দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বর্তমান সময়ে নারী পুরুষের সাথে সমতালে কাজ করার ক্ষমতা রাখে এবং কাজ করছে। তবে নারীদের ক্ষেত্রে মানুষে হিসাবে তার প্রাপ্য হিসাবে বৈষম্যমুলক আচরণ ও চিন্তাভাবনা বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়।
এ বিষয়টি যে কেবলমাত্র আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান তা কিন্তু নয়। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ও দেখা যায়, একই কাজের ক্ষেত্রে একজন পুরুষকে যে পারিশ্রমিক দেয়া হয় একই পারিশ্রমিক নারীকে দেয়া হয় না। আবার সমযোগ্যতা সম্পন্ন হলেও একই পদে পুরুষের অগ্ররাধিকার থাকে বেশী। অনেক ক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় যে, দায়িত্বপূর্ণ কাজে নারীর উপর আস্থা রাখাতে সংশয় আছে। যদিও উন্নয়নের ধারাবাহিকতাতে নারীরা ঘর সামলিয়ে তাদের দক্ষতার প্রমাণ রাখছে কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে। তথাপি মনে করা হয় নারী ব্যক্তিজীবনে সংসার সন্তানের দেখভাল করে কাজের জায়গাতে যথাযথভাবে সময় বা মনোযোগ দিতে পারে না।
‘অধিকার, স্বাধীনতা, আত্মপরিচয়’ – শব্দগুলো নিয়ে নারীরা কথা বললেই বলা হয় মেয়েটা নারীবাদী। অথচ নারীবাদী বিষয়টির ব্যাপ্তি অনেক। কেননা সামাজিক রীতিনীতি, আইনের বিধি-বিধানসহ সকল ক্ষেত্রে একজন নারীর অবস্থানকে বিবেচনা করতে হয় নারীবাদের বিশ্লেষণে। পুরুষবিদ্বেষ চলন বলন দিয়ে নারীবাদী প্রতিবাদে সমাধান হয় সাময়িক।
বস্তুত মানুষ হিসেবে যে বিষয়গুলো পুরুষের বেলাতে প্রযোজ্য সে একই বিষয় নারীদের বেলাতে কেন নয়? এ কথাটা এ আধুনিক যুগেও সবার আগে ভাবতে হচ্ছে নারীদের প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে।
নারী পুরুষের বৈষ্যমতার সুত্রপাত ঘটে নারীর শৈশব থেকে। সমাজের বাস্তবতায় দেখা যায়, একটি মেয়েকে সবার আগে পরিবার থেকে ধারণা দেয়া হয়, ‘তুমি যত বড়ই হও না কেন, নারী হিসাবে তুমি পুরুষের সমকক্ষ হবে না।’ তাই বাইরের জগতে প্রতিষ্ঠিত অনেক নারী এখনো তার পরিবারে পরাধীনতার বেড়াজালে আবদ্ধ। স্বাধীনতা বলতে শুধু চলাফেরাতে স্বাধীন হলে হয় না। এখনো মনে করা হয় একজন নারী যতই মেধাবী হোক না কেন সে পুরুষের চেয়ে কম বুঝে।
পরিবার পরিচালনা, সন্তানের লালন পালনের দায়িত্বগুলো নিজে থেকে ধারণ করে নারী জন্মগত ভাবে। এক সময় ঘর সামালানো নারীদের একমাত্র কাজ ছিল। কিন্ত সময়ের সাথে সাথে অনেক নারীরা এখন যাপিত জীবনে দশভূজার মত ঘরে বাইরে কাজ করে। তবুও নারীকে পরিবারের বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বলা হয় ‘তুমি কি বুঝো’।
একজন পুরুষ অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজের পর দিন শেষে ঘরে ফিরে সংসারের আর কিছু নিয়ে ভাবতে নারাজ। সেখানে বাইরের একই কাজ করার পরে নারী ঘরে ফিরে সংসার সন্তান সব সামলে যায় দিনের পর দিন। অথচ এ নারী যখন নিজের মত করে একটু সময় চায় নিজেকে নিয়ে ভাবতে,তখনই ঘটে বিপত্তি।
সত্যিকারভাবে ‘নারী স্বাধীন’ এ কথাটার অন্তরালে পরাধীনতার শিকল জড়িয়ে আছে নারীদের জীবনের পদে পদে। উচ্চ বিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সকল স্তরে এ শিকল রয়েছে নানা ভাবে। আর তারা বেদনাগুলো আড়াল করে মেকাপের রঙ দিয়ে।
সামাজিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, অনেক উচ্চবিত্ত পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত নারীরা যেন শো কেসে সাজানো চাবি দেয়া সাজগোজ করা পুতুল। আর তাদের এমন পুতুলে পরিণত করা হয় পরিবারের চাহিদামত। নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে সে পুতুলের কাছে সুন্দর কথার ফুলজুড়িতে সুখী সুখী ভাব নিয়ে নিজের চেয়ে স্বামীর প্রশংসা করাটাই হয় মুখ্য বিষয়। কারণ তার নিজের জীবনের চাওয়া পাওয়া সকল কিছু হারিয়ে গেছে স্বামী সংসারের কাছে। হয়তবা এক জীবনে তার স্বপ্ন ছিল নিজের মেধা দিয়ে নিজের মত করে প্রতিষ্ঠিত হবার। স্বামীর পরিচয় দিয়ে বিত্তবৈভব সব পেয়ে ও তার নিজের বলে কিছু নেই। এমনকি নিজের নামটুকুও হারিয়ে যায় স্বামীর নামের আড়ালে। এটা কি আসলে স্বাধীনতা নাকি স্বাধীনতার নামে এ জীবন বেহালার বিষাদের সুর তা কেবলই প্রশ্ন হয়ে থাকে।
কারণ এ বেদনার বিষাক্ত ছোবল থেকে বেরিয়ে আসার পথটা সহজ নয়। এর জন্য নিজের মনের বন্ধ দুয়ার খুলে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে সবার আগে। ‘কন্যা জায়া জননী’- এ হলো নারীর চলার পথের তিনটি রূপ। কিন্তু সবার আগে নারী একজন মানুষ। তার জগত তাকেই চিনতে হবে জানতে হবে। পারিবারিক বন্ধন সামাজিক রীতিনীতিতে নিজের আত্মপরিচয়টা হবে মুখ্য।
শুধুমাত্র বাইরে কাজ করে উপার্জন করলেই আত্মনির্ভরশীল মনে করা হবে তা কিন্ত নিয়। যে নারী সারাদিন ঘর সন্তান সামাল দেয় সে কাজটি যে দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভুমিকা রাখে তা বুঝতে হবে সবাইকে।
মোটা দাগে বলতে হয়, চিন্তা চেতনাতে নারীর স্বাধীনতা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। নারী বলে সে কম বুঝে এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সমাজকে। তবেই নারী পাবে সত্যিকারের স্বাধীনতা, পাবে আত্মপরিচয়ের বিকশিত রূপ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)