“কী দেখেন?
ধলেশ্বরী নদী দেখি।
নদী তো নাই, শুকাইয়া গেছে?
শুকনা নদীই দেখি।
শুকনা নদীও তো নাই, এইটা তো এখন ধানক্ষেত।”
বিখ্যাত সাহিত্যিক শহিদুল জহিরের চতুর্থ মাত্রা গল্পের এই সংলাপগুলো নিতান্তই অমূলক নয়। শুধুই কি ধলেশ্বরী? পদ্মা, যমুনা, গৌরী, ব্রহ্মপুত্র সব নদীরই শাখা প্রশাখা আজ ধানক্ষেতে রূপান্তরিত হয়েছে এবং দিনে দিনে হারিয়েও গেছে অনেক নদীর প্রবাহ। ছোটবেলায় বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শোনা নদী নিয়ে নানা ধরনের গল্প আজ কেবলই রূপকথা।
আজ আন্তর্জাতিক পর্যটন দিবস। একই সাথে বিশ্ব নদী দিবসও। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের কথা মনে হলে বুকের ভিতর শুধু হাহাকারই বিরাজ করে। বিপুল পর্যটন সম্ভাবনার দেশ আমাদের এই সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ। প্রশাসন ও সরকারের সুনজর পেলে দেশের বিভিন্ন স্থানের নৈসর্গিক জায়গাগুলো হতে পারতো আন্তর্জাতিকভাবে সমৃদ্ধ পর্যটন খাত। কর্মস্থান তৈরি হতে পারতো লাখো মানুষের।
আর বাংলাদেশের নদীর কথা মনে হলেই মনে আসে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর সেই বিখ্যাত উপন্যাসের নামের কথা, কাঁদো নদী কাঁদো। আজ নদী দিবস। আজ নদীর কান্নার কথাই বেশী মনে পড়ছে। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বের আর কোন দেশে এত বাহারি নাম আর বিস্তৃত ডালপালা নিয়ে নদী বয়ে যায় কিনা জানা নেই। নিজেদের হাতেই আমরা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি অসংখ্য নদীকে। অথচ সঠিকভাবে পরিকল্পনা করতে পারলে এইসব নদীকে নিয়ে গড়ে তোলা যেত দেশের পর্যটন খাতের বিশাল অংশকে।
বাংলাদেশ পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্রের দেশ। সুরমা, সোমেশ্বরী দুধকুমারের দেশ।
সরকারি তথ্যমতে শাখা প্রশাখাসহ প্রায় ৮০০ নদ নদীসহ বিপুল জলরাশি নিয়ে ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার জায়গা দখল করে দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকাই শত শত নদীর মাধ্যমে বয়ে আসা পলি মাটি জমে তৈরি হয়েছে। বিশ্বে বিভিন্ন দেশেই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন খাত। লন্ডনের টেমস, ইতালির ভেনিস, মিশরের নীলনদ এসব নদীকেন্দ্রীক পর্যটনের অনন্য উদাহরণ মাত্র। বাংলাদেশের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ সব দিকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নদী ও নদীকেন্দ্রীক জনপদেও আছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের ভূখন্ডজুড়ে জালের মত ছড়িয় ছিটিয়ে থাকা নদীগুলো নিয়ে আছে নানা ধরনের গল্প গান উপকথা। নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিপুল জনপদ। রাজধানী ঢাকার কথাই বলা যাক। আমাদের এই তিলোত্তমা নগরী ঢাকাকে চারদিক থেকেই ঘিরে আছে চারটি নদী। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা আর বালু। নদীর তীরের অপার সম্ভাবনা দেখেই মোঘলরা ঢাকাকে বেছে নিয়েছিলেন রাজকীয় জনপদ তৈরির জন্য। এই বুড়িগঙ্গার বুকেই ভেসে আসতো রাজকীয় সব নৌকা। কালের পরিক্রমায় আমরা যেমন হারিয়েছি আমাদের রাজধানীর জৌলুস তেমনই বিবর্ণ হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু। এই তিন নদীর কোল জুড়েই এখন ময়লার ভাগার। দখলদারিত্ব ও আবর্জনার কারণে তিন নদীই আজ সংকুচিত ও জীর্ণ। অথচ রাজধানীর চারদিকের এই চার নদী হতে পারে ঢাকাবাসীর পর্যটনের প্রধান কেন্দ্রস্থল।
