নতুন ধানের ঘ্রাণ কার না ভাল লাগে। কিন্তু নতুন ধানের গন্ধ আর প্রয়োজন এবং কিশোর মনে শখের কৃষিকাজের জন্য গ্রামের স্কুলগুলোয় এখন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ব্যাপক হারে কমে গেছে।
প্রাত্যহিক সমাবেশে যেখানে মাঠের অর্ধেকটাই সারিবদ্ধ ছেলেমেয়েদের দৃপ্তকন্ঠে শপথ বাক্য শোনা যেতো, এখন শুধু তার রুটিন চর্চা! তৎপর শরীরচর্চা শিক্ষককে অসহায় দেখে সহকর্মীরা ‘শীঘ্রই প্রাত্যহিক সমাবেশে শিক্ষার্থীর ব্যাপক উপস্থিতিতে সারি বেড়ে যাবে’, সে আশ্বাসবাণী শোশনান।
আবার শ্রেণীকক্ষে গিয়ে ওই শিক্ষকরাই মনমরা হয়ে তার পাঠ-পরিকল্পনা পকেটে রেখেই ক্লাস সারেন। শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম, তাই ক্লাসগুলোতে প্রাণচাঞ্চল্য থাকে না। এ পরিস্থিতির পরও যারা উপস্থিত থাকে, নির্ধারিত সময়ের আগেই বাড়ি চলে যাওয়ার হরেক-রকম বাহানা থাকে তাদের। অনেকসময় ছুটির দরখাস্ত নিয়ে হাজির হয় সহকারি প্রধান শিক্ষকের ডেস্কে। দরখাস্তের ভাষা আর ওদের চোখ-মুখের ভাষায় মিল খোঁজের চেষ্টা না করেই অনেক সময় ওদের ছুটির দরখাস্ত মঞ্জুর করতে হয়। আর এভাবেই প্রতিদিন কারো না কারো ছুটি হয়ে যায়। কারণটাতো সবারই জানা!
দেশজুড়ে চলছে বোরো ধান কাটার মওসুম। বাংলাদেশের কৃষক পরিবারের সবচেয়ে কর্মমুখর সময় এটি। যে সোনালি স্বপ্ন বুকে লালন করে বাংলার কৃষক সবুজের মাঠ সাজিয়েছেন দীর্ঘ তিনমাস ধরে, এখন স্বপ্ন ছোঁয়ার সময়। সোনালি ধানে গোলা আবার ভরে উঠবে, এই আনন্দের শরীক হতে চায় সবাই।
স্কুল-পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের কাছে এইসময় স্কুলে যাওয়ার চেয়ে তাই মা-বাবার পাশে থেকে একটু সাহায্য করা বেশি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ মনে হয়। বইয়ের গাট্টি টেবিলে ফেলে রেখে নতুন ধান নিয়ে নাড়াচাড়াতেই যেন তারা মনযোগী।
কিন্তু জুনের প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষা। এ বিষয়টি তাদের অনেক আগে থেকেই জানা থাকার পরও এ দিকটায় মনযোগ আছে বলে মনে হয় না। আসলে বাস্তবতাও তাদের বিদ্যালয় থেকে দূরে রাখছে।
মোট শিক্ষার্থীর এক তৃতীয়াংশ এখন স্কুলে আসে না। এই তথ্য এই সময় বরাবরের চিত্র। স্কুল কর্তৃপক্ষ কঠোর হতে চাইলে, সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের আকুতি-মিনতিসহ ফোন আসে। একটু ছাড় দেওয়ার অলিখিত দরখাস্তই বলা যায় অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর জন্য তার অভিভাবকের পক্ষ থেকে।
“স্যার, আমরা গৃহস্থ মানুষ। টুক-টাক গিরস্থি করি। কিন্তু সময়মতো কামলা পাই না। তাই, মাইয়া/পোলাডারে সাথে নিয়া ধান মাড়াই দিতাছি। কয়েকটা দিনের জন্য স্যার, মাইয়াডা/পোলাডার প্রতি একটু সদয় অইবেন, স্যার। দয়া করে ওরে বকা দিয়েন না।” এধরনের সংলাপ প্রায় প্রতিদিনই শুনতে হয়।
দেশের গ্রাম-গঞ্জের অধিকাংশ শিক্ষক যেহেতু কোনো না কোনো ভাবে কৃষক পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাই এমন অভিজ্ঞতায় তাঁরা যথেষ্ট হতাশ হন না। এদেশের অর্থনীতি যেহেতু এখনো অনেকটাই কৃষি ও কৃষকের কাছে ঋণী, শিক্ষকরা তাই এ পরিস্থিতিকে পাশ কাটাতে পারেন না।