চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

আমরা যারা গা বাঁচিয়ে চলি

চলার পথে জীবনের বাঁকে বিচিত্র সব মানুষের সাথে পরিচয়। বিচিত্র মানুষ বলতে বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির, মতবাদের, ধর্মের, অঞ্চলের, মানসিকতার মানুষের সাথে সখ্য। নানা প্রয়োজনে সম্পর্কের সূত্রপাত হয়ে থাকে। তবে কর্মপরিধির সূত্র ধরে উত্থাপিত সম্পর্কগুলো দীর্ঘদিন বজায় থাকে। সকলের সাথে দীর্ঘদিন সুসম্পর্ক বজায় থাকে না আবার ব্যক্তিবিশেষে কারোর কারোর মধ্যকার আমৃত্যু সম্পর্ক লালন করে কিংবা জাগরুক থাকে।

বৈচিত্র্যতায় পরিপূর্ণ মানুষের জীবন, বৈচিত্র্যপূর্ণ আচরণ পরিলক্ষিত হয়ে থাকে ক্ষেত্রবিশেষে। তবে ঘন ঘন চরিত্রের বদল এবং নিজস্বতায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে ব্যতিক্রম প্রাণী আর একটিও নেই। সেরকম কয়েকটি ঘটনার চিত্র তুলে ধরতেই আজকের নিবন্ধের প্রয়াস তৎসাপেক্ষে বহু শ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা নিজেরা গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে থাকেন। আমরা যারা নানা ঘটনা প্রবাহের আবর্তে চরিত্রের পরিবর্তন করে থাকি তাদের মুখোশ উন্মোচনের নিমিত্তে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

১.
শুরুতেই একটা কথা বলে নেই, যিনি কাজ করেন ভুল কিন্তু তারই হয়ে থাকে। আর যিনি কাজ করেন না তার ভুল হবার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কোন একজন লেখক কোন বিষয়ে অসাবধানতা:বশত তথাপি জ্ঞানের ঘাটতি সমেত কোনরূপ তথ্য উপাত্ত কিংবা বিশ্লেষণে ভুল করে থাকলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একশ্রেণির মানুষ রয়েছে যারা ন্যাক্কারজনকভাবে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে ফেনা তুলে ফেলবে কিংবা কারোর লেখা বা মতামত যুতসই না হলেই ব্যক্তিকে নিয়ে মিথ্যাচার করে প্রপাগান্ডা সৃষ্টি করবে। লেখককে সাধারণত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় না।

আপনি যখন কারও লেখা কিংবা মতামত সহ্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলবেন, আপনি যদি যৌক্তিক মানুষ হন তাহলে বিপরীত পক্ষে অকাট্য তথ্য উপাত্ত দিয়ে ভিন্নমতকে ভুল হিসেবে প্রমাণ করাটাই হবে শ্রেয়। কিন্তু সে কাজটি আমরা ভুলেও করি না। করি না এ কারণে যথার্থ বিষয়ে কোনরূপ উক্তি করার নিমিত্তে যদি কারোর বিরাগভাজন হয়ে নিয়মিত যে কোন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হই কিংবা বঞ্চিত হবার আশংকা থেকে সত্য প্রকাশে বিরত থাকি। অর্থাৎ আমরা গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করি। বিষয়টা এমন; আমরা সমস্যা না হলেই হয়। সামষ্টিকভাবে প্রক্রিয়া কিংবা সার্বিক কল্যাণের বিষয়ে আমরা সেভাবে উন্নত মানসিকতা বপন করি না।

অন্যদিকে দেখা যায়, বর্তমান সমাজব্যবস্থায় বুদ্ধিজীবীর অভাব নেই। যে কোন বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান না থাকা স্বত্বেও চাপার জোরে অন্যের উপর মতামত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে থাকে। তাদেরকে যদি বলা হয় আপনি যেহেতু ধর্তব্য বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন তাহলে এ সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ লিখে ফেলেন। তখন আবার এ প্রজাতির মানুষজন অপারগতা প্রকাশ করে বলে; লেখালেখি আমার কাজ নয়। তবে গলাবাজিতে ঠিকই অন্যদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। অবশ্য লিখলে যে তার স্বরূপ বের হয়ে আসবে সেই আশংকা থেকে লেখার সাহস রাখে না।

