মূল্যবান গ্যাস দিয়ে রান্না করার কাজকে অপচয় বলছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পেট্রো সেন্টারে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, গ্যাস এত মূল্যবান সম্পদ যে, এটা দিয়ে ভাত-তরকারি রান্নার করা একেবারেই অপচয়।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের দেশে প্রচুর গ্যাস রয়েছে। তাই ডোমেস্টিক কনজাম্পশনে গ্যাস সরবরাহ করেছিলাম। এখন আমরা যা দেখছি, আমাদের কাছে গ্যাস যা আছে, তা একেবারেই যৎসামান্য। এটা আমাদের নিজেদের বোঝা উচিত, অন্যদের বোঝানো উচিত যে, রান্না-বান্নায় গ্যাসের ব্যবহার চলবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত গ্যাসের ১২ শতাংশ ব্যবহার হয় গৃহস্থালিতে রান্নার কাজে।
আমার মনে হয়, তিনি তার মায়ের হাতের রান্নার কথা আজো ভুলতে পারেননি। কিংবা তার দাদী-নানীর হাতের রান্না-যা কিনা বহু কাঠখড় পুড়িয়ে রেধেছিলেন তারা। সেই স্বাদ আবারো ফিরে পেতে চান অর্থমন্ত্রী। মুখে রুচি মনে হয় কম হয়ে গেছে।
কিন্তু, তিনি মনে হয় ভুলে গেছেন সুস্বাদু এসব রান্নার পেছনে তার কন্যা-জায়া-জননী, নানী-দাদীর কতই না অক্লান্ত পরিশ্রম জড়িত। কত কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই তৈরি হয়, হয়েছে সেইসব সুস্বাদু খাবার। রান্না করতে গিয়ে নাকের পানি, চোখের পানির হিসাবটা না হয়, নাইবা করলাম।
এখনো গ্রামীণ জনপদে চুলাতেই রান্না করেন মায়েরা, বোনেরা। কিন্তু আমরা যারা শহুরে বাসিন্দা তারা জানি, গ্যাসের চুলায় রান্না জীবনকে কতটা স্বাভাবিক করেছে। কতটা সময় বাঁচিয়েছে, ব্যস্ততম নাগরিক জীবনের। এই যে সময় বাঁচানো আর শ্রম কমানোর হিসাবটা কি করেছেন অর্থমন্ত্রী? বলতে পারবেন কত কাঠ বা খড় পুড়বে এই রান্নার কাজে? সে হিসাব কি আছে ওনার কাছে? তা কি গ্যাসের চেয়ে সাশ্রয়ী হবে…? হলে তার অনুপাত কত? সেটাও তো জানাতে হবে নাকি…রাবিশ টকের কি কোনো সুযোগ আছে?
অনেকেই অবশ্য এরই মধ্যে বলা শুরু করেছেন যে, সুন্দরবন উজারের যে পরিকল্পনা, তা থেকেই জ্বালানি হিসাবে কাঠের পর্যাপ্ততটা বাড়বে বেশ কয়েকবছর। নগরবাসীদের জন্য হয়তো, সুন্দরবনের কাঠকেই জ্বালানী হিসেবে উপহার দিতে চান অর্থমন্ত্রী- এটা নিন্দুকদের মন্তব্য। আমি বলি ভিন্ন কথা।
আমার কথা হলো, মেয়েরা তৈরি হয়ে যাও। রান্নার কাজটা এখন থেকে ছেলেদের দিয়েই করাতে অভ্যস্ত হও। সব ধরণের রান্নার কাজ অর্থমন্ত্রীর মতো ছেলেরা যদি করেন তাহলেই ভালো। তাহলেই বুঝতে পারবে, গ্যাসে রান্না ভালো, নাকি কাঠখড়-এ।
একদিক দিয়ে সুদূরপ্রসারি চিন্তার অধিকারী অর্থমন্ত্রী কিন্তু ভীষণ নারীবান্ধব। আর পুরুষ বিদ্বেষী। নারীবান্ধব এই কারণে যে, উনি পরোক্ষভাবে নারীদের ঠিক এই কাজটিই করার ইঙ্গিত করছেন। মন্ত্রী হয়তো মুখ ফুটে বলতে পারছেন না যে, পৃথিবীর সব চেয়ে ভালো ভালো বাবুর্চি কিন্তু মেয়ে নয়, ছেলে। সুতরাং বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম হবে কেন?
