বাংলাদেশসহ সারাবিশ্ব আজ এক অদৃশ্য জীবাণু করোনাভাইরাসের কারণে বিপর্যস্ত। বিশ্ব এক কঠিন সময় পার করছে, করছে অদৃশ্য শক্তির সাথে লড়াই। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ বেকারত্ব, দারিদ্রতা, খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষের মত বিষয়গুলো নিয়ে পূর্বাভাস দিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনীতি, সামাজিক অস্থিরতা ও খাদ্য নীতির মত বিষয়গুলো নিয়েও লড়াই করতে হচ্ছে।
কৃষিসহ অন্যান্য খাতকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ১ লক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। তার মধ্যে ঋণ আকারে প্রণোদনা, ভর্তুকি আকারে প্রণোদনা, সরাসরি প্রণোদনা গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়াও খোলা বাজারে চাল বিক্রি, প্রধানমন্ত্রীর উপহার, শিশু খাদ্য বিতরণ, সরাসরি অর্থসহায়তার মত ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি ও খাদ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ‘এক ইঞ্চি জায়গাও খালি রাখা যাবে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাস্থ্য খাতের মতো এ মূহুর্তে এবং ভবিষ্যতে করোনা মুক্ত হবার পরও কৃষির গুরুত্ব বিবেচনায় কৃষিতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা সহ সার ও বীজ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। শস্য কৃষি, ফলমূল, শাক-সবজি, হাসঁ-মুরগী, মাছ ও তার সাথে সম্পৃক্ত উদ্যোক্তা ৪ শতাংশ সুদের হারে ঋণ নিতে পারবে।
উদ্দেশ্যটি নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী হলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরী করার পাশাপাশি যাতে প্রকৃত কৃষকরা ঋণ পেতে পারে এ বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। অতীতে কৃষি ঋণ নিয়ে কৃষকরা কতটা লাভবান হয়েছে বা প্রকৃত কৃষকরা কতটা ঋণ পেয়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণ থাকলেও এবার প্রকৃত কৃষকরা ঋণ নিয়ে যাতে লাভবান হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারের ২০০ কোটি টাকার বীজ সহায়তা আগের আউস প্রণোদনারই ধারাবাহিকতা। আউস প্রণোদনায় কৃষকদের বীজ, সার ও আংশিক নিড়ানি খরচ প্রদান করা হয়ে থাকে। তাছাড়াও কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় হাওড় অঞ্চলে ৪০০টি হারভেষ্টার ও ৪০০টি রিপার মেশিন বোরো ধান কেটে যাচ্ছে, যা পরবর্তীতে অন্যান্য এলাকায় ধান কাটতে ব্যবহার করা হবে। হাওড় এলাকায় ৭০ শতাংশ ও অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ হারে ভর্তুকি সহকারে হারভেষ্টর বিক্রির কার্যক্রম ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। সার, সেচ, বিদ্যুতে ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি করোনা পূর্ববর্তী ভর্তুকি প্রোগ্রামের ধারাবাহিকতা হলেও ভর্তুকির পরিমাণ বৃদ্ধির ঘোষণা অত্যন্ত আশাব্যাঞ্জক। তার সঠিক বাস্তবায়ন হলে কৃষকদের উৎপাদন খরচের লাগাম ধরে রাখা সম্ভব হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়বে যা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় ভুমিকা রাখবে। উৎপাদন বাড়ানোর সাথে সাথে পরিকল্পিত উপায়ে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত না করতে পারলে উৎপাদন টেকসই করা যাবে না। সাথে সাথে উৎপাদক ও ভোক্তা দুই শ্রেণিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমরা জানি, সরকারের ধান, চাল, গম সংগ্রহ কর্মসূচি অন্যান্য বছরের ধারাবাহিকতা। করোনা মহামারীতে সরকার অন্যান্য বছরের তুলনায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন বেশী ধান ক্রয় করার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার ১০ লক্ষ মেট্রিক টন চাল, ১.