আবার অনেকেই এমন আছেন; নিজের মতামত প্রকাশ করে সহজেই অন্যের বিরাগভাজন হতে চান না। এ প্রজাতির মানুষজনও বর্তমান সমাজে অহরহ দেখা যায়। নিজে কোথাও কিছু বলবে না আবার অন্যকে বলে দিবে, আপনি এ বিষয়ে এখনও সোচ্চার হচ্ছেন না কেন? অবশ্য নিজের বেলায় কোনরূপ সোচ্চার হবার বালাই নেই। ইচ্ছে করলে কিন্তু তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা পত্র-পত্রিকায় নিজের মতামত প্রদান করতে পারেন। কিন্তু সত্য এবং যৌক্তিক কথা কখনোই তারা বলতে চান না। এককথায় গা বাঁচিয়ে চলে নিজের স্বার্থ বজায় রাখার চেষ্টা করে সর্বদা।

২.
আমি একজনকে চিনি এবং জানি। তিনি সবসময় একটি গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধাচরণ করে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওই গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক দলের সমালোচনা ও খারাপ পরিস্থিতির সংবাদ প্রতিনিয়ত শেয়ার করে থাকেন। আপনি যে কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী হতেই পারেন এটা দোষের কিছু নয় এবং কোন রাজনৈতিক দলের খারাপ দিকের সমালোচনা করবেন এবং এটা হওয়া উচিত। কিন্তু দোষের তখনি হয় যখন নিজের ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য আপনি আবার উক্ত রাজনৈতিক দলের সমর্থক সেজে যাবেন কিন্তু সেটা কোথাও প্রকাশ করবেন না সেটা হোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অন্য কোন উপায়ে।

ওই রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের (গোপনে চুপিসারে যোগাযোগ রক্ষা করে) নিকট থেকে সুবিধা নিয়ে আবার পূর্বের ন্যায় বিরুদ্ধাচরণ শুরু করবেন। এই রকম জ্ঞানপাপী মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে ক্রমশই বেড়ে চলেছে। নিজের চরিত্র/ব্যক্তিত্বকে সামান্য লোভের কারণে বিক্রি করে দিচ্ছে, বিবেকের আদালতে কখনোই নিজেকে দাঁড় করাচ্ছে না। এবং এ কথাও চরমভাবে সত্য যে, এ রকম মানুষদের মূল্যায়নও হচ্ছে বেশ। যখন যিনি ক্ষমতায় থাকেন তাদের সাথেই লেপ্টে যান ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিয়ে। এ চরিত্রের মানুষ সামগ্রিকভাবে সমাজ ও রাষ্রেনরর জন্য ভয়ংকর। কারণ, তাদের কোন নীতি নেই। ক্ষমতার মসনদে যারা থাকেন তাদের সাথেই কোন না কোনভাবে নিজেদের সম্পৃক্ত করে নেন।

৩.
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুশীল সমাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করে। সরকারি দল, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কাজের গঠনমূলক সমালোচনা করে কার্যত সরকারকে চাপে রাখে সুশীল সমাজ। বাংলাদেশে আমরা তেমন সুশীল সমাজের উদাহরণও দেখেছি। তবে বর্তমানে সুশীল সমাজ সেই অর্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছেন না তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণ এবং যার পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সকল শ্রেণির মানুষের নিকট থেকে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। নিরপেক্ষ আচরণ না করলে সুশীল সমাজ গ্রহণযোগ্যতা হারাবে এটাই স্বাভাবিক।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র নাইমুল আবরার নিহত হয় প্রথম আলোর সহযোগী সাময়িকী কিশোর আলোর আনন্দ আয়োজনে। অভিযোগ উঠেছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার পরে নিকটস্থ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে না নিয়ে মহাখালির আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যায় আবরারকে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা এ ঘটনার পিছনে আয়োজকদের দায়ী করেছে। মৃত্যুর ঘটনাকে চেপে রেখে অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়ার মতো নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। কাজেই, স্কুল ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের স্বপক্ষে যেভাবে প্রতিবাদলিপি ও মানবন্ধন আয়োজনের বিষয়ে অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন ছিল সুশীল নামধারী গ্রুপটির সে ধরনের কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, কাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সুশীল সমাজ সোচ্চার হননি।

পরিশেষে বলা যায়, অপরাধ যিনি সংগঠিত করেন তিনি অপরাধী। অপরাধীর শাস্তি হওয়া উচিত। সত্যকে সত্য এবং মিথ্যকে মিথ্যা বলার সৎসাহস থাকতে হবে সকলেরই। সামান্য ব্যক্তিস্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য নিজের সত্ত্বাকে বিকিয়ে দেওয়ার মানসিকতা পরিহার করার অভ্যাস সৃষ্টি করতে হবে। না হলে ভয়ংকর পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। সুতরাং সকলকে গা বাঁচিয়ে চলার নীতি পরিহার করতে হবে সামগ্রিক পরিবর্তনের স্বার্থে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)