সন্তান হবার পর অনেকেই সুন্দর কিছু নাম প্রস্তাব করার জন্য অনুরোধ পাঠান। মনে মনে হাসি। জানি প্রস্তাবিত নামগুলোর একটিও না রেখে তাঁরা নিজেদের ভেবে রাখা নামই রাখবেন। তবু কৌতুক এবং কৌতুহলবশত এই খেলাটিতে অংশ নিই।
একবার একজনকে জিজ্ঞেস করলাম—কী ভাই, ভাতিজার জন্য কতগুলো নাম দিলাম…। উনি সলজ্জ উত্তর দিলেন—আপনার ভাবির পছন্দ কী করে ফেলে দেই, বলেন? ভাবিকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন—আপনার ভাইয়ের পছন্দ। নাটকও যোগ করলেন খানিকটা—আপনার ভাই তো বিয়ের প্রথম দিন হতেই সন্তানের নাম…। দুষ্টামি করে বললাম—ভাই তো বললেন নামটি নানা-নানীর দেওয়া। খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সামলে নিয়ে বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাবুর নানা-নানীরও ওই নাম পছন্দ হয়ে গ্যালো তো…।
বাংলাদেশিদের মধ্যে সন্তানদের নাম ছান্দসিক রাখার বা মিলিয়ে রাখার বাতিক আছে। একবার এক দম্পতি দুই কন্যার সংগে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন—বড়জনের নাম রূপকথা, ছোটজনের নাম চুপকথা। চুপকথা? মনে হল আরেকটি কন্যা হ’লে নাম রাখবেন স্যুপকথা। আরেকজনের দুই কন্যার নাম কণা ও শনা। ‘শনা’? উনাকে জিজ্ঞেস করলাম তালব্য-শ, দন্ত্য-স, না কি মূধর্ণ-ষ, কোনটা দিয়ে শনা লিখেন। তিনি আমার চাইতেও বেশি বিভ্রান্ত হলেন। স্ত্রীকে ডাকছিলেন—অ্যাই বলো তো তালব্য-শ, দন্ত্য-স, না কি মূধর্ণ-ষ, কোনটা দিয়ে শনা লিখি যেন!
নারী সন্তানসম্ভবা হতে না হতেই জনক-জননীর প্রথম চিন্তা পেটের সন্তানের নামটি কি হবে। দাদা-দাদী-আত্মীয়, বন্ধুদের মাথায়ও নানা নাম ঘুরপাক খায়। নাম নিয়ে একমত হতে না পারা স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাঁটি হতে বিচ্ছেদের নজিরও আছে। বাংলাদেশিরা কুসংস্কারাশ্রয়ী নাম রাখেন, ধর্মাশ্রয়ী নাম রাখেন, কাব্যাশ্রয়ী-সাহিত্যাশ্রয়ী নাম রাখেন, ইতিহাসের আবেগেও নাম রাখেন (যেমন সংগ্রাম, বিজয়, জয়, স্বাধীন)। নামকরণের আড়ালে এইসব সমাজ-সম্পৃক্ততা, কাব্য-ভাবালুতা ও আবেগস্পর্শিতার কারণে পিতা-মাতার দেওয়া নাম বদলানোকে বাংলাদেশিরা সাধারণত: ‘পাপতুল্য’ জ্ঞান করেন ও ঘৃণা করেন।
অথচ বেশিরভাগ চীনা বা ফিলিপিনো বা থাই ইমিগ্র্যান্ট্ররা কানাডায় এসেই নাম পালটে ইংরেজ ইংরেজ টাইপ নাম নিয়ে নেয়। তাতে নাকি চাকুরী-বাকুরিতে কর্মস্থলে বৈষম্যের শিকার হতে হয় কম। অনেককে বলতে শুনেছি—চাকুরী-বাকুরিতে নাকি অনেক আবেদনকারী শুধুমাত্র মুসলমান নাম বা চীনা নাম-এর কারণে শর্টলিস্টেড হন না। প্রাক্তন এক ফিলিপিনো সহকর্মীর কাছ থেকে দিনকয়েক আগে জানলাম অসংখ্য চাকুরীর আবেদনের পরও একবারের জন্যও শর্টলিস্টেড হতে পারেন নি। কিন্তু নাম পাল্টানোর পর আশি-নব্বইভাগ ক্ষেত্রেই শর্টলিস্টেড যেমন হচ্ছেন, চাকুরীও পাচ্ছেন।
