ঘোষণা দেয়া হয়েছিল চা-পাতা। কিন্তু আসলে তা ছিল নতুন ধরনের মাদক, নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস বা এনপিএস। বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে সুদৃশ্য ও চকচকে ‘গ্রিন টি’র প্যাকেটে ভরা এই মাদকের গন্তব্য ছিল ইউরোপ-আমেরিকায়।
ক্যাথিনোন গ্রুপের উদ্ভিদ জাতীয় এই মাদক আফ্রিকায় ‘খাত’ নামে পরিচিত। ইথিওপিয়া থেকে বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে বাংলাদেশে আসে ‘খাত’।
অনেকটা চা-পাতার গুড়ার মতো দেখতে এ মাদকের দাম প্রতিকেজি ১৫ হাজার টাকা। তবে আফ্রিকা থেকে আমদানি হওয়া এই মাদক বাইরের বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করছিল একটি চক্র।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর জানায়, এখন পর্যন্ত ৪-৫টি চালান দেশে এনেছে মো. নাজিম। তার মধ্যে ২টি চালান সে বিদেশে পাঠিয়েছেও। বাংলাদেশে আরো কয়েকজন এ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
এনপিএস অভিযানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস্) ডিআইজি ড. এ এফ এম মাসুম রব্বানী চ্যানেল অাই অনলাইনকে বলেন: নতুন মাদকটির বিষয়ে আমরা জানতে পারার পর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেই। এ কারণে আমরা এ মাদকের চালানটি উদ্ধার করতে সক্ষম হই।
তিনি বলেন, ২০০৮ সালে দেশে ইয়াবাসেবী ছিল মাত্র ৫০ হাজার। কিন্তু বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দেইনি। তাই দশ বছর পর এখন ইয়াবা আমাদের সমাজে একটি ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। তা আমাদের মাথা ব্যথার কারণ।
‘যে কোনো নতুন মাদক আসলেই সেটাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দেশে আসা এনপিএস বা খাত নামের মাদকটি যেন কোনক্রমেই বিস্তার লাভ করতে না পারে সে ব্যাপারে আমরা বদ্ধপরিকর। এর পেছনে কারা রয়েছে সেটা জানতে ইতিমধ্যেই আমরা তদন্ত শুরু করেছি।’
শুক্রবার দুপুর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত একাধিক অভিযানে ৮৬১ কেজি এনপিএসসহ মো. নাজিম নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। উদ্ধার করা এনপিএসের আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ১ কোটি ২৯ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা।
জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র সহযোগিতায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদারের নেতৃত্বে একটি টিম শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৪৬৭ কেজি এনপিএস উদ্ধার করে।
পরে শান্তিনগর এলাকা থেকে এই চালানের মালিক নাজিমকে গ্রেপ্তারসহ তার হেফাজত থেকে আরো ৩৯৪ কেজি এনপিএস উদ্ধার করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম শিকদার চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদন না হয়েও বাংলাদেশী পণ্য হিসেবে ইউরোপ-আমেরিকার দেশে রপ্তানি হচ্ছিল এই মাদক।
‘এই পণ্যের চালান সেসব দেশে আটক হলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে এনপিএসগুলো আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া থেকে অন্তত চার-পাঁচটি দেশ ঘুরে বাংলাদেশে আসে। গ্রিন টি’র মোড়কে এই মাদক আমদানী করে স্থানীয় বাজারে বিক্রির পাশাপাশি নতুন মোড়কে বাংলাদেশী পণ্য হিসেবে বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছিল।’
গত ২৩ আগস্ট থেকেই মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ‘এনপিএস’ জব্দের অভিযান শুরু হয়। চালানটি ইথিওপিয়া থেকে সিঙ্গাপুর, দুবাই হয়ে ২৭ আগস্ট ঢাকায় আসার কথা ছিল। তবে ইতিহাদ এয়ারওয়েজের যে ফ্লাইটে করে তা ঢাকায় আসার কথা ছিল; সেই ফ্লাইট ঢাকায় আসলেও চালানটি আসেনি।
গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিতে চালানটি মালয়েশিয়া, ভারত, পরে আবার সিঙ্গাপুর, দুবাই ঘুরে ৩০ আগস্ট ওই এয়ারওয়েজের আরেকটি ফ্লাইটে করে ঢাকায় আসে। ততোদিনে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চালানের প্রাপক নাজিমকে চিহ্নিতসহ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা শাখা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিতে চালানের কাগজে নওশিন এন্টারপ্রাইজের পরিবর্তে ‘নওয়াহিন এন্টারপ্রাইজ’ লেখা ছিল। এছাড়াও, চালানের তারিখে ৩০ আগস্ট থাকলেও সাল উল্লেখ করা ছিল ২০১৬।
মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান জানান, শুক্রবার দুপুরে চালানের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর বিমানবন্দরের কার্গো এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৬৭ কেজি খাত জব্দ করা হয়।
ওইদিন রাতেই শান্তিনগর এলাকায় ‘নওশিন এন্টারপ্রাইজ’ নামে একটি অফিস থেকে মো. নাজিমকে গ্রেপ্তারসহ ৩৯৪ কেজি খাত উদ্ধার করা হয়।
মেহেদী চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, গ্রেপ্তার নাজিমকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সে আগে কাজের সূত্রে দুবাই ছিলেন। সেখানে ইথিওপিয়ার এক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেখানে ওই ব্যক্তির সঙ্গে খাত আমদানি করে ইউরোপ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াতে পাচারের চুক্তি হয়। এরপর দেশে ফিরে কয়েকমাস ধরে এই ব্যবসা চালিয়ে আসছিল নাজিম।
দেশের বাজারে এ নতুন মাদকের বাজার সম্পর্কে গ্রেপ্তার হওয়া নাজিম জানায়: ঢাকায় এনে এক/দেড় কেজি করে নিজস্ব ব্র্যান্ডের চায়ের প্যাকেটে ভরা হতো। এরপর গ্রীন টি হিসেবে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পাঠাতো সে।
চাহিদা অনুযায়ী দেশের বাজারে প্রতিকেজি ১৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হতো। দেশে এই মাদক নতুন বলে এর বাজার অল্প, মূলত রপ্তানির উদ্দেশ্যেই এগুলো আমদানি করা হতো।
শনিবার সকালে থানা পুলিশের মাধ্যমে নাজিমকে কোর্টে চালান করা হয়। পরে বিচারক তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।