চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ধুলায় অতিষ্ঠ জীবনে অশনি সংকেত

রাজধানীর সমস্যা-১

এ ধরনের লেখা কেউ পড়বে না জেনেও লিখছি। তবুও সময় হলে একটু মনোযোগ দিতে পারেন। আপনার জীবনের সুরক্ষার জন্য হলেও নজর দিতে পারেন। আর না দিলেও আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু আপনার যায় আসবে। আপনার পরিবারের, আপনার সন্তানের কিংবা আপনার প্রতিবেশীর কিছু না কিছু যায় আসবে। অতএব ভাবুন একবার!

আপনি হয়তো এখন বসে আছেন কোনো বাসে। হয়তো তীব্র জ্যামে বসে গরমে অতিষ্ট হয়ে নাক সিটকানো আর গালাগাল করছেন জ্যামকে অথবা সরকারকে। আচ্ছা ঠিক আছে। তা করুন। তবে একটু অন্য বিষয়ে ভাবুন তো। আপনি হয়তো বুঝতেই পারছেন না যে, ট্রাফিক জ্যামের চেয়ে বিধ্বংসী এক সমস্যায় পতিত আপনি-আমি সবাই। যে আত্মঘাতি সমস্যা আমাদের কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। হাজারো দৃশ্যমান সমস্যার মধ্যে অন্তরাল থেকে যে ধুলা-বালু আমাদের শরীর ধ্বংস করছে তা খেয়াল করতে পারছি না।

ঘর থেকে বের হলেই ধুলা। রাজধানীতে প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুম এলেই আমাদের চেনা দুর্ভোগ। পথ চলতে হবে ভারী ধুলার সঙ্গে লড়াই করে। মুখ চেপে, রুমাল বেঁধে, পথচলা নিয়ন্ত্রিত! নয়তো নাকে মুখে ধুলাময় হয়ে যায়। আর তা হার্টে প্রবেশ করে বাসা বাঁধে। তৈরি হয় আত্মঘাতি রোগ-ব্যাধি।

যদি সময় হয় উপরের ছবিটির দিকে খেয়াল করুন। প্রথম দেখায় মনে হবে ট্রাফিক জ্যামের ছবি তোলা হয়েছে। কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে দেখুন, বাসের উপরে কুয়াশার মতো কিছু। কিন্তু এখন তো শীত নয়। কুয়াশা আসবে কোথা থেকে? তার মানে এগুলো ধুলা। বাতাসে ভাসছে। আর প্রবেশ করছে আমাদের হার্টে। অতিষ্ট করে তুলছে জীবন। শরীরে বাসা বাঁধছে নানা প্রকার রোগ। আর আমরা ক্ষণ গুণছি মৃত্যুর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত উন্নয়ন কাজ আর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় ঢাকায় আমরা ভুগছি ধুলা মিশ্রিত বাতাসে। এক্ষেত্রে তারা কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে বেশি দায়ী করছেন। আমিও সেটাই মনে করি। আমাদের দেশের প্রত্যেকটি জায়গায় অসংখ্য কর্মচারী নিয়োজিত। কিন্তু প্রায় সব কর্মচারী নিজ কর্মে অদক্ষ, অগুছালো, অশিক্ষিত, অব্যবস্থাপক। আমরা নিজ কাজটি কিভাবে করতে হবে, নিজ দায়িত্ব কিভাবে পালন করতে হবে সে বিষয়ে জ্ঞাত নই। তবে এটা সত্য, নিজের কাজটি করতে না জানলেও অন্যের কাজের দিকে আমাদের ঠিকই বড় বড় চোখ থাকে। আমরা অন্যের ভুল ধরি। নিজের ভুলগুলো গুম করে দিই।

এই সমস্যাটা রাজধানীর কৃর্তৃপক্ষের মধ্যেও বাসা বেঁধেছে। আর যার বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ, শিকার হচ্ছে জনগণ।

ইবনে সিনা বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সকল রোগের মূল কারণ হলো ধুলা-বালু’

এই মনীষীর বাণী যদি সত্য হয়, তাহলে ধুলা বালু শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ বৃদ্ধি করছে, বাড়ছে ক্যান্সারসহ জটিল রোগ। ধুলার কারণে ফুসফুস ও হার্টের রোগসহ সৃষ্টি হচ্ছে নানা জটিল শারীরিক সমস্যা।

২০১৭ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে যতোগুলো লোক মারা যায় তাদের ২৫ ভাগ মানুষ পরিবেশের কারণে মারা যায়। আর এই ২৫ ভাগের মধ্যে ৭৫ ভাগ মানুষ বায়ুদূষণের কারণে মারা যায়- (সূত্র-ইন্টারনেট)।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা যায় বিশ্বের, সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর বাতাসের শহরের তালিকায় ১৬০০ শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান ২৩তম।

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে ঢাকা। আর শীর্ষে রয়েছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির নাম। ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত মুম্বাই রয়েছে চার নম্বরে। এক কোটি ৪০ লাখ বা তার চেয়ে বেশি জনসংখ্যার শহরগুলোর দূষণের তথ্য সংগ্রহ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এই তালিকাটি তৈরি করেছে (সূত্র: ইন্টারনেট)।

রাজধানীর এই দূষণ আমাদের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলছে। এটিকে প্রাকৃতিক সমস্যা বলা ভুল হবে। মনুষ্য সৃষ্ট সমস্যা এটি।

এই সমস্যা নিয়ে কয়েকজন নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা প্রায় প্রত্যেকেই বলছেন, রাজধানীতে চলা যায় না। এমন বীভিষিকাময় জীবন হয়ে উঠছে বলার সাধ্য নেই। বেশি কিছু বললেও আবার সমস্যা। কিছু অশিক্ষিত চামচা মনে করে, সরকার বিরোধী কথা বলছি। আসলে তো তা নয়। আমার জীবন হুমকির মুখে। তো আমি আমার অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারবো না?

তারা বলছেন, রাজধানীতে চলার সময় মনে হবে,  কুয়াশা পড়ছে। কিন্তু আসলে ধুলা-বালু। ধুলার মধ্যে শ্বাস নেওয়া যায় না। শ্বাস নিতে গেলে কষ্ট হয়। খাবারের দোকানের মধ্যে ধুলা উড়ে পড়ে।

আরো অভিযোগ করছেন, বাচ্চারা যখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে তখন তাদের শরীরে ধূলা বালু লেগে থাকে। নাক-মুখে ধুলায় ভর্তি হয়ে যায়।

জনৈক সাংবাদিক বলছেন, আমি সেদিন তোপখানা রোড থেকে হেঁটে খাওয়ার জন্য একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। রেস্টুরেন্টে হাত মুখ ধোয়ার জন্য বেসিনে গেলাম। নাকে পানি দিয়ে দেখি এতোগুলো ময়লা জমে আছে। মানে কি? সারাদিন প্রত্যেকটি মানুষের নাক দিয়ে এই ময়লাগুলো ভেতরে জমা হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সৃষ্টি হচ্ছে আত্মঘাতি রোগ ব্যাধি।

আপনারা ইদানিং খেয়াল করেছেন কিনা জানি না, ক্যান্সারের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্বাপ্রশ্বাসজনিত রোগের সংখ্যা বাড়ছে। হার্ট অ্যাটাক করে তরুণরাও মারা যাচ্ছে। এগুলো কি মনে করেন প্রাকৃতিক ব্যাপার? এমনটা ভাবলে অপরাধ হবে। এগুলো আমাদের সৃষ্ট সমস্যা।

তিনি বলছেন, আমরা কখনও দেখলাম না সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে ধুলা-বালু নিবারণ করা হয়েছে। অথচ তারা বাজেট পায়। কিন্তু অস্বীকার করবে। বলবে, বাজেট পযাপ্ত নেই। যে বাজেট সরকার নির্ধারণ করেছে তার ৫০ ভাগ ব্যয় করলেও এই সমস্যা সমাধান করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে ১০০ ভাগের ২০ ভাগ বাজেটও সঠিক কাজে ব্যয় হয় কিনা সন্দেহ থেকে যায়। বিভিন্ন ঘাট অতিক্রম করে আসতে আসতে সেই বাজেটের প্রায় ৮০ ভাগই পকেটে ঢুকে। ২০ ভাগ দিয়ে আর কি কাজ হবে!

এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যদিয়েই আমাদের জীবন চলছে, চলছে রাজধানী, দেশ।

মানুষের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য ২৫ ভাগ সবুজায়ন প্রয়োজন। কিন্তু তা নেই ঢাকাতে। নগরীতে যে স্বল্প সবুজ রয়েছে তা থেকে অক্সিজেন নির্গমনের যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তাও বাধা পেয়েছে ধূলার আধিক্যে। তাই সহসাই সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া না হলে অদূরে হয়তো ঢাকা পরিণত হবে ভয়াবহ রোগের নগরীতে। ঢাকা যেন এখন উত্তপ্ত বৈরুত, যেন সাহারা মরুভূমি। থেকে থেকে ধুলা ঢুকছে আমার সমস্ত শরীরে। ধ্বংস করছে আমার জীবন!

অনেক কথা হলো। কিন্ত  সমাধান কী? সমাধান আছে। খুব সহজ। যদি সঠিক কাজটিই করা যায় তবে এই সমস্যা সমাধানে বেগ পেতে হবে না। বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন মতামত থেকে কয়েকটি সমাধানের উপায় বলা যায় যেমন-

১। ব্যাপক সবুজায়ন আর সঠিক পরিকল্পনা পারে মুক্তি দিতে ধুলাযন্ত্রণা থেকে।

২। সিটি করপোরেশনের পানি ছিটানোর স্প্রেগুলোকে সক্রিয় রাখতে হবে।

৩। প্রতিদিন রাত ৪টা থেকে ৭টা পর্যন্ত তারা যদি (সিটি কর্পোরেশন) পানি স্প্রে করে, তাহলে অক্সিজেন প্রাপ্তি বেড়ে যাবে এবং ঢাকা শহরে ধুলাবালি অনেক কমে যাবে।

৪। পৃথিবীর কোনো শহরে প্রতিবছর রাস্তা খুড়াখুড়ি হয় কিনা আমার জানা নেই। প্রতিবছর এই রাস্তা খুড়াখুড়ির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসলে ধুলার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

৫। অপরিকল্পিত পরিবহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। জরাজীর্ণ বাস চলাচল নিষিদ্ধ করা নয় শুধু আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। রাজধানীতে ট্রাক চলাচল সীমিত করতে হবে।

৬। ময়লা ব্যবস্থাপনার সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷

৭। সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং পরিচ্ছন্নতা কর্মীকে উন্নত নগরায়নের প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে।

আসল ব্যাপারটি হলো, কর্তৃপক্ষগুলোর উপরি আয়ের যে ধান্দা সেখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রত্যেককে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে।

ধুলা সমস্যা আমাদের অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে ঢাকাতে বসবাস করার কোনো যোগ্যতা থাকবে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)