‘তোমার কোন বাধন নাই, তুমি ঘরছাড়া যে তাই, এই আছো ভাটায় আবার এইতো দেখি জোয়ারে।’ একদিন বাংলাগানের কিংবদন্তী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এভাবেই নিবেদন করেছিলেন তার প্রিয় নদীটির প্রতি হৃদয়ের সুষুপ্ত ভালোবাসার শ্রদ্ধার্ঘ্য “নীল আকাশের নীচে” (নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীতটি নয়) ছবিতে। আর নদী ও নারীর প্রতি সেই সুরের সিম্ফনি ফের শোনা গেলো তৌকির আহমেদ এর শিল্পীত চিত্রায়ণে সেলুলয়েডের ফিতায়।
হুম, ঠিকই ধরেছেন, তৌকির আহমেদের “হালদা”র কথাই লিখতে বসলাম। অভিনেতা তৌকির আমার কাছে যতটা প্রিয় ছিলেন এবং আছেন, পরিচালক তৌকির তার চেয়ে অনেক বেশী মুগ্ধতার সৃষ্টি করেছে আমার মাঝে। এর আগে তাঁর নির্মিত আরো দুটি চলচ্চিত্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। একটি “জয়যাত্রা”, অপরটি “অজ্ঞাতনামা”।
“জয়যাত্রা” ছবিটি যখন মুক্তি পায়, আমার প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবন তখন প্রায় শেষ প্রান্তে। ঠিক সেই সময়েই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার অধিকারী হুমায়ুন আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন “শ্যামলছায়া”। কাকতলীয়ভাবে দুটি ছবির উপজীব্যই ছিলো মুক্তিযুদ্ধ এবং দুদল নৌকাযাত্রী পলায়নপর মানুষের গন্তব্যে পৌঁছার “দ্য লংগেস্ট হান্ড্রেড মাইলস” এর কাহিনী। আর বিস্ময়কর ব্যাপার যে দুটি ছবিরই সমাপ্তি ঘটে মুক্তিসংগ্রামের মহামন্ত্র “জয় বাংলা” শংখনিনাদের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সুশীল আর জটিল “যদি কিন্তু তবে” টাইপএর বিশ্লেষণে না গিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে যদি সত্য স্বীকারে ব্রতী হই, তবে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে, মানের দিক দিয়ে “জয়যাত্রা”র অবস্থান “শ্যামলছায়া”র চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে।
হুমায়ুন যেভাবে একটি রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের সময়টিকে চিত্রায়িত করতে গিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ “সেন্স অফ হিউমার” প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন, তৌকির তাঁর ধারেকাছেও যাননি। বরং ফুটিয়ে তুলেছিলেন যুদ্ধকালীন সিভিলিয়ানদের জীবন বাঁচানোর জন্মযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র। ফলে ছবিটিও হয়ে উঠেছিলো অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য। জানিনা, এই কথাটি বলার ফলে কারো হুমায়ুনাভূতি আহত হলো কিনা। কিন্তু আপন মনের প্রকৃত ভাবনাটুকুই অকপটে তুলে ধরলাম। এরপরে “অজ্ঞাতনামা”তেও শুনতে পেলাম আরেক “তারেক মাসুদ” এর আগমনের পদধ্বনি যেন। ফারুকী জেনারেশনের ভিড়ে তৌকিররাও যে হারিয়ে যাননি সেটি পরিষ্কারভাবেই জানান দেন “অজ্ঞাতনামাতে”।
আর এবার সবাইকে কাপিয়ে দিলেন “হালদা” দিয়ে। হালদা চলচ্চিত্রের মূল নাটকটি প্রকাশ করেছিলো লিটলম্যাগাজিন ‘নোঙর’। তাও চার বছর আগের কথা। তখন অর্ধশতাধিক পৃষ্ঠার এ লেখাটির নামকরণ করেছিলাম ‘মৎস্যগন্ধা’। পরবর্তীতে ‘হালদার হাসি’ নামে চিত্রনাট্যের আমূল পরিবর্তন করে জমা দেওয়া হয় সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রের জন্য। কিন্তু সেটি অনুমোদন পায়নি। সর্বশেষ তৌকীর আহমেদের পরিচালনায় আলোর মুখ দেখল ‘হালদা’।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীকে উপজীব্য করে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়েছে এর আগে। অদ্বৈত মল্ল বর্মণের কাহিনী অবলম্বনে ঋত্বিক ঘটক নির্মাণ করেছিলেন, “তিতাস একটি নদীর নাম”, যেমন গৌতম ঘোষ নির্মাণ করেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর কাহিনী নিয়ে “পদ্মা নদীর মাঝি”। এছাড়া তানভীর মোকাম্মেল এর “নদীর নাম মধুমতি”, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র “ধীরে বহে মেঘনা” ও নির্মিত হয়েছিলো নদী আর মানুষের মিথস্ক্রিয়াকে আবর্তন করেই।
হালদা চট্টগ্রাম জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার এবং নদীটির প্রকৃতি সর্পিলাকার। হালদা খালের উৎপত্তিস্থল মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের পাহাড়ী গ্রাম সালদা। সালদার পাহাড়ী র্ঝণা থেকে নেমে আসা ছড়া সালদা থেকে হালদা নামকরণ হয়। সালদা নদী নামে বাংলাদেশে আরো একটি নদী আছে যেটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে উৎপন্ন ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
প্রতিবছর হালদা নদীতে একটি বিশেষ মুহূর্তে ও বিশেষ পরিবেশে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস ও কার্প জাতীয় মাতৃমাছ প্রচুর পরিমাণ ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার বিশেষ সময়কে “তিথি” বলা হয়ে থাকে। মা মাছেরা এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত শুধু অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে অনুকূল পরিবেশে ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার এই বিশেষ সময়কে স্থানীয়রা “জো” বলে। এই জো এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অমাবস্যাবা পূর্ণিমা হতে হবে, সেই সাথে প্রচণ্ড বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাত হতে হবে। এই বৃষ্টিপাত শুধু স্থানীয় ভাবে হলে হবে না, তা নদীর উজানেও হতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)