আমি তো, এই ঘোষণায় বেশ খুশি। বাড়িতে বলে দিয়েছি, তিন বেলার খাবার, ভাগ ভাগ করে রান্না করবো এখন থেকে। সকালে আমি রান্না করলে, বিকেলে রান্না করবে স্বামী অথবা ভাই। তারা তো রাজী হয়েছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, অন্যরাও কি রাজী হবেন?
হলে তো কথা নেই, না হলে অনেক কথা আছে। অর্থমন্ত্রী আমাদের ঘাড়ে অনেক কিছু চাপিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের এত এত কোটি টাকা চুরি হয়ে গেলো, কোনো দায় নিলেন না অর্থমন্ত্রী। ঋণ দিয়ে খেলাপির সংখ্যা বাড়িয়েছেন বছরের পর বছর, কোনো উদ্যোগ নেই সেসব অর্থ উদ্ধারে। এখন আবার গ্যাসে নয়, কাঠখড়ে রান্নার দায়টাও চাপাতে চাইছেন আমাদের উপরই। এমন পরশ্রীকাতর অর্থমন্ত্রী কেবল বাংলাদেশেই সম্ভব।
এমনিতেই গ্যাস সংকটের কারণে ২০০৯ সাল থেকে গৃহস্থালিতে নতুন আর গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না বললেই চলে। কোনো কোনো এলাকায় গ্যাস লাইনে এতো কম গ্যাস আসে যে, আজকে রান্না বসালে তা পরদিন খাবার উপযোগী হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান যে সামাজিক প্রেক্ষাপট, তাতে রান্না একটি গৃহস্থালী কর্ম। আর এর দায়িত্ব এখনও মেয়েদেরই ঘাড়েই। সেই জন্য অর্থমন্ত্রীকে আগাম অভিনন্দন। তিনি মেয়েদের ঘাড় থেকে এই দায়টা নামানোর জন্য মেয়েদেরকে একটু সচেতন হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এজন্য নারীবান্ধব অর্থমন্ত্রীকে অভিনন্দন।
পাশাপাশি, মেয়েরা যদি এটা করে, তাহলে ঘরে-বাইরে আগুন জ্বলবে কি না, কিংবা গ্যাসের আগুন গোটাদেশ পুড়িয়ে দেয় কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।
যাই হোক না কেন- অলওয়েজ বি পজিটিভ অর্থমন্ত্রীর প্রত্যেকটা কথার একটা করে রসালো দিক তো থাকেই। হোক সেটা রাবিশ বা অন্যকিছু। তাতে কি, ভালো একটা ইস্যু, এখন থেকেই একটু সচেতন হলে মেয়েরা কিন্তু রান্নার দায়িত্বটা পুরুষদের কাঁধে দিতেই পারে। একটু চেষ্টা করলেই এটা সম্ভব। দারুণ এক বিপ্লব ঘটে যাবে কিন্তু। ঘরে ঘরে এই দুর্গটা এখন থেকেই মেয়েদের তৈরি করতে হবে। তা না হলে দেরী হয়ে যাবে।
আর সেটা করতে পারলেই কেল্লাফতে। তখন গ্যাসে রান্না হোক, কিংবা পেট্রোলে রান্না হোক, কিংবা সুন্দরবনের সুন্দরী কাঠে- তাতে কি আসে যায়। যার ঠেলা, সে বুঝবে- আমার বা অর্থমন্ত্রীর কি? তাই না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)