আমাদের সমাজের মূল্যবোধগুলো খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখনকার চালু অ্যাটিটুড-ইংরেজিতে যাকে বলে ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’, আর বাংলায় ‘যতো বড় পাঁঠা ততো বড় আসন’। সুবোধ, শান্ত অথচ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জেনারেশন এখন সমাজ থেকে উধাও। এখন ঘাড়ত্যাড়া, টেটিয়া, একরোখা, রাগি মানুষরা সমাজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের প্রধান আদর্শ ও লক্ষ্য হচ্ছে, ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’। অন্য কারো জন্য নয়, নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির জন্যই তারা লড়ে এবং প্রয়োজনে মরে।
অবশ্য আমাদের মতো বহুতর বিত্তভোগী নাগরিকের দেশে, বিত্ত ও চেতনার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী, ভালো থাকার শর্ত প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা এবং স্বপ্নপূরণ, দুই-ই শ্রণি নির্ভর। এই শ্রেণি কেবল বিত্তের নিরিখে নয়। পেশা, ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, জাত, শিক্ষাস্তর, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি নানা বৈশিষ্ট্য শ্রেণি বিভাজনে ব্যবহৃত হয়। রাজনীতিতে যত বাণিজ্যিকীকরণ ঘটছে, তত শ্রেণি, উপশ্রেণির জন্ম হচ্ছে। ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এক-একটি অংশের দণ্ডমুণ্ডকর্তা হয়ে ওঠার সহজতম পন্থাই এই। ব্রিটিশের আমলে কথাটি ছিল ভাগ কর এবং শাসন কর, এখন হয়েছে ভাগ, দখল, ক্ষমতা।
এরপর ভয়ে ভয়ে লুঠপাট কথাটি লিখলেও মোটেই ভুল হবে না। বাংলাদেশর রাজনীতিতে কিছু প্রকাশ্যে, কিছু আড়ালে এই দুষ্টচক্র গোড়া থেকেই ছিলো, আজও বেরোতে পারেনি। অবক্ষয় এমন অধোমুখী ও দ্রুত যে নীতি ও আদর্শ বলে রাজনীতিতে কিছু ঠাঁই পাচ্ছে না। ক্ষমতা ও সুবিধার খুল্লমখুল্লা লেনদেন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আর তা বিস্তৃত হচ্ছে বৃহত্তর সমাজে।
একটা বেপরোয়া ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সবখানে। গো টা পৃথিবী কাঁসার বাসনের মতো ঝনঝন বাজছে। নিয়ত খার বাড়ছে বলে বিদ্রোহও বেড়ে গেছে। সবাই ষণ্ডা-গুণ্ডার মত আচরণ করছে। মিনিমাম টলারেন্সি নেই। কেবলই অশ্লীল গালাগাল। দমাদ্দম টেবিল চাপড়া, বাপের বয়সি টিচারকে ধাঁইসে ধাক্কা মার। এখন জুটেছে ফেসবুক-ভাইবার। গুজব ছড়ানোর মহান যন্ত্র। ফেসবুকে কিছু ছেলেপুলে ঘুম থেকে উঠেই অতি বিখ্যাত নাতি বিখ্যাত পাতি বিখ্যাতকে চার অক্ষর পাঁচ অক্ষরে ধুইয়ে ছ’প্যারাগ্রাফ লিখে ফেলে। তাতে যুক্তি খুব নেই, কিন্তু বিদ্বেষ, বিষকেত্তন পর্যাপ্ত।
ব্যস, গন্ধ-শুঁকশুঁক হায়না-বন্ধুরা হাঁইহাঁই লাফিয়ে পোস্টটাকে সাংঘাতিক লাইক জানায়, তারপর বাছাই খিস্তি দাবড়ে আজকের শিকারটিকে ছিঁড়তে খুঁড়তে লেগে যায়। এরা নির্ঘাত নিজেদের বাতলিয়ে নেয়: আত্মত্যাগী কালাপাহাড়। পবিত্র সাবোটাজের মিশনে গতর ও মনীষা হাঁকড়ে শাঁ-ঝক্কাস সমাজ আনছে। সেল্ফি তুলে আত্মবিনিয়োগ ফাঁপাতে পারত, সে আরাম ছেড়ে অন্যকে নাগাড়ে অপমান করার ক্রস স্ব-ঘাড়ে বহন করল! এই অ্যাঙ্গলটা অনেকে বোঝে না।
অসৌজন্য অসৌজন্য বলে লাফায়। আরে ‘সৌজন্য’ জিনিসটা কী? মনে এক, মুখে পোলাইট আর এক-এই তো? আমাদের আদর্শ কী? ক্রিকেট। আমাদের আইকন কারা? ক্রিকেটাররা। আমাদের শিক্ষক কে? টিভি। তো আমরা তাদের কাছ থেকে কী শিখছি? সদ্যসমাপ্ত আইসিসি টি-টুয়েন্টি ফাইনালে ভারত অধিনায়ক ধোনি যেমন প্রেস কনফারেন্স-এ অস্ট্রেলীয় সাংবাদিককে পাশে বসতে ডাকলেন, ঔদ্ধত্য ও কিঞ্চিৎ র্যাগিং-আমোদ মিশিয়ে।
