স্বাধীনতার চার দশক পরে আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি যখন বাংলাদেশ নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়ানোর কথা জানান দিচ্ছে বিশ্বকে। ২০১৫ সালের বিজয় দিবস একটু অন্য রকম এবার আমাদের সবার কাছে। জাতির কলঙ্ক তিলক একে একে উপড়ে ফেলার মাধ্যমে সত্যিকারের নতুন এক ভোরের আগমনী বার্তাই দিচ্ছে আমাদের সবাইকে।
বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছিলো। সেই জন্মযুদ্ধের বিরোধীতা করে পকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছিলো জামায়াতে ইসলামী এবং তার তৎকালীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। তারা ছিলো মূলত আমাদের বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টার মাইন্ড। ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতৃত্বেই গঠিত হয় কুখ্যাত আল-বদর বাহিনী। তারা আমাদের সূর্য সন্তানদের স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে তাদের আবাসস্থল থেকে তুলে নিয়ে যেয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
বাংলাদেশকে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী করতেই পাকিস্তানী সেনারা তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় বাংলাদেশকে ঠেলে দেয় এক নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে। গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে আমাদের জাতীয় জীবনে। এক অন্ধকার ভয়াবহ অধ্যায় শেষ করে বাংলাদেশ ঠিকই ১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর বিজয়ের গৌরব অর্জন করে।
জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য যে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় জাতির জনকের হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে পকিস্তানী ভাবধারায় প্রতিষ্ঠার রাজনীতি শুরু করে জিয়াউর রহমান। তারই ধারাবাহিকতায় জিয়াপত্নী বেগম খালেদা জিয়া চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদেরকে নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করে। শহীদের রক্তে রঞ্জিতদের হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশের পতাকা।
স্বজন হারানো মানুষগুলো দীর্ঘ চার দশক ধরে ন্যায় বিচার পাওয়ার দাবি নিয়ে আবেদন করে আসছিলো। কিন্তু দীর্ঘ ৪৫ বছর স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে দিন যাপন করছিলো যেই সব মানুষেরা তারা সেই স্বজন হারানোর বিচার পেয়েছে এই ২০১৫ সালে। অত্যন্ত আনান্দের বিষয় হলো এই বছরই আমরা তিনজন নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করতে পেরেছি।
আর এই বিচার কার্যকর করা সম্ভব হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে। তিনি সকল বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন বলেই আজ স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমরা জাতির কপালে জমে থাকা কলঙ্ক তিলক মুছে ফেলতে পারছি। আমরা সবাই জানি এ পথ বড় কঠিন। প্রতিটি পদে পদে বাধা বিপত্তি।
বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি থেকে শুরু করে মানবাধিকারের দোকানগুলোও আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে নাক গোলানোর মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের আগে আগে স্বয়ং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি পর্যন্ত ঘাতকের পক্ষ নিয়ে শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলো ফাঁসি না দেয়ার জন্য।
শেখ হাসিনা একটু অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। প্রজন্মের কাছে দেয়া তার ওয়াদা রক্ষায় তিনি ছিলেন হিমালয়ের মত অবিচল। তিনি ক্ষমতাধর জন কেরিকে না বলে দিয়েছিলেন দেশের মানুষের কাছে দেওয়া ওয়াদা রক্ষার জন্য। এমন পরিস্থিতি এক দশক আগেও কেউ কল্পনা করতে পারেনি যে, বাংলাদেশ আমেরিকার মত একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরাসরি না করে দিতে পারে বা তার দেশের কোন রাষ্ট্রদূত ৫ বছর প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চেয়েও পাননি। এমন সবকিছুই সম্ভব হয়েছে শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে। আর এই বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে শেখ হাসিনার জীবনই সব থেকে বিপদের মাঝে। তাকে প্রতিটি ক্ষণ বুলেট তাড়া করছে।
১৪ ডিসেম্বর ২০১৫ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসউপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বুদ্ধিজীবী হন্তারক সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারে তার সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা তুলে ধরে বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে দেশ প্রথম কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। এখন একটি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হচ্ছে, একধাপ করে এগিয়ে যাচ্ছে ও অভিশাপমুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ।
পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করতে পারে। আর দেশের মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে চায়, তারাও যুদ্ধাপরাধী। একদিন তাদেরও বিচার হবে। দেশবাসীকে বলব যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদেরও ঘৃণা ও ধিক্কার জানান। যতদিন দেশকে সম্পূর্ণ অভিশাপ ও কলঙ্কমুক্ত করা না যাবে, ততদিন দেশের মঙ্গল হবে না।
শেখ হাসিনার চলার পথ কখনোই মসৃণ ছিলো না। পাহাড়সম বাধা অতিক্রম করেই তিনি আজ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তিকেই বড় করে দেখেছেন। দেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি, তথ্য-প্রযুক্তি সব দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। নারী স্বাধীনতায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন নেতৃত্ব দিচ্ছে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের নারী-পুরুষ বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এখন। আগে কেউ কল্পনা করতে পারতো না বড় দাতা সংস্থার ঋণ ছাড়া দেশের কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বিশেষ করে পদ্মাসেতুর মত বৃহৎ প্রকল্প।
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প পদ্মা সেতু করতে গিয়েও বারংবার তিনি বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো কথিত দুর্নীতির কথা বলে আমাদের স্বপ্নের পদ্মাসেতু থেকে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাংকের এই সরে দাঁড়ানোর পেছনে ছিলো দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র। তার পরেও শেখ হাসিনা দমে যাননি। দমে যাওয়ার পাত্রী তিনি কখনো ছিলেন না, এখনো না। তার বাবার মতই একগুয়ে, একরোখা।
বঙ্গবন্ধু যেমন ফাঁসি কাষ্ঠের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন আমি বাঙালী, আমি মানুষ। বাঙালী একবার মরে দুইবার মরে না। তেমনি শেখ হাসিনাও মরে যাওয়ার আগে মরে যাননি। ভয়ে কুঁকড়ে যাননি। সরে আসেননি তার চিন্তা থেকে। তিনি যখন বললেন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরী করবেন, তখন অনেকেই হেসেছিলো। অনেকেই বিশ্বাসই করতে পারেনি নিজের টাকায় পদ্মাসেতু হবে। তবুও শেখ হাসিনা মাথা উঁচু রখেছেন। তিনি নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। তিনি কারো কাছে মাথা নত না করে জাতি হিসেবে আমাদের মাথাকেই উঁচু রেখেছেন।
তিনি পদ্মাসেতু করতে গিয়ে মাথা উঁচু রাখার সংকল্পের কথা আমাদের জানিয়েছেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘ধার করে ঘি খাওয়ার চেয়ে নিজের শক্তিতে নুন খাওয়াই বড় কথা। ভিক্ষা করে বিলাসিতা নয়, কুঁড়েঘর থাকলে কুঁড়েঘরেই থাকবো। তাও কারোর কাছে হাত পাতবো না। মাথা নত করবো না। বাংলাদেশের মানুষকে সেই চেতনা নিয়েই থাকতে হবে। তিনি বলেন, কোনো কাজ করতে গেলে, সিদ্ধান্ত একবার নিলে সেটাই অটল থাকতে হবে।
আর পদ্মাসেতু যখন বাস্তবায়িত হবে তখন আমি এ দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গর্ব করে বলতে পারবো এই সেতু আমার টাকায় করা, আমাদের টাকায় করা। এমন গর্বের ভাগিদার করার সুযোগ দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন এবং তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা। এমন সাহসের উচ্চারণকে আমাদের শ্রদ্ধা করতেই হবে। তিনি সামনে থেকে নেতত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে পৌঁছে দিক সামনের কাতারে এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। তাই তিনিই আমাদের আগামী দিনের সামনে চলার স্বপ্ন সারথী।
যে বিশ্বব্যাংক আমাদের পদ্মাসেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলো বিপদে ফেলার জন্য সেই বিশ্বব্যাংকেরই প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসু বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিস্ময়কর ভাবে এগিয়েছে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ অবশ্যয় একটি ফ্যাক্টর। স্বাধীনতার চার দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এক কথায় সবাইকে বিস্মিত করেছে। উন্নয়নের হাওয়া লেগেছে গ্রাম থেকে গ্রামে। আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছি উন্নয়নের পথ ধরে, তবে যেতে হবে আরো বহুদূর।
বাংলাদেশ হাজারো সমস্যার মধ্যে থেকেই জেগে উঠবে। চার দশক আগে একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার যে প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশে উপহার দিয়েছিলো আমাদের পূর্ব পুরুষরা তাদের সেই স্বপ্ন পূরণের পথে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছি আমারা।
যুদ্ধাপরাধীদের মত জাতির অভিসাপের সব কলঙ্ক মুক্তি ঘটলে কমে আসবে মৌলবাদের রাজনীতি, জঙ্গিবাদের হুমকি। নতুন এক বাংলাদেশে উদ্ভাসিত হবে আমাদের চারপাশের সমস্ত সম্ভাবনা। বিজয় দিবস এবং নতুন বছরকে সামনে রেখে এই শুভ প্রত্যাশা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)