তো ঘটছেই। অন্যদিকে ইভটিজারদের দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে এ দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার তথ্য মতে,গত বছর ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছে ১৭৮ জন। ইভটিজিংয়ের কারণে ২৭ জন নারী এবং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১১ জন পুরুষ প্রাণ হারিয়েছে।
ইভটিজিং শুধু রাস্তা-ঘাটে বা স্কুল-কলেজেই সীমাবদ্ধ নয়,বিভিন্ন কায়দায় ইভটিজিং করা হচ্ছে। যেমন; মোবাইল ফোনে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে। অনেক তরুণীর ভিডিওচিত্র মোবাইলে ধারণ করে পরিবারের কাছে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। এসব পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে বেশিরভাগই দরিদ্র পরিবারের নারীরা।
মানবসভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে নারীর অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। লাখ লাখ বছর আগে গুহাবাসী নারী-পুরুষ যৌথ প্রচেষ্টায় যে জীবন শুরু করেছিল, তা ক্রমেই বিকশিত হয়ে আজকের সভ্যতার সৃষ্টি। নারী-পুরুষের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। তাই নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে না দেখে তার সঠিক মর্যাদা তাকে দিতে হবে। নারীর ওপর নির্যাতনের প্রভাব সমাজের সব ক্ষেত্রে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। তাই নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন ও সহিংসতা বন্ধ করতে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখতে হবে।
বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে সমাজ কাঠামো, বিকশিত হচ্ছে সভ্যতা। পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে মানুষের জীবনযাত্রায়। আধুনিক কালে নারীর ক্ষমতায়ন ঘটলেও নারী নির্যাতন বন্ধ হয় নি। দেশে আইনের সঠিক ব্যবহার এবং প্রয়োগ থাকলে এহেন নির্যাতন অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
আদিকাল থেকে নারীরা বৈষম্যের শিকলে বন্দি। শারীরিকভাবে দূর্বল হওয়াটাই কি এর পেছনের একমাত্র কারণ? নিশ্চয় তা নয়। সমাজের প্রচলিত ভুল রীতিনীতিগুলো এবং নারীদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এর কারণ।
সমাজের প্রচলিত ভুল রীতিনীতিগুলো পরিবর্তন এবং নারীদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদল করতে পারলে নারী নির্যাতন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে, সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে এবং সংসারে নারীকে সম অংশিদারিত্বের মর্যাদা দেয়া বাঞ্চনীয়। একটি সুশীল সমাজ গঠনে নারীর প্রতি বৈষম্য বিরাট বাঁধা। প্রতিবাদের মাধ্যমে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করা সময়ের মুখ্য দাবী।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)