ও-ভাবে লোফারেরা ডাকে বেপাড়ার প্রেমিককে। সাংবাদিক প্রথমে আসতে চাননি। কিন্তু এ তো আহ্বান নয়, আদেশ নিশ্চয়। ধোনি হেসে, পাশে বসালেন, এক হাতে পাকড়ে ধরলেন। সাংবাদিকটি প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি কি এই টুর্নামেন্টের পরেও খেলবেন? এ বার ধোনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি চান আমি রিটায়ার করি? অসামান্য ঘুরন-স্কিল! প্রশ্নটাকে ধোনি রিপোর্টারের নিজ বাসনার স্লটে ফেলে দিচ্ছেন: ‘আপনি কি চান’…? সাংবাদিক, তড়িঘড়ি: ‘না, না।’
তারপর , বিদ্রূপে চুবিয়ে, ধোনি: আপনি কি মনে করেন আমি আস্তে রান নিচ্ছি? ২০১৯ অবধি খেলতে পারবো? সাংবাদিক তো মহাতারকার শ্বাসপরিধির মধ্যে বসে নেগেটিভ উত্তর দিতে পারেন না। ফলে ধোনির ছক্কা! এইটা অভদ্রদের সেরা মজা: শিক্ষিত বা ভদ্ররা প্রত্যাঘাত করতে পারবে না, অন্তত অতটা কুৎসিত ভাবে পারবে না, এটা জেনে আঘাত আছড়াবার মধ্যে মস্তিটা শিয়োর-অর্গাজম পায়।
ফলে ভারত-অধিনায়ক অবসর নেওয়ার প্রশ্নে ব্যাকফুটে তো গেলেনই না, রিপোর্টারকেই সব ডেকোরাম ভেঙে পাশে বসিয়ে তামাশা মচিয়ে এমন ফল্স পোজিশনে ফেলে দিলেন, সে বিশ্বের খোরাক হয়ে গেলো। এটাই স্টাইল। যেভাবে পার অন্যকে অপমান কর। এখন যুগ এসেছে, পান থেকে চুন খসলেই ইতরের মতো রেগে ওঠো, অপ্রত্যাশিত লালচে হও, তার পর ‘অপোনেন্ট’কে থ্র্যাশ করো। ডাউন দাও। যতটা সম্ভব কদর্য ভাবে। সেটাই জয়ীর অটোগ্রাফ।
এর আগে আমাদের তামিম-সাকিবরাও দর্শক দাবড়ে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে নিজেদের ‘বীরত্ব’ জাহির করেছিলেন। শাহাদাৎ তো শিশু নির্যাতন করে ‘দৃষ্টান্ত’ই গড়ে ফেললেন। এখন কেউ কাউকে কিছু বললে, এমনকি না বললেও তেড়ে-ফুঁড়ে যেতে হবে। এর মাধ্যমে একরোখা, রগচটা অ্যাটিটুড, সেটা তো দেখানো গেলো। ‘পরোয়া করি না রে, ঠাটিয়ে থাবড়াব’ তো প্রচারিত হল। এটাই এখন ‘ইন’।
এই তো বিশ্বকাপ জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারলন স্যামুয়েলস প্রেস কনফারেন্স করলেন টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে। নয় কেন? মিডিয়ায় কেউ না কেউ কখনও না কখনও তো ওর বিরুদ্ধে লিখেছেন, ওর টিমকে হেলাছেদ্দা করেছেন।
তা হলে তাদের লাথি দেখানো যাবে না? বিদ্যাসাগর মশাই অভদ্র সাহেবের দিকে পা তুলে দিয়ে খেলা ‘১-১’ করেছিলেন বলে আমরা তাকে হিরো বানাইনি? এই স্যামুয়েলস একটু আগে, ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েই, আত্মমর্যাদার সব চালু সংজ্ঞাকে লাথিয়ে, মাঠে দাঁড়িয়ে তার নিন্দুক শেন ওয়ার্নকে এক হাত নিয়েছেন, ব্যঙ্গ করে তাকে ট্রফিটাও উৎসর্গ করেছেন।
এও বলেছেন, ‘আমি মাইকে জবাব দিই না। ব্যাটে দিই।’ প্রেস মিটে মাইক পেয়ে সেই শেন-কেই ফের থুড়ে দাবড়ানি। তার পরেই ইংল্যান্ডের স্টোকসকে বাক্যিধোলাই। মাঠে স্টোকসের সঙ্গে প্রকাণ্ড স্লেজাস্লেজি হয়ে গেছে, স্যামুয়েলসের জরিমানাও হয়েছে সে জন্য। তো? নেকুপুষু মেনিমুখো পাতিবুর্জোয়া ভদ্রতার ধারণা এদের নেই।
এরা বীর। এদের থিম হলো, মারো শালা। সপাটে মারো, স-ডাঁটে মারো। ঘ্যাঁক কামড়ে দেওয়াই এখন স্মার্টনেসের ঝলমল পতাকা। এবং তা-ই তো ঠিক। ভেতরে ভেতরে গজরাব, আর মুখে মিঠে সৌজন্য দেখাব, সেটাই কি ধাষ্টামি নয়? মানুষ তাই এখন অভদ্রতার তুমুল ফ্যান।
যে টিভি-অ্যাংকর পুরো অনুষ্ঠান গাঁকগাঁকিয়ে চিল্লান, ধমকান এবং আমন্ত্রিত অতিথিদের আদ্ধেককে যাচ্ছেতাই অপমান করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ, জনপ্রিয়। যে নেতা যতো বেশি উদ্ধত, যার যতো বেশি কলঙ্ক, সে ততো বেশি জনপ্রিয়।
কারণ লোকে বুঝেছে, ভদ্রতা আসলে একটা দুর্বলতা। ওর আসল মানে ভীরুতা। আর অভদ্রতা মানে: সাহসী সমালোচনার ধক, অপ্রিয় সত্য ওগরাবার বুকঠোকা দৃঢ়তা, মুখোশহীন, আবরণহীন ইটের ঢ্যালা। ডিকশনারিটা স্বল্প ঝাঁকিয়ে নিতে হবে, এই যা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)