কানাডা-আমেরিকার মানুষজনও কথায় কথায় নাম পালটায়। কারণ, কানাডা আমেরিকায় নামের বৈচিত্র্য খুব কম। পেছনের কারণ, নামকরণ নিয়ে এদের ভাবালুতা প্রায় নাই বললেই চলে। এক পাড়ায় একই নামের দশ-কুড়িজন পেয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। শার্লি, জেনিফার, হুইটনি, মেলানি, ক্রিস্টিন, লিন্ডা, ডোনা, লিসা, ন্যান্সি, ক্যারেন এইরকম কিছু নাম ধরে রাস্তায় একটা হাঁক দিলে অসংখ্য নারী দাঁড়িয়ে যাবে। আমি নাম মনে রাখতে পারি কম। হালকা পূর্ব-পরিচিত এক নারীকে এক অফিসিয়াল অনুষ্ঠানে পরীক্ষামূলকভাবে জিজ্ঞেস করলাম—ইউ আর লিন্ডা, রাইট? ভদ্রমহিলা উত্তর দিলেন—‘নো, লিন্ডা ইজ মাই সিস্টার’।
১৯৯০ সালে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় জন্ম নেয়া বাংলাদেশের একদল শিশুর নাম রাখা হয়েছিল ‘সাদ্দাম’। টুইন টাওয়ার ধ্বংসের কয়েক বছর আগে হতে ওসামা বিন লাদেনকে বিরাট কোনো বীরপুরুষ ভেবে অনেক শিশুর নাম রাখা হয়েছে ‘ওসামা’, অথবা ‘লাদেন’, অথবা ওসামা বিন লাদেন পুরোটাই। আমেরিকা-কানাডার ইমিগ্রেশন তাদের জন্মসালের সঙ্গে নামের সংযোগ বের করে ফেলে সহজেই, এবং প্রফাইলিংও করে। নামের কারণে বিপদে পড়া, হেনস্থা হওয়াসহ বিনা অপরাধেই অস্বস্ত্বিকর জেরা, আটক, হাজতবাস ইত্যাদিতে ভোগার ঘটনাও অনেক আছে। মুসলমানদের নামের সংগে মহানবীর নাম ‘মুহাম্মদ’ থাকা প্রায় অবধারিত। সে’জন্য বিপদের আশংকার নীচে থাকা তো আছেই।
কয়েকদিন আগে চলে গেল টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার দিন। টুইন টাওয়ারের ঘটনার অব্যবহিত পর বিদেশে অনেক মুসলমান বিপদের ভয়ে নাম পালটেছিলেন। নাম পাল্টানোকে এখনো অনেক বাংলাদেশি প্রবাসী ভাল চোখে নিতে পারেননি। অনেক আলাপচারিতায় লক্ষ্য করেছি তাঁরা বিষয়টি নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন। সম্প্রতি আমি নাম পরিবর্তন বিষয়ে বেশ খানিকটা মতামত লেখালেখি নাড়াচাড়া করে মোটামুটি নিশ্চিত যে কৌশলগত প্রয়োজনে নাম পরিবর্তন করলে ধর্ম-চর্চা বা স্ব-সংস্কৃতিচর্চায় ব্যাঘাত ঘটার কোনোই কারণ নেই। এবং এ-ও বিশ্বাস করি যে এ’দেশিয় নাম নিলে আসলেও বৈষম্যসহ অন্যান্য অনেক বিপদের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়। যারা নিজনিজ নাম নিয়ে খুবই আত্মবিশ্বাসী ও সন্তুষ্ট নন, তাঁরা বাংলাদেশ হতে নাম বদলে বিদেশে অভিবাসনের চেষ্টা করলে তাতে বুদ্ধিমত্তা দেখি, অপরাধের বা অন্যায়ের কিছু দেখি না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)