রাজধানীবাসীর এখন অবসর যাপনের কোন জায়গা নেই, নেই প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার কোন নির্ভরযোগ্য জায়গা। চারদিকের নদী দখল পুনরুদ্ধার করে খনন করে, ময়লা আবর্জনা মুক্ত করে যদি পুরনো প্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে স্বচ্ছ জলই হতে পারে পর্যটনের কেন্দ্র। নদীপথ ব্যবহার করেই রাজধানীবাসী চলাচল করতে পারবে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। নদীকে ডাস্টবিন না বানিয়ে আবর্জনামুক্ত করতে পারলে নদীর চারদিকেও হতে পারতো অনিন্দ্য সুন্দর পার্ক কিংবা বাগান।
একই অবস্থা দেশের অন্যান্য অঞ্চলেরও। দেশের বিভিন্ন জনপদেই এখন নদীর কান্নার শব্দই ভেসে আসে। প্রধান প্রধান কয়েকটি নদী ছাড়া শীতকালে বেশীরভাগ নদীতেই পানি থাকে না। পানি না থাকার কারণে পলি জমে নদী হয়ে উঠেছে ফসলের ক্ষেত। ছোটবেলায় গ্রামের বাড়িতে স্কুল থেকে ফিরে যে নদীতে সাঁতার কাটতাম, বন্ধুদের সাথে নানা ধরনের জলকেলি খেলতাম, আজ সেই নদীর জায়গায় চাষ হয় আলু, ধান, মরিচ। ছোটবেলার সেই বুড়িতিস্তা আজ বাঁক বদল করে সরু নালা হয়ে গেছে। নদীকে কেন্দ্র করে চারদিকে যেসব খাল ছিল, যেসব খাল থেকে জেলেরা নানান ধরনের মাছ ধরতো, নেই সেই খালগুলোও। হারিয়ে গেছে শৈশবের সেই মাছগুলো। আর এতসব হারাতে হয়েছে শুধুই নদীকে হারিয়েছি বলে। আজ যদি আমার শৈশবের সেই বুড়িতিস্তা আগের মতো বয়ে চলতো, তাহলে হারাতে হত না আশপাশের খাল, নানা ধরনের মাছ, আর দুরন্ত শৈশবকে।
এই বুড়িতিস্তার দশা গোটা বাংলাদেশের বেশীরভাগ নদীরই। একসময় পদ্মার বুকে বোট ভাসিয়ে রবীন্দ্রনাথ কাটিয়েছেন জীবনের অনেক সকাল সন্ধ্যা। অপরূপ পদ্মার মাদকতায় মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টি করেছেন অমর সব গল্প কবিতা। সেই পদ্মা কি আর সেই আগের রূপে আছে?
এরকম দেশের চারদিকের সকল নদীকে নিয়ে যদি সরকার নতুন করে পরিকল্পনা করে, দূষণমুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর হয়, নিয়মিত তদারকি করে, আর দখলমুক্ত করে তাহলে নিশ্চয়ই প্রকৃতি তার আপন রূপে ফিরিয়ে দেবে নদীগুলোকে। আর নদীগুলো আগের রূপে ফিরতে পারলেই এসব নদীর তীরকে গড়ে তোলা যাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। বাংলার ঐতিহ্য এর নদ নদী। এইসব নদীকেন্দ্রীক জনপদকে নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করলে পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ হতে পারে রিভার ট্যুরিজম বা নৌ পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দেশ। এই রিভার ট্যুরিজম দেশের অর্থনীতিতেও রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
এর মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে বাংলাদেশের নদ-নদী, হাওর ও বিলকেন্দ্রীক স্পটগুলো। সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কাপ্তাই, রাঙামাটি, সিলেট,কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালীতে নৌ পর্যটন-শিল্প গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ ৭ জেলার ৭ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। এটিও বর্তমানে দেশের মানুষের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। তবে, আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করতে এসব জায়গা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে রিভার ট্যুরিজম পর্যটকদের প্রশান্তির ছোঁয়া দিতে পারে। আর এজন্য এক্ষুনি পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নিলে আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হবে নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের রিভার ট্যুরিজম। সারা বিশ্বে মানুষের মনে বয়ে যাবে মেঘনা-যমুনার বাংলাদেশ। পদ্ম-শাপলার বাংলাদেশ।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)