মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা আগমনের চার বছর আজ। মানবিক কারণে এ দেশে ঠাঁই পেলেও এই সময়ে হত্যা, অপহরণ-সহ বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে তারা।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা নির্যাতনের মুখে পড়ে সাত লাখের অধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় আশ্রয় নেয়।
কক্সবাজারে আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা-সহ ১১ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৪টি ক্যাম্পে বসবাস করছে। কখন তারা স্বদেশে ফিরে যাবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা নানা কারণে থমকে আছে। এর মাঝে এসব রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়ছে নানান অপরাধের সাথে। ভাসানচরে আধুনিক ভাবে তৈরি কৃত আশ্রয়ন প্রকল্পে ঠায় হয়েছে ১৯ হাজার রোহিঙ্গার। নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার নিশ্চয়তা নিয়ে আদৌ নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে কিনা তা নিয়েও উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রোহিঙ্গারা। এখানে এসে জন্ম নিয়েছে প্রায় ১ লাখ শিশু। তাদের নিজ দেশে ফেরাতে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহবান রোহিঙ্গাদের।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সন্ত্রাস দমনের নামে সেদেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর জাতিগত নিধন শুরু হলে হলে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রাণ বাচাঁতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আসতে থাকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ঢল। ২৫ আগস্টের পর দুই তিন মাসের মধ্যেই এখানে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা। এ ছাড়া কক্সবাজারে আগে থেকে আশ্রয় নেয়া সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা সহ ১১ লাখের অধিক রোহিঙ্গাকে ৩৪ ক্যাম্পে আশ্রয় দেয়া হয়। পরবর্তীতে জাতিসংঘের তত্বাবধানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর খাদ্য সহায়তা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা গুলো নিশ্চিত করা হয়।
২০১৭ সালেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সাথে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করে এবং দুই দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিলেও একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। তাদের প্রধান দাবি রোহিঙ্গা হিসেবে তাদের জাতিগত স্বীকৃতি, নাগরিকত্ব প্রদান, নিজ ভিটে-মাঠি ফেরত দেয়ার পাশাপাশি স্বাধীনভাবে চলাচলের সুযোগ দিলে তারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাবে।
এ নিয়ে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতু পালং মেগা ক্যাম্পের বাসিন্দা রহিমা খাতুন,আবুল কাশেম আর রহিম উল্লাহ বলেন, ‘মিয়ানমারে এখনো নির্যাতন চলছে। আমি আমাদের সব অধিকার ,নিরাপত্তা পেলে ফিরে যাবো। কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা আব্দু সালাম বলেন,বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী না হলে আমরা হয়তো এতদিন বাচঁতে পারতাম না। তাই শেখ হাসিনার প্রতি আমরা সবাই কৃতজ্ঞ’।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরব রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতেও চলছে রোহিঙ্গা গনহত্যার বিচার। তার উপর মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের কারনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
এ ছাড়া বিশ্বব্যপি ছড়িয়ে পড়া করোনা পরিস্থিতি, মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বিভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কখন শুরু হবে তার নিশ্চয়তা দেখছেনা রোহিঙ্গারা। তবে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা জানান, ‘তাদের জাতিগত পরিচয় ও অধিকার ফিরিয়ে দিলে তারা স্বদেশে ফিরে যাব’।
এ নিয়ে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস হিউম্যান রাইটস এরসেক্রেটারি মোহাম্মদ জুবায়ের বলেন, ‘মিয়ানমারে এখন কোন সরকার আছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমরা আমাদেও বসত ভিটা,জমি,অধিকার সহ সব কিছু ফিওে পেলে অবশ্যায় চলে যাব’।
কুতুপালং ৫ নং ক্যাম্পর জি ব্লকের মাঝি মোহাম্মদ সেলিম আমরা নিজ দেশে ফেরার জন্য সবসময় প্রস্তুত রয়েছি। আমরা এ দেশে থাকার জন্য আসিনি। প্রাণ বাচাঁতে এসেছিলাম।
উখিয়া ও টেকনাফে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বসবাসের কারণে এলাকায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি সহ স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নানা সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়ে উখিয়ার কুতুপালং এলাকার জনপ্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা হত্যা, অপহরণ-সহ বড় বড় অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের এলাকার জনগণ দিন দিন তাদের কাছে অসহায় হয়ে যাচ্ছে’।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তারেক বলেন, সঠিক উদ্যোগ না নেওয়ায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন যেমন ব্যর্থ হয়েছে তেমনি দীর্ঘমেয়াদি অবস্থান করায় রোহিঙ্গাদের কারণে আর্থসামাজিকসহ শান্তিশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই আমাদের একমাত্র কাম্য।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গাদের অপরাধ দমনে কাজ করছে পুলিশ। বর্তমানে ক্যাম্পের ভেতর আর্মড পুলিশ এর ৩টি ব্যাটালিয়ান ও জেলা পুলিশের কড়াকড়িতে দিন দিন অপরাধ কমে আসছে। তবে এ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১৪ টি মামলা হয়েছে। তাতে ২৬৮৭ জন আসামীর মধ্যে ১৬২২ জন গ্রেফতার রয়েছে। এ ছাড়া এসব মামলার মধ্যে ৮৯৪ টি মামলার তদন্ত শেষে পুলিশ রির্পোট দাখিল করা হয়েছে। এসব মামলার ৪৬% ভাগই মাদকের মামলা বলে জানায় পুলিশ।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, যারা এখানে আশ্রয় নিয়েছে তারা যেন সব সময় ভালো থাকেন সে দিকে আমাদের দৃষ্টি থাকে সব সময়। আমরা তাদেও কে বলছি নিজ দেশে ফেরার জন্য তারা যেন প্রস্তুত থাকে।
ভাসানচরে যারা যেতে আগ্রহ প্রকাশ করছে আমরা তাদেও কে সেখানে পাঠাচ্ছি। আধুনিক সে আশ্রয় কেন্দ্রে বর্তমানে ৪ হাজার ৭ শ পরিবারের ১৯ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। শরনার্থী ত্রান ও প্রত্যাবাস কমিশনার জানান,এখানে এসে জন্ম নিয়েছে প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা শিশু। এখন ক্যাম্পে জন্মনিয়ত্রন পদ্ধতি গ্রহনে তারা আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমরা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছি। ক্যাম্পের বয়স্কদের করোনা টিকা দেয়ার কাজ ও চলছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে কাজ করছে। আমাদের দেশে আশ্রয় নেয়া এবস মানুষ গুলোকে তাদের নিজ দেশে নিরাপদে ফেরত পাঠাতে কাজ করছে সরকার।