চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

নভেম্বরের প্যান্ডোরাবক্সে লুকিয়ে আছে জেলহত্যার নেপথ্যকাহিনী

ইতিহাসের চর্চা শুধু নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আড়াই মাস পর জেলখানার মত নিরাপদ স্থানের ভেতরে হত্যা করা হয়েছিল জাতীয় চার নেতাকে। আওয়ামী লীগকে উৎখাত করা হয়েছিল আগস্টেই। তাহলে কেন জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হলো? ‘৭৫ এর নভেম্বর নিয়ে আলোচনা আরো হতে হবে। কে বা কারা জেলখানায় ঢুকে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল তা হত্যা মামলার রায়ে জানা গেছে। মৃত্যুদণ্ডও হয়েছে মামলার আসামীদের। কিন্তু আগস্ট আর নভেম্বর মিলিয়ে দেখতে হবে। আর সে উদ্দেশ্যেই যখন আলোচনার সূত্রপাত করেছিলাম তখন অনেকেই তা ভালোভাবে নেয়নি।

এমনকি ডিবিসি নিউজের আলোচনায় এসে জাসদ একাংশের সভাপতি মঈনুদ্দীন খান বাদলও বলেছেন তেমন কথাই। তিনি বললেন, “এই সময়কালটা নিয়ে যদি আপনারা বিতর্ক করতে চান তাহলে হু ইজ রাইট-হু ইজ রং? হিস্ট্রি উইল ডিসাইড। যদি মনে করেন, আপনারা সংসদে আলোচনা করবেন- সো বি ইট। ওপেন দ্য প্যান্ডোরা‘স বক্স!”

মঈনুদ্দীন খান বাদল আরো বলেছেন, তাহলেতো অনেক কথাই আসে। ৭২ সালে জাসদের জন্ম। সেটা কি সশস্ত্র দল হিসেবে? আমরা মুজিবের পতন চেয়েছি কিন্তু যে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তার সাথে জাসদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। জাসদ ৬ নভেম্বর রাতে বসেছে। সেটা জাসদের এপেক্স বডি বসেছে। নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কর্নেল তাহের সেই কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। সেই কমিটি কিন্তু কর্নেল তাহেরের যুক্তি-উপস্থাপনাকে সমর্থন করেছে যে, উই আর গোয়িং উইথ অভ্যুত্থান।”

আসলেই অভ্যুত্থান আর পাল্টা অভ্যুত্থান নিয়ে যত আলোচনা হবে প্যান্ডোরার বক্স ততো বেশি খুলে যাবে। হয়তো ঠিকই বলেছেন জাসদ নেতা মঈনুদ্দীন খান বাদল। তিনি সাংসদ তাই হয়তো সংসদে এ নিয়ে আলোচনা করতে চান। আলোচনা কিন্তু একটা হতেই পারে। ‘উপসংহার’ এর আলোচনায় সেই চাহিদাটাই বারবার অনুভূত হয়েছে। 1446369525_3-november

৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবস পালন করবে আওয়ামী লীগ। যে কেন্দ্রীয় কারাগারে তাদেরকে হত্যা করা হয়েছিল, আজ তা উন্মুক্ত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানিগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার পর এখন সেখানে একটি স্মৃতি জাদুঘর হচ্ছে। আজ বলাই যায়, যদি একটি জাদুঘর হয়, তাহলে জেল হত্যাসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত একটি ঘটনাপঞ্জিও আমাদের দরকার। এখন পর্যন্ত আমরা সে সময়ের ঘটনাবলী পাই নানাজনের স্মৃতি কথায় ।

১৫ আগস্টের পর থেকেই তখনকার সেনাবাহিনীর মধ্যে যে অস্থিরতা চলছিল, তা নিরসনে কোন চেষ্টা নেয়া হয়নি। “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” বইতে কর্নেল শাফায়েত জামিল (অব.) লিখেছেন: “অক্টোবর নাগাদ চিফ অব স্টাফ  জিয়া অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসারদের বিশৃংখল কার্যকলাপের গুরুতর অনুযোগ করলেন আমার কাছে। আমি তাকে বললাম ‘স্যার, আপনি অর্ডার করলে আমি জোর করে এদের চেইন অব কমান্ডে নিয়ে আসতে পারি।’ কিন্তু জিয়া ভুগছিলেন দোটানায়। ১৫ আগস্টের ঘটনাবলি তাকে কিছুটা বিমূঢ় করে দিয়েছিল। তখন তিনি একপা এগোন তো দু-পা পিছিয়ে যান। মনে হলো, চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না জিয়া। যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে।”