৫ মেট্রিক টন আতপ চাল ও ৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান (চালের হিসেবে ৫ লক্ষ মেট্রিক টন) ও ০.৭৫ লক্ষ মেট্রিক টন গম ক্রয়ের ঘোষণা দিয়েছে যা গত ২৬শে এপ্রিল থেকে সংগ্রহ করার কথা থাকলেও পুরোদমে শুরু হতে সপ্তাহে খানেক সময় লেগে যায়। এ বছর বোরো ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ৪ লক্ষ মেট্রিক টন যা চালের হিসেবে ১ কোটি ৩৭ লক্ষ মেট্রিক টন (মোট উৎপাদনের ৬২ শতাংশ)। বাংলাদেশে ধানের এ উৎপাদন বৃদ্ধি (বোরো, আউস ও আমন মিলিয়ে) আমাদের বর্ধিত জনসংখ্যাকে খাইয়ে রাখতে বড় ভূমিকা রাখছে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী দেশে ১ কোটি ৬৫ লাখ কৃষক পরিবার যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ ধান উৎপাদনের সাথে জড়িত। এর প্রায় ৮৪ শতাংশ প্রান্তিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষক। ধরে নেয়া যাক আরও ১০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক যারা বাজারে ধান বিক্রি করতে পারে না। সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা করোনা মহামারীকালীন এ মৌসুমে (বোরো) মোট সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রার ৩০ শতাংশ এবং মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩.৯ শতাংশ। অতীত পরিসংখ্যান ও গবেষনা ফলাফল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, সরকার ১৯৯১/১৯৯২ থেকে ২০১৫/১৬ পর্যন্ত সময়কালে ঘোষিত ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচিতে গড়ে মাত্র ১১.৫ শতাংশ ধান কৃষকদের কাছ থেকে কিনতে পেরেছে। গত কয়েক বছর এই হার সামান্য বেশী ছিল। সরকার ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে কৃষক কর্তৃক কমপক্ষে ১৪ শতাংশ ধানের আদ্রতা (ভেজা) বজায় রেখে ধান সরবরাহ করতে না পারা ছিল অন্যতম কারণ। এ বোরো মৌসুমে সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১১.৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হবে মিলারদের কাছ থেকে।
একথাও আমরা জানি, সরকারের ধান/চাল সংগ্রহ কর্মসূচির দুটি উদ্দেশ্য (১) আপদকালীন মজুদ সংগ্রহ ও (২) ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের আয়/দাম সহায়তা প্রদান করা। সরকার মিলারদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার জন্য ব্যয় করতে হবে ৩৬১০০০১০ লক্ষ + ৩৫১০০০১.৫ লক্ষ=৪ হাজার ১ শত ২৫ কোটি টাকা। ধানের বাবদ যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তার জন্য ব্যয় করতে হবে ২ হাজার ৮০ কোটি টাকা। মোট ব্যয় ৪১২৫+২০৮০=৬ হাজার ২ শত ৫ কোটি টাকা। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা বাবদ ব্যয় করতে হবে মোট ব্যয়ের ৩৩.৫ শতাংশ।
কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজনে আরো ধান-চাল কেনা হবে। সরকারী হিসাবমতে গুদামের (সরকারী) ধারণ ক্ষমতা ২১ লক্ষ মেট্রিক টন যার মধ্যে ১৭ লক্ষ মেট্রিক টন ধান/চাল। ইতিমধ্যে ১ লক্ষ ১৪ হাজার ৬৭ মেট্রিক টন জিআর হিসেবে এবং ৯ হাজার ৮শত মেট্রিক টন বিশেষ ত্রাণ হিসেবে বিতরণ করা হচ্ছে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী কয়েক মাসে প্রয়োজন হবে আরও কয়েক লক্ষ মেট্রিক টন চাল। এমতাবস্থায় ১১.৫ লক্ষ মেট্রিক টন চাল ও ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান ঘূর্নায়মান অবস্থায় সরকারী পর্যায়ে মজুদের কোন সমস্যা হবে না বলে মনে করছি। কৃষিমন্ত্রীর ঘোষণা “প্রয়োজনে আরো ধান-চাল কেনা হবে” বাস্তবায়ন করা যাবে বলে প্রত্যাশা করছি।
