যোগীপর্বের গানে মূলত গুরু-শিষ্যের প্রশ্ন-উত্তরমূলক সংলাপের মাধ্যমে মানবের দেহ সৃষ্টিতত্ত্বের মৌলিক বিষয় উপস্থাপন করা হয়। এই গান মধ্যযুগের বাংলার নাথ সম্প্রদায়ের সংগীত-দর্শনমূলক আখ্যানকাব্যের বিবর্তিত রূপ। দেহতত্ত্বের মৌলিক বিষয়গুলি আলোচনার ভেতর দিয়ে এই গান সাম্প্রদায়িক বিভেদের পরিবর্তে মানবতার জয়গান প্রচার করে থাকে।
নাথ সম্প্রদায়ের বিচিত্র আখ্যানকাব্যে সংলাপ চলতো কখনো মীননাথ ও গোরক্ষনাথের মধ্যে, কখনো বা রাণী ময়নামতি ও পুত্র গুপিচন্দ্রের মধ্যে, আবার কখনো গুরু-শিষ্যের মধ্যে। বাংলা সাহিত্যে আলোচিত নাথ-সম্প্রদায়ের আখ্যানকাব্যের মধ্যে শুকুর মাহমুদের ‘গুপিচন্দ্রের সন্ন্যাস’, শেখ ফয়জুল্লার ‘গোরক্ষবিজয়’, শ্যামদাস সেনের ‘মীনচেতন’ অন্যতম।
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার মতে, নাথ ধর্মের উৎপত্তি বাংলায়। মুঘল ও নবাবি আমলে বাংলায় নাথগুরুদের জীবন ও দর্শনভিত্তিক আখ্যান নৃত্য গীত সহযোগে পরিবেশনের রীতি বেশ জনপ্রিয় ছিল। এমনকি ব্রিটিশরা ক্ষমতা গ্রহণের পরও। ইংরেজি সিভিলিয়ানদের লেখায় দেশের সর্বত্র নাথ যোগীদের নৃত্য-গীত চর্চার বিষয়টি উল্লেখ আছে।
বর্তমানে নাথ সম্প্রদায়ের আখ্যান কাব্যের পরিবেশনা বিরল বিষয়ে পরিণত হয়েছে। উত্তরবঙ্গের ২/৩ টি দল যোগীপর্বের গান পরিবেশন করে থাকেন। তবে তাদের পরিবেশনের সুযোগ খুবই কম। যোগীর গান পরিবেশনকারীদের মধ্যে মোহাম্মদ তছের মণ্ডল গায়েন একাডেমিক মহলে আলোচিত সাধকশিল্পী। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশের লোকনাটক: বিষয় ও আঙ্গিক-বৈচিত্র্য (২০০৮) শীর্ষক গ্রন্থে তাঁর পরিবেশনা নিয়ে আলোচনা করেছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করেছেন।
চলনবিল অঞ্চলে নাটোরের শহরতলী সংলগ্ন কৈগাড়ি কৃষ্ণপুর গ্রামে বসবাস করেন তছের মণ্ডল ও তার দলের সদস্যরা। তারা মূলত মেহনতি মানুষ। সঙ্গীত তাদের পেশা নয়-তাঁরা গান করেন আনন্দে। তছের মণ্ডলের যোগীর গান প্রথম ওস্তাদ হলেন তাঁর পিতা মরহুম মোহাম্মদ আলী মণ্ডল এবং পরে তিনি এলাকার বিখ্যাত যোগীর গানের সাধকশিল্পী মাহিন প্রামাণিকের কাছে যোগীর গানের দীক্ষা গ্রহণ করেন। তছের মণ্ডল দীর্ঘদিন যাত্রা দলের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। বর্তমানে মনসামঙ্গলের বিশেষ ধরনের পরিবেশনা পদ্মপুরাণ গানসহ বিভিন্ন পালাগান পরিবেশন করে থাকেন।
তছর মণ্ডলের দলের পরিবেশিত যোগীর গানে সংলাপ হয় মূলত গুরুর সঙ্গে শিষ্য ও অন্যদের। প্রথা অনুসারে, যোগীর হাতে থাকে জ্বলন্ত আগুনের মশাল। এই পরিবেশনায় গুরুর ভূমিকা পালন করেন তছের মণ্ডল।
যোগীর গানের আসরে সাধারণত একদল মঞ্চের মাঝে হারমোনিয়াম, ঢোলক, জুড়ি, খঞ্জরী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বৃত্তাকারে বসে থাকেন। আর গুরু-শিষ্যসহ অন্যান্য অভিনয়শিল্পীরা বৃত্তাকারে বসে থাকা বাদ্যযন্ত্রী ও দোহারদের চারপাশে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে নৃত্য-গীত ও নাট্য পরিবেশন করেন। মঞ্চে বল্লাক দাস নামক শিষ্য চরিত্রে মোক্তার মোল্লা, যোগিনী চরিত্রে ফরহাদ মণ্ডল এবং যোগিনীর পুত্রের চরিত্রে জহিরুল ইসলাম ঠান্টু অভিনয় করেন। দলের অন্য সদস্যরা হলেন মিরাজ প্রামাণিক, রিন্টু মোল্লা, দিনাজ প্রামাণিক, রহমান প্রামাণিক, নাজীর মণ্ডল ও জামাল প্রামাণিক ও খাতার মাস্টার মুজির উদ্দিন মেম্বার।