ঢাকার আকাশ, বাতাস, রাস্তাঘাট, গাছগাছালি দেখে আমার কেবলই মনে হয় ছেলেবেলায় পড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিস্কার’ কবিতাটির কথা। কবি কী স্পষ্ট করে ঢাকার ভবিষ্যত চেহারা বলে গেছেন এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে, তা ভাবতেই অবাক লাগে –
“ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূর্য।
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
ধুলার মাঝে নগর হলো উহ্য।”
আমাদের প্রিয় নগরী ঢাকা এখন হবুচন্দ্র রাজার সেই ধুলায় ঢাকা একটি তিলোত্তমা নগরী। এখানেও সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে যায় ধুলাবালি দিয়ে। বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে এই নগরীতে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে বসবাস করি ঠিকই, কিন্তু এখানে নগরবাসীকে দিনরাত নাকাল হতে হচ্ছে নানাভাবে। শুধু ধুলা নয়, খানা-খন্দক, রাস্তাঘাট খোড়াখুড়ি, ড্রেন পরিষ্কার, পাইপ বসানো, বৈদ্যুতিক লাইন টানা – কী হচ্ছে না এই শহরে। ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র চোখে ঝাপসা দেখতে হয়। ভাবি শীতের কুয়াশা, কিন্তু না, আসলে ধুলা, ময়লা, কফ, থুতু, বিভিন্ন রোগের জীবাণু উড়ছে। বাতাস এত বেশি পরিমাণে দূষিত যে বাতাস ভারী হয়ে আছে। আর তাই শ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। গ্রামে গিয়ে শ্বাস নিলে পার্থক্যটা পরিস্কার বোঝা যায়। গ্রামের বাতাসে মাটির গন্ধ, আর ঢাকার বাতাসে ধুলার গন্ধ।
সর্দি-কাশি প্রসঙ্গে ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব চেস্ট-এর সাবেক পরিচালক অধ্যাপক রাশেদুল হাসান বলেছেন, “যেসব শিশু ধুলার সংস্পর্শে আসে তাদের ১০০ জন শিশুর মধ্যে ১০ জন শিশুরই এ্যাজমা বা হাঁপানি হয়। আর বড়দের মধ্যে শতকরা ৭ থেকে ৮ জন আক্রান্ত হন ক্রনিক ব্রংঙ্কাইটিসে। তিনি আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন, “ধুলার মধ্যে যদি দূষিত দ্রব্যের কণা মিশ্রিত থাকে, তাহলে তা থেকে হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সার।” এমনটাই তো ঘটছে। ঘরে ঘরে শিশুরা সর্দি, কাশি, জ্বর, হাঁপানিতে আক্রান্ত হচ্ছে। কফ জমে আছে তাদের বুকে। এই সংখ্যাও কিন্তু আশংকাজনক হারে বাড়ছে।
শীতকালে, বিশ্বের সবগুলো নগরীর মধ্যে ঢাকা সম্ভবত সবচেয়ে দূষিত নগরী হয়ে উঠেছে। তথ্যটা জেনে খুবই কষ্ট পেলাম। এতগুলো নগরীর মধ্যে দূষিত হওয়ার দিক থেকে আমাদের ঢাকাকেই প্রথম হতে হলো কেন? ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক এবং লজ্জাকরও বটে। সহজেই বোঝা যাচ্ছে এই প্রথম হওয়ার জন্য ঢাকাকে কতটা অপরিচ্ছন্ন হতে হয়েছে। ২০১১ সালে ঢাকার বাতাস নিয়ে নরওয়েজিয়ান ইন্সটিটিউট ফর এয়ার রিসার্চ এবং ডিপার্টমেন্ট অব এনভায়রনমেন্ট ইন বাংলাদেশ-এর করা একটি সমীক্ষায় এ তথ্যটি উঠে এসেছে।
সেই তথ্য উপাত্ত অনুযায়ী আরো বলা হয়েছে, ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাতাসে ভাসমান বিভিন্ন পার্টিকুলেট এর মাত্রা প্রতি কিউবিক মিটারে ৪৬৩ মাইক্রোগ্রামে পৌঁছেছে, যা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মাত্রার। এরপর আছে মেক্সিকো ও মুম্বাই যথাক্রমে ৩৮৩ ও ৩৬০ মাইক্রোগ্রাম। দিনে দিনে এই অবস্থা আরো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশে বছরে ৩৭ হাজার মানুষ মারা যায় বায়ুবাহিত রোগে। ভাবতেও ভয় হয়, বাঁচার জন্য বাতাস থেকে যে নিঃশ্বাস আমরা নিচ্ছি, সেই বাতাস শুধু দূষিত হওয়ার কারণেই অনেকগুলো রোগ ছড়াচ্ছে এবং তা আশংকাজনক হারে বাড়ছে।
মানিক মিঞার মোড়ে একটি ট্র্র্যাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দেখলাম জনা বিশেক বা তার চেয়েও বেশি সংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু রাস্তা পার হচ্ছেন। তাদের প্রত্যেকের নাক, মুখ, মাথা সব ঢাকা। অনেকেরই মুখে মাস্ক লাগানো। কারণ এখানে রাস্তা কাটাকাটি চলছে গত ৩ মাস যাবত। এখানে আছে স্কুল, হাসপাতাল, অসংখ্য দোকানপাট। ধুলায় চারিদিক অন্ধকার। গাছের একটি পাতাও দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে আছে শত শত গাড়ির ভীড়। নাক, মুখ না ঢেকে চলাচল করার কোন উপায় নেই।
ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে মীরপুর, গুলশান, মৌচাক, মালিবাগ, মগবাজার, যাত্রাবাড়ি, বেড়িবাধ, রামপুরা, মধ্যবাড্ডা এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে জহির রায়হান রোড হচ্ছে নগরীর সবচেয়ে ধুলায় ধুসরিত এলাকা। এত ধুলার মধ্যে বসবাস হওয়া সত্ত্বেও সেদিন যাত্রাবাড়িতে একজনের সাথে দেখা করতে গিয়ে মনে হলো এ আমি কোথায় এলাম? প্রতিটি ঘরবাড়ি, যানবাহন, দোকানপাট সবকিছু এক হাত ধুলার নিচে ঢাকা পড়ে আছে, এমন কী মানুষগুলোও। আমরা যেখানে থাকি সেখানেও সারাদিন শব্দ, ধুলাবালি উড়ছে, সব গাছ সাদা – কিন্তু এরপরও যাত্রাবাড়ীর ওই জায়গাটা দেখে মনে হলো এটা নরকের কোন অংশ। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের এই প্রিয় শহরটা পুরোটাই ধুলার চাদরে ঢাকা একটি শহর।
উন্নয়নমূলক কাজ চলছে বলে বছরব্যাপী শহর জুড়ে রাস্তাঘাট কাটাকাটি চলছে, কোথাও রাস্তার ডিভাইডার, কোথাও ফুটপাত মেরামত চলছে, কোথাও বা মেট্রোরেলের জন্য মাটিকাটা চলছে, হানিফ ফ্লাইওভারের কিছু অংশে ভাঙ্গাভাঙ্গি চলছে। কাজ চলছে পানি, বিদ্যুৎ, টেলিফোন সব সেক্টরে। আর ভবন নির্মাণও চলছে অবিরত। ইট, সুড়কি, তার, লোহা, সিমেন্ট ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যত্রতত্র। বড় বড় গর্ত, চারিদিকে শুধু ধুলা, ময়লা আর আবর্জনা – আর এর মধ্য দিয়েই মানুষ নামের কিছু প্রাণী চলাফেরা করছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো বিভিন্ন সংস্থার কাজের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। আজ এ রাস্তা খুড়ে মেরামত করছে, কাল আবার আরেকপক্ষ এসে সেই একই রাস্তা খুড়ে কয়েকমাস ফেলে রাখছে। এভাবেই চলছে রাস্তা খোড়াখুড়ির এই যাত্রাপালা। ভুক্তভোগী হচ্ছি আমরা, সাধারণ মানুষ। উপায় কী, এ উন্নয়ন তো আমাদেরই জন্য। রোগব্যাধি যাই হোক আমরা এতটাই অসহায় যে এই অব্যবস্থা, সমন্বয়হীনতা, উন্নয়নের জন্য এই ব্যয়বৃদ্ধি মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। সিটি কর্পোরেশনের এই উদাসীনতার কোন ব্যাখ্যা নেই নাগরিকদের কাছে।
অথচ সব সংস্থার কাজ যদি সমন্বয়ের মাধ্যমে করা হতো, কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে যদি অহেতুক দেরি বন্ধ করা যেত, যদি ভবন নির্মাণকারীদের কঠোরভাবে আইনের আওতায় আনা যেত, ধুলা-ময়লা ব্যবস্থাপনার জন্য যদি ব্যাপক কোন উদ্যোগ নেয়া হতো – তাহলেও কি কিছু পরিবর্তন আসতো না ? আসতো। কিন্তু ওই যে প্রবাদ আছে “যদিও কথা নদীতে” – এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। আমরা নগরবাসীরাও সবকিছু মেনে নিতে নিতে কেমন যেন ভোঁতা হয়ে গেছি।
তবে আদালতের রায় আছে নাগরিকের পক্ষে। আদালত গতবছর সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে জানতে চেয়েছিলেন যে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ধুলা, ধোয়া ও বাতাসে মিশ্রিত অন্যান্য প্রাণঘাতী উপাদান সরানোর ব্যাপারে ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন কী করছে? এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বলেছেন , তারা যারপর নাই চেষ্টা করছেন ধুলা ঠেকানোর জন্য। প্রকল্প এলাকায় নাকি দু’বেলা পানি ছিটানো হয় ট্রাক থেকে। আর ভবিষ্যতে গাছ লাগাবেন বলেও ভাবছেন তারা। এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। বরং বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করি।
লেখাটা শেষ করছি কবিগুরুর সেই কবিতা দিয়েই – কারণ শত শত বছর পার হয়ে গেলেও আমরা সেই একই কাজ করছি –
কহিল রাজা, ‘করিতে ধুলা দূর,
জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর!’
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে ঝাঁক
মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিক চলে কিস্তি।
জলের জীব মরিল জল বিনা, সর্দিজ্বরে উজাড় হলো দেশটা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)