কৃষকরা তাদের কষ্টের অর্জিত ফসল ঘরে তোলার পরই নগদ অর্থের প্রয়োজনে একটা অংশ বাজারে বিক্রি করে অর্থের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি পরবর্তী কৃষি মৌসুমে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় করে থাকে। কিছু কৃষক অবশ্য সামান্য অংশ ঘরে মজুত করে রাখে। কৃষকরা ধান বিক্রি করে ফড়িয়া, বেপারি, পাইকার ও আড়তদার এর কাছে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী বাজারে সরবরাহ বেশী থাকার কারণে দাম কমে যায়, তাতে কৃষকরা লাভবান হয় না বললেই চলে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে আউশ ও বোরো ধানের ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের অনুপাত এক এর নিচে। অর্থাৎ কৃষকদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশী। তারপরও কৃষকরা উৎপাদন চালিয়ে যায়। তার কারণসমূহ হলো বিকল্প উপার্জনের সুযোগ না থাকা, উত্তরাধিকার কৃষি, অভ্যাস, নিজের পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা, ইত্যাদি।
এখন আসা যাক ধান-চাল ক্রয় কর্মসূচীর দ্বিতীয় উদ্দেশ্যে। কৃষকদের আয় সহায়তা প্রদান করা যা মূলত দাম সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে। বাজার দাম ও উৎপাদন খরচ বিবেচনায় নিয়ে সরকার সংগ্রহ দাম নির্ধারন করে থাকে। এখন সরকারের ঘোষিত ৮ লাখ মেট্রিক টন ধান যদি প্রত্যেক কৃষক তিন মেট্রিক টন (যা সর্বোচ্চ একজন কৃষক দিতে পারবে) করে দেয়, তাহলে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬ শত ৬৬ জন কৃষক, যদি দুই মেট্রিক টন করে দেয় তাহলে ৪ লাখ কৃষক ও ১ মেট্রিক টন করে দেয় তাহলে ৮ লাখ কৃষক ধান সংগ্রহ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। যা ধান উৎপাদনকারী কৃষকের যথাক্রমে মাত্র ২.৭ শতাংশ, ৪ শতাংশ ও ৮ শতাংশ। এ সংখ্যাটি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক কম।
যদি অন্যভাবে দেখা হয়, সরকার মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনলে বাজারে সরবরাহ কমে যাবে যা বাজারে দাম বাড়তে সহায়তা করবে ও কৃষক ন্যায্য দাম পাবে। এ অনুমান কৃষকদের ন্যায্য দাম পেতে সহায়তা করে কিনা এ বিষয়ে তথ্যভিত্তিক গবেষণার প্রয়োজন। সরকারের ধান-চাল ক্রয় কর্মসূচীতে যেসব কৃষক সংগ্রহ কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারেনি তাদের সাপেক্ষে যারা সংগ্রহ কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পেরেছে তাদের পারিবারিক- কৃষি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর গবেষণায় দেখা গেছে যে কৃষকরা সংগ্রহ কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারার কারণে তার কৃষি আয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৭.১৬ শতাংশ (যা এ বছরের শুরুতে অষ্ট্রেলিয়া থেকে প্রকাশিত থমসন রয়টার্সের একটি নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হয় যেখানে প্রধান গবেষক ছিলেন লেখক নিজেই)। পরোক্ষ পদ্ধতিতে কৃষকদের দামের উপর প্রভাব খুব সামান্য। মোট উৎপাদনের ১০ ভাগের ও কম সরবরাহ বাজার থেকে তুলে নিয়ে বাজারে দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা করার অনুমানটি ঠিক নাও হতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় যে সরকারের ধান ও চাল সংগ্রহ কর্মসূচীতে মিলাররা বেশী লাভবান হয়েছে।
