অষ্ট্রিয়া থেকে জার্মানিতে ফিরছি। গভীর রাত আনুমানিক ২টা। চেক-রিপাবলিকের রাজধানী প্রাগ। পারহা নামক এক জায়গায় ট্রানজিট। গন্তব্য আমার বাসস্থান ড্রেজডেন শহর। ৬ ঘণ্টার দীর্ঘ ট্রানজিট । ভাবলাম যাত্রীদের বিশ্রামাগারে সময় কাটিয়ে দেবো। প্রাগ আমার কাছে নতুন শহর, রাতে লোকজন কম, আমি ইউরোপে নতুন, তখনও ইনকাম তেমন করি না। ইউরো সমান একশ টাকার চিন্তা মাথা থেকে যায় না।
ইউরোপে, একেক দেশে একেক ভাষা। কারে কি বলবো। সহজে ইংরেজি বলতে চায়না কেউ। পরে এসব চিন্তায় আর ছয় ঘণ্টার জন্য আর হোটেলে খুঁজিনি। সবাই আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। ৩ টার দিকে দেখলাম মাইকে ঘোষণা এলো বিশ্রামাগার বন্ধ থাকবে ৫.৩০ পর্যন্ত। শীতের রাত ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া অবস্থা। সর্বশেষ, আমি আরেক তরুণী।অনেক কিছু বোঝালাম সিকিউরিটিকে কিছুই বুঝতে চাইলনা । কী আর করা, পাশের ট্রাম স্টেশন সারারাত খোলা থাকে। মাটির নিচে কিন্তু খুব ঠাণ্ডা। তারপরও উপায় নাই। সেখানে গিয়ে বসলাম। জনমানব শূন্য প্রাগের ওই ষ্টেশনে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো। হঠাৎ এই তরুণীর প্রবেশ।আরেকজন মানুষের উপস্থিতিতে কিছুটা উষ্ণতা বোধ করলাম। মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে দিলাম। কোনো কথা নাই। অনেকক্ষণ পর ভাঙ্গা জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম -Wohin gehst du (তুমি কোথায় যাবে)? বলল, বার্লিন।
জর্জিয়ান ওই তরুণী বার্লিনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, ভিয়েনা থেকে ফিরছে। আমি ভাবছিলাম এত গভীর রাতে কী নিরাপদ বোধ করছে এই মেয়েটি। আর আমার অভাগা দেশের কথা চিন্তা করলাম। এরকম রাত তিনটায় কোনো মেয়ে একা কমলাপুর ষ্টেশনে থাকলে। বদমাইশ লোকজন ছাড়াও চরিত্রবান পুলিশ ভাইদের অনেকে তাকে নিয়ে টানাটানি করত বা তাকে চরিত্রহীন বানানোর চেষ্টা করত। পরে আমরা একই ফ্লিক্সবাসে জার্মানি ফিরেছি।
সম্প্রতি আমি এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। কেউ কাউকে তেমন চিনি না নতুন কলিগ। দুই দিনের পরিচয়। লাইপজিগের এক গ্রাম থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। ছয় ঘণ্টার লং ড্রাইভ। সে ড্রাইভ করছিল। একা ওই মেয়ে আর আমি গভীর রাতে গিয়ে পৌঁছেছি অন্য আরেক রাজ্যে। চলার পথে সন্ধ্যায় জার্মানির অজানা এক গহীন বনে পথ হারিয়েছি। একই হোটেলে থেকেছি। তবে একবারের জন্যও আমার ওর আমার প্রতি কোনো আকর্ষণ মগজে জাগেনি। আবার কেউ হয়ত কাউকে চিনি না এমন অনেকের সাথে রাতে একই রুমে পাশাপাশি থেকেছি। তাই বলে আবার অন্যকিছু ভাবার অবকাশ নেই। বিষয়টা হচ্ছে তাদের আমি মানুষ ভেবেছি, মেয়ে নয়। সম্মতি থাকলে সেটা আলাদা কথা।
আমাজনে কাজ করেছি মাস দেড়েক। সেখানেও রাতে অনেক মেয়েকে নিশ্চিন্ত- স্বাধীন কাজ করতে দেখেছি। রাতে এখানকার মেয়েরা গাড়ি চালায়, পার্টি করে সব কিছু করে নিরাপদে নির্বিঘ্নে। আমার মনে হয় বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে পড়তে আসা একা অবিবাহিত অনেক- মেয়ে নিজেকে এখানে দেশের চেয়ে নিরাপদ ও স্বাধীন মনে করে। স্টুডেন্ট হলগুলোতে পাশাপাশি রুমে অনেক ছেলে মেয়ে টয়লেট, বাথরুম, ডাইনিং, কিচেন সবকিছু শেয়ার করে একে অন্যের প্রতি সম্মান দেখিয়ে। আর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছেলেগুলো আরেক জনের বউ নিয়ে ক্যাম্পাসে বেড়াতে এলে- ধর্ষণ করে। করবে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি অনেক শিক্ষক মেয়েদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালায় নাম্বার বেশী দেবার টোপ দিয়ে। ওদের আদর্শ অনুসরণকারী ছাত্ররা আর কি করবে।দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্ষণের অভিযুক্ত অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে উত্তাল আন্দোলনের পরও শিক্ষকতায় আছেন, পদোন্নতি পাচ্ছেন।
সর্বশেষ, জার্মান এক কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম। সেখানে ইন্টারভিউর পর চাকরি কনফার্ম করে ম্যানেজার আপা একটা ব্যাগ গিফট করেছে। হলে এসে দেখলাম, একটা লাইটার, একটা কফি মগ, আর একটা ছোট প্যাকেট– জার্মান আপা যখন ওটা ব্যাগে তুলছিলো আমি ভেবেছিলাম চকলেট জাতীয় কিছু হবে। পরে দেখি ওটা একটা কনডম। এর মানে এখানে যৌনতাকে ভাতের মতো- প্রয়োজনীয় জিনিস মনে করা হয়। লজ্জার কিছু নাই। আমাদের দেশে ৮৫ পার্সেন্টের বেশী মুসলমান। ধর্মে অবাধ যৌনতা নিষিদ্ধ। মেয়েদের ছিলাকলা, তেঁতুল, রