একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর যেদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় ভারত আর ১৬ ডিসেম্বর যেদিন ঢাকায় যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তান, ওই দুটি দিনে ভারতের সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কী ভাবছিলেন আর কী করছিলেন তার আরো বিস্তারিত উঠে এসেছে নতুন একটি বইয়ে।
‘জি পি ১৯১৫-১৯৯৫’ বইটির লেখক অশোক পার্থসারথী। মূলতঃ তিনি তার পিতা জি পার্থসারথীকে নিয়ে বইটি লিখেছেন। জি পার্থসারথী সেসমসয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। অশোকও ছিলেন ইন্দিরার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা।
কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বাবা জি পার্থসারথীর মতো অশোক পার্থসারথীও ‘ইতিহাসের এখনও পর্যন্ত না-লেখা পাতাগুলির’ সাক্ষী থেকেছেন।
৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বইটিতে একাত্তরের ৩ ডিসেম্বরের বর্ণনা দিয়ে অশোক পার্থসারথী জানাচ্ছেন: এক দিন আগেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সোভিয়েট ইউনিয়নের কেজিবি এবং অন্যান্য সূত্রে খবর এসে গেছে যে ৩ তারিখেই পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করতে চলেছে। এমনই এক থমথমে ভোরে ৬টার সময় ব্যক্তিগত সচিব এন কে শেষন-কে ফোন করলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। জানালেন তিনি গুয়াহাটি যেতে চান। মাথায় হাত সাউথ ব্লকের। এমন সময় দিল্লি ছাড়ার কথা কেন ভাবছেন ইন্দিরা গান্ধী!
অশোক পার্থসারথী লিখেছেন: শেষন তৎক্ষণাৎ আমাকে ফোন করেন। খবরটা জানান। তার একটু পরেই প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের ফোন আসে। উনি বলেন, অশোক, ঘটনা শুনেছ? ইন্দিরাজি গুয়াহাটি যেতে চাইছেন! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাড়ি যাও আর তাকে আটকাও। উনি তোমাকে খুব পছন্দ করেন, তোমার মতামতকে গুরুত্ব দেন।
‘আমি বলি, স্যর আমি তার বিজ্ঞান প্রযুক্তি উপদেষ্টামাত্র। আর আপনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু আপনিও তার বাড়ি যান। এর পর সাড়ে সাতটার মধ্যে আমি ইন্দিরাজির বাড়ি পৌঁছে যাই। তাকে বলি ম্যাডাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সবাই ঘাবড়ে গেছে আপনি গুয়াহাটি যাচ্ছেন শুনে। আমাদের সবার চেয়ে আপনি ভাল জানেন, আজকের দিনটার গুরুত্ব! কেন তা-ও যাচ্ছেন গুয়াহাটি?’
বইয়ের ভাষায়: ইন্দিরা গান্ধী বলেন, অশোক গোটা বিশ্বকে আমি বোঝাতে চাই, এই অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধটা আমরা শুরু করিনি। ইয়াহিয়া খান আর টিক্কা খান— এই দুই স্বৈরাচারীকেই শুরুটা করতে দাও না! আমি তাকে বলি, দিল্লিতে বিমানহানা হতে পারে। ইন্দিরাজি শুধু বলেন, হতে দাও। এর পর সটান গুয়াহাটি চলে যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে দিনভর বৈঠক এবং জনসভা সেরে সন্ধ্যা ছ’টায় দিল্লি ফেরেন। ইতিমধ্যে শ্রীনগর, আদমপুরের মতো বড় বিমানঘাঁটিগুলিতে পাকিস্তানী বিমান সেনা বোমা ফেলতে শুরু করেছে।
‘বিমানবন্দর থেকে সোজা সাউথ ব্লকে পৌঁছান ইন্দিরা। সেখানেই সেনাবাহিনীর হাতে সরকারি ভাবে যুদ্ধের ফরমান তুলে দেওয়া হল। সেই রাতেই ন’টা নাগাদ পাকিস্তানের করাচি বন্দর দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। ভারতীয় সেনা এগোতে থাকে দু’টি ফ্রন্টে। পশ্চিমে পঞ্জাব এবং সিন্ধু প্রদেশ, অন্য দিকে পূর্বে ঢাকা, শ্রীহট্ট (সিলেট) এবং চট্টগ্রাম জেলা দিয়ে।’
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১
আনন্দবাজার পত্রিকা জানাচ্ছে, একাত্তরে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ করার দিনটিতে বিস্ফোরক বৈঠকের বিশদ বর্ণনা রয়েছে বইটিতে সময়ের ধুলো ঝেড়ে যা মলাটবন্দি করেছেন অশোক।
তিনি লিখেছেন: ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর সাউথ ব্লকের ১৫৫ নম্বর ঘরটিতে উপস্থিত তৎকালীন মন্ত্রিসভার রাজনীতি বিষয়ক কমিটির সদস্যরা (অর্থমন্ত্রী ওয়াই বি চহ্বাণ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম, বিদেশমন্ত্রী স্বর্ণ সিংহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি) তিন বাহিনীর প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এন হাকসার, ‘র’ প্রধান আর এন আই কাও, জি পার্থসারথী এবং লেখক নিজেও।
কিছুক্ষণ আগেই সোভিয়েট খামে একটি চিঠি এসে পৌঁছেছে সাউথ ব্লকে। স্বাক্ষরকারীর নাম লেয়োনেদ ব্রেজনেভ! যুদ্ধে জয় লাভের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট ইন্দিরাকে লিখেছেন, ‘আপনি যা করেছেন তা এক অনন্য কাজ। একটি নতুন দেশের জন্ম দিয়েছেন। এ বার আপনার এবং আপনার মন্ত্রিসভার সতীর্থদের একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পালা। পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে। সোভিয়েট ইউনিয়নের পলিটব্যুরো নিশ্চিত, আপনারা সব দিক বিবেচনা করে ঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। যে সিদ্ধান্তই আপনারা নিন না কেন, সোভিয়েট ইউনিয়নের নিঃশর্ত সমর্থন আপনার জন্য থাকবে।’
মস্কোর কাছ থেকে এই বার্তা পাওয়ার পর ইন্দিরা একবারের জন্য হলেও যে ভঙ্গুর পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা পাঠিয়ে পেশোয়ারের দখল নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন, তা অশোক বর্ণিত বৈঠকটির বিবরণ থেকে স্পষ্ট। সেই বৈঠকে মানেকশ-র উত্তর পাওয়ার পর চেয়ার ঘুরিয়ে টেবিলের অন্য দিকে বসা মন্ত্রী এবং সচিবদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন ইন্দিরা। প্রায় সবাই-ই সে দিন বলেছিলেন পেশোয়ারে সেনা পাঠাতে এবং কালক্রমে পশ্চিম পাকিস্তানকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে নিতে।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এরপর হাকসারের মতামত জানতে চান। হাকসার বলেন, ‘ম্যাডাম, স্যাম যা বলছেন তা করে দেখাতে তিনি সক্ষম, এটা আমি জানি। কিন্তু আমাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমরা কি পাকিস্তান দখল করব? যদি করি, তা হলে প্রথমে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ হয়তো বলবে ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান মুর্দাবাদ। হিন্দু মুসলিম ভাই-ভাই। কিন্তু ছ’মাস পর কী হবে সেটাও ভেবে দেখতে হবে। তখন কিন্তু আওয়াজ উঠবে ভারতীয় সেনা মুর্দাবাদ, হিন্দুরা ফিরে যাও।’
লেখক জানাচ্ছেন, হাকসারের বক্তব্য শেষ হওয়ার পরই হাত তোলেন জগজীবন রাম। বলেন, ‘ম্যাডাম, হাকসার সাহেব ভুল বুঝছেন। আমরা কেউই আসলে পশ্চিম পাকিস্তান দখল নেওয়ার কথা বলছি না। ৪৮-এর যুদ্ধে বলপূর্বক যে সব ভূখণ্ড পাকিস্তান ছিনিয়ে নিয়েছিল, যেমন পাক অধিকৃত কাশ্মীর, গিলগিট, বালটিস্তান, সেগুলি তারা ফেরত দিক, এটাই চাইছি।’
সব শুনে মৃদুকণ্ঠে ইন্দিরা কেবল বলেছিলেন, ‘আমি ভেবে দেখছি।’ বৈঠক শেষ হওয়ার পর ইন্দিরা অশোক পার্থসারথীকে নিয়ে তার বাড়ি যান। অশোক লিখছেন, ‘আমার পিঠে হালকা চাপড় মেরে উনি বলেছিলেন, অশোক, আমি জানি তোমরা কী চাইছ। কিন্তু প্রবল গুরুত্বপূর্ণ এক সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হবে।’
সে দিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ইন্দিরা। পশ্চিম পাকিস্তানে সেনা না-পাঠানোর সিদ্ধান্ত। রাত ৮টায় অল ইন্ডিয়া রেডিওর সম্প্রচারে যুদ্ধ বিরতির কথা ঘোষণা করেন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।