এরকম অবস্থায় কতিপয় সুপারিশমালা হলো-
ক. ধান-চাল ক্রয় কর্মসূচীর সময় চাল আমদানী অনুৎসাহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট নীতি-নির্ধারকগণ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
খ. কৃষকদের কাছ থেকে আরো বেশী পরিমাণ কেনার মাধ্যমে সরাসরি বেশী সংখ্যক কৃষকদের এ কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ মৌসুমে সরকার কেবলমাত্র ২২টি উপজেলা থেকে অ্যাপের মাধ্যমে ধান কিনবে। এ উদ্যোগকে অত্যন্ত সাধুবাদ জানাই। সরকার বাকী উপজেলাগুলো থেকে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত কৃষকদের নিকট থেকে ধান কিনবে। যাতে স্বচ্ছভাবে সরাসরি প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনতে পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে কম্পিউটারের মাধ্যমে লটারিতে কৃষক নির্বাচন করা যেতে পারে। কৃষক ব্যতিত অন্য কোন ব্যক্তি যাতে তালিকাভুক্ত না হন এবং অন্য কোন মধ্যস্বত্বভোগী (ফড়িয়া, বেপারি, আড়তদার, পাইকার, দালাল) যাতে সরকারী গুদামে ধান সরবরাহ করতে না পারে এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে ।
গ. মধ্যস্বত্বভোগীরা বাজারে যাতে কৃত্রিম উপায়ে দাম কমানোর ব্যবস্থা করতে না পারে সে বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন, খাদ্য অফিস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-কে যৌথভাবে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, খাদ্য অফিস, কৃষি সম্প্রসারণ অফিস ও বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটি দৈনিক ভিত্তিতে বাজার মনিটরিং করতে পারে। সাথে সাথে কৃষকও ধান/চালের কেনা-বেচার সাথে সংশ্লিষ্ট ফড়িয়া, বেপারী, পাইকার, মজুতদার, মিলার, আড়তদার, পরিবহন ও অন্যান্য শ্রমিক যাতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলে সে ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।
ঘ. উৎপাদিত ধান অনেক সময় দূরের বাজারে বিক্রি করার প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধান-চাল বাজারে পৌঁছাতে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা সহায়তা করতে পারে।
ঙ. খাদ্য বিভাগ ঋণের বিনিময়ে ধান/চাল সংগ্রহ কর্মসূচী পরিচালনা করতে পারে। সরকার ব্যক্তি মালিকানাধীন চালকল/গুদাম ভাড়া নিয়ে এ কাজটি করতে পারে। ধরা যাক, ২ লক্ষ মেট্রিক টন ধান ক্রয় করা হবে। এক্ষেত্রে ঋণের বিনিময়ে কৃষক গুদামে ধান সংরক্ষণ করার বিনিময়ে ঋণ পাবে। “ধানের বিনিময়ে ঋণ”। যখন বাজারে দাম বৃদ্ধি পাবে তখন কৃষক তার গুদামে সংরক্ষিত ধান বাজারে বিক্রি করার মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করবে। খাদ্য বিভাগ ও কৃষক যৌথভাবে বাজারে বিক্রির কাজটি করতে পারে। খাদ্য বিভাগ বিক্রি থেকে ঋণের টাকা কাটার পর অতিরিক্ত অর্থ কৃষককে প্রদান করবে। এক্ষেত্রে ঋণের সময় মুল্য প্রদান করতে কৃষকরা রাজী থাকবে বলে আমার ধারণা। এ পুরো কাজটি হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে যেখানে অস্বচ্ছতার কোন সুযোগ থাকবে না।
চ. খাদ্য বিভাগ পূরো লক্ষ্যমাত্রা কেবলমাত্র কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নিবে। এ কাজটি মিলারদের সাথে নিয়ে করতে পারে। যেহেতু কৃষক আদ্রতা অনুযায়ী ধান বিক্রি করতে পারে না সেক্ষেত্রে মিলার ও খাদ্য বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রচলিত ও প্রতিযোগিতামূলক সার্ভিস চার্জের মাধ্যমে কৃষকদের ধান শুকানো ও মিলিং এর কাজ করবে। এ অবস্থায়, কৃষক ও মিলার উভয়ই লাভবান হবে। সরকারও তার দুই উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে।