শাফায়াত জামিল তার বইতে আরো লিখেছেন যে খালেদ মোশরাফও তাকে বলেছিলেন “ডু সামথিং”। আসলে ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের জন্য খালেদ মোশররফই কেন্দ্রে ছিলেন, কিন্তু মূল পরিকল্পনায় ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। নিজের বইতে তিনি লিখেছেন, “১ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও আমি খালেদের অফিসে বসলাম। বিস্তারিত আলোচনার পর খালেদ সিদ্ধান্ত দিলেন ২ নভেম্বর দিবাগত রাত দুইটায় বঙ্গভবনে মোতায়েন আমার দুটো কোম্পানি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসবে, সেটাই হবে আমাদের অভ্যুত্থান সূচনার ইঙ্গিত।”

২ ও ৩ নভেম্বরের এই অভ্যুত্থানে কর্নেল শাফায়াত জামিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন। তার লেখা বইয়ের নাম “গণতন্ত্রের বিপন্নধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী”। সেখানে তিনি নভেম্বরের অভ্যুত্থানসহ আরো অনেক বিবরণ দিয়েছেন। আমরা আলোচনায় ডেকেছিলাম মেজর (অব.) নাসির উদ্দিনকে। প্রায় দুই ঘণ্টার আলোচনার এক পর্যায়ে তার মুল্যায়নটা ছিল: “এই ৩ নভেম্বরের যে অভ্যুত্থানটি ঘটেছে, এটাকে সেনা অভ্যুত্থানই বলব। এটাকে ব্যর্থ বলতে পারেন আবার আমরা যা অর্জন করেছিলাম সেটার সুফল যেহেতু জনগণ ভোগ করেছে সেটার বিবেচনায় এটাকে সার্থক অভ্যুত্থানও বলা যায়। যার কারণে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থান করতে হলো তিনি মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান। উনি একাত্তরের ২ ডিসেম্বর দিল্লিতে আসেন দুবাই হয়ে একটা ফ্লাইটে। সেখান থেকে ভারতীয় বাহিনীকে না জানিয়ে সোজা চলে আসেন কলকাতায়। যোগ দেন ফোর্সেস হেডকোয়ার্টার্সে। উনার ডিসেম্বরের ২ তারিখে ডিফেক্ট করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার বিষযটি রহস্যজনক। এই একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আজীবন থেকে যাবে। ১৯৭৩ সালে মেজর ফারুক যখন বেঙ্গল ল্যান্সারের কমান্ড নিলেন ততদিনে কিন্তু বেঙ্গল ল্যান্সারে বেশ কয়েকজন প্রমিনেন্ট লোকের আসা-যাওয়া শুরু হয়ে গেছে। এগুলো কিন্তু কোনো ইনভেস্টিগেশনে আসেনি।”

অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সঙ্গে মেজর নাসিরের জড়িত থাকার বিষয়টি জেনে গিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। এজন্য নাসির উদ্দিনকে কুমিল্লার মিলিটারি একাডেমিতে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে ঢাকায় এসে তিনি কর্নেল শাফায়াত জামিল, মেজর হাফিজউদ্দিন, মেজর হাফিজুল্লাহ প্রমুখের সঙ্গে যোগ দেন। এর আগে ১৫ আগস্টের পর তিনি ভারতের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছিলেন। খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানে সরাসরি অংশ নেয়া এবং পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম মেজর (অব.) নাসির উদ্দিন ।151105044605_zia_1975_624x351_doinikbanglascreenshot_nocredit

মেজর (অব.) নাসিরের কথার সুত্র ধরে বলাই যায় যে নভেম্বর ৭৫ এর নানা ঘটনার রহস্য উন্মোচনে একটি তদন্ত কমিশন বা একটি তথ্য উদঘাটন কমিটি করাই যায়। এ বিষয়ে একমত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন এবং অধ্যাপক মেসবাহ কামাল। উপসংহারের আলোচনায় মুনতাসির মামুন বলেছেন, “৩ নভেম্বরের পর এটা নিয়ে একটা জুডিশিয়াল তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল। ৩ দিন পরই এটা জিয়াউর রহমান বাতিল করে দেন। অনেক ঘটনার আড়ালে এই বিষয়টা চাপা পড়ে গেছে। কেন উনি এটা বাতিল করলেন? কোনো কারণতো নেই। নিশ্চয়ই অন্য একটা কারণ আছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে একটা গোষ্ঠি ক্ষমতা দখল করেছে। আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে ৩ নভেম্বরে উনাদের খুন করার কী দরকার ছিল?”

অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেছেন, ৩ নভেম্বরের জেল হত্যার সঙ্গে জড়িতদের  সবারতো এখন পর্যন্ত শাস্তি হয়নি। রিসালদার মোসলেম কোথায় আছে? কোন তাকে পাওয়া যাচ্ছে না? দীর্ঘকাল তাকে এই রাষ্ট্র বিচারের বাইরে রেখেছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে বিচারের মধ্যে আনা গেছে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড- সেটা একটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু যাদের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে তারা কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।”

উপসংহারে এসে প্রবীণ সাংবাদিক আবেদ খান বলেছেন, “নভেম্বরে শুধু ৪ নেতাকে জেলের ভেতরে মেরে ফেলা হয়নি। এই নভেম্বরের ষড়যন্ত্রটা কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে দেওয়ার পরবর্তী পর্যায়ে সুদীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছে। ষড়যন্ত্র বারবার হয়েছে। ডায়নাস্টি শুড নট কন্টিনিউ-এই মনোভাব ছিল তখন। এটা যারা করেছিল তাদের সঙ্গে আমিতো মনে করি, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সংযোগ ছিল। কোন কোন রাজনৈতিক দল ছিল। কি করে এত দ্রুত ত্রাণের চাল পাঠানোর ব্যবস্থা ভুট্টো করেছিল? কী করে স্বীকৃতিগুলো এসে গেল? বেশ কিছু রাষ্ট্র– পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীনের স্বীকৃতিগুলো কীভাবে এলো? আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার যে পরিকল্পনা যেটা এখনো, এই মুহূর্তেও সেটা কিন্তু চলছে।”

জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় দুই আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল বহিষ্কৃত দুই সেনা সদস্য দফাদার আবুল হাশেম মৃধা ও দফাদার মারফত আলী শাহকে নিম্ন আদালতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখে রায় দেন আপিল বিভাগ। সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ছয় সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দিয়েছিলেন। ওই বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি মো. ইমান আলী।

রায় ঘোষণার প্রায় পৌনে তিন বছর পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু আসামীরা পলাতক থাকায় তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর হযনি। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, জেলহত্যা মামলার পলাতক কযেকজনকে খুঁজে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি কার্যকর করার চেষ্টা আছে।

তবে, জেলহত্যা মামলার রায় নিয়ে সংক্ষুব্ধ ছিলেন এই হত্যাকাণ্ডে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত চার জাতীয় নেতার স্বজনরা। পরে আপিল বিভাগের মামলা পরিচালনাকারী, তখনকার অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান নিজেই বিচারিক আদালত এবং হাইকোর্টের রায় সম্পর্কে বলেছেন: “তখন অন্য গভর্নমেন্ট ছিল। তারা আপিল করে নাই। গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে যতো অসহযোগিতা সম্ভব ছিল যাতে বিচারটা না হয়, তা তারা করেছে। ল’ইয়ার চেঞ্জ করেছে, ঠিকমতো করতেও দেয়নি। সাক্ষী আসেনি। স্টেট মেশিনারি, কোর্টের যারা কর্মচারী আছে, পুলিশ যারা সাক্ষী নিয়ে আসবে কোনোটাই ঠিকমতো করতে দেয়নি। ট্রায়ালটা ঠিকমতো করতে দেয়নি সরকার।”

উপসংহারের সর্বশেষ পর্বে এসেছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও জেলখানায় নিহত মনসুর আলীর সন্তান মোহাম্মদ নাসিম। তিনিও একমত যে নভেম্বরের ঘটনার পেছনে যে ষড়যন্ত্র ছিল তা উদঘাটনে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি হতে পারে। উপসংহারের সুপারিশেও আমরা বলেছি, একটি কমিশন হোক। (চলবে…)

(৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে গত অক্টোবর মাস জুড়ে ‘ডিবিসি’ টেলিভিশনে আট পর্বে ‘উপসংহার’ নামে একটি টক-শো করেছেন ডিবিসি নিউজের এডিটর প্রণব সাহা। সেই টক-শোতে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য এবং অন্যান্য বই ও দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি চ্যানেল আই অনলাইন’র জন্য এ ধারাবাহিকটি লিখছেন। টক-শো’র মতো এখানেও তিনি সবার চোখ দিয়ে ৭৫’র নভেম্বরের ঘটনাগুলোতে দৃষ্টিপাত করে একটি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করবেন।)