ছ. খাদ্য বিভাগ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মিলারদের কাছ থেকে চাল কিনবে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনে নিয়ে মিলারদের নিকট হতে প্রতিযোগিতামূলক খরচের ভিত্তিতে শুকানোর কাজটি করিয়ে নিতে পারে। যেমন একজন মিলার যদি সর্বোচ্চ ১০ টন সংগ্রহ কেন্দ্রে বিক্রি করতে পারে তাহলে সরকার তার কাছ থেকে ৫ টন কিনে নিবে আর বাকী ৫ টন কৃষকদের কাছ থেকে সংগৃহীত ধান যা মিলারদের চাতালে বা মেশিনে শুকিয়ে চালে রুপান্তরের মাধ্যমে করে নিতে পারে। প্রতিযোগিতায় মূলক ভিত্তিতে কৃষক ও মিলার উভয়ই লাভবান হবে।
জ. খাদ্য বিভাগ তার সংগ্রহ, পরিবহন ও মিলিং খরচ কমানোর ব্যবস্থা করতে পারে। বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে একাধিকবার শ্রমিক ও পরিবহন খরচ বহন করতে হয়। ধান কৃষকদের নিকট থেকে খাদ্য গুদাম, খাদ্য গুদাম থেকে মিলার পরবর্তীতে মিলারদের নিকট থেকে খাদ্য গুদামে আনা-নেয়ার জন্য কৃষক ও খাদ্য অফিসকে খরচ বহন করতে হয়। খাদ্য বিভাগ কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয়কৃত ধান সরাসরি মিলারদের চাল কলে পাঠিয়ে মিলিং করে খাদ্য গুদামে নিয়ে আসতে পারে। এ ব্যবস্থা সহজেই সরকারের ধান/চাল সংগ্রহের জন্য শ্রমিক ও পরিবহন খরচ কমাবে। সাথে সাথে ধানের বদলে চাল সংরক্ষনের জন্য মজুদ সক্ষমতার পরিমিত ব্যবহার সম্ভব হবে। তাছাড়া খাদ্য বিভাগ ধানের ক্ষেত্রে ৮৫-৯০ মেট্রিক টনের খামালসমূহ চালের খামালে রুপান্তরের মাধ্যমে গুদাম ধারনক্ষমতা বৃদ্ধি ও পরিমিত ব্যবহার করতে পারবে।
ঝ. বাস্তবতার নিরিখে খাদ্য বিভাগের পক্ষে অসংখ্য কৃষকদের ফার্মগেটে যেয়ে ধান কেনা হয়ত সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে কৃষক পরিবহন খরচ ও সময় ব্যয় করে সংগ্রহ কেন্দ্রে এসে ধান বিক্রি করতে হয়। তবে বিক্রি করতে না পারার অনেক উদাহরণও আছে। এক্ষেত্রে কৃষক ধানের ১৪ শতাংশ আদ্রতা বজায় রাখতে না পারার বিষয়টি অন্যতম একটি কারণ। এঅবস্থায় কৃষক দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একটি হল ধান বিক্রি করতে না পারা এবং অন্যটি পরিবহন ব্যয় ও সময়। এ বিষয়টি কিভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। অনেক কৃষক দাঁত দিয়ে ধান কামড়িয়ে আদ্রতার একটা ধারণা নিয়ে থাকে সেটা সব সময় সঠিক নাও হতে পারে। সংগ্রহ কেন্দ্রে ধান কেনার জন্য নুন্যতম ১৪ শতাংশ আদ্রতা বিষয়টি কৃষকদেরকে জানানোর পাশাপাশি আদ্রতা পরিমাপের জন্য নিকটবর্তী খাদ্য অফিস বা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সহযোগিতা করতে পারে। যে অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল নয় অথবা পরিবহন খরচ বেশী (যেমন হাওড় এলাকা, চড় এলাকা) সেক্ষেত্রে এ বিষয়টি আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা কালীন এ দূর্যোগে ও করোনা পরবর্তী সম্ভাব্য খাদ্য ঘাটতি ও খাদ্য অনিরাপত্তা থেকে উত্তোরণের জন্য আমাদের কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করতে হবে। তাদের কাঁয়িক পরিশ্রমের বিনিময়ে ১৭ কোটি মানুষকে খাইয়ে রাখার এ যুদ্ধে তাদের পাশে দাঁড়ানোর বিকল্পটা কি হতে পারে।
(তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন সুরাইয়া খাতুন, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, নেত্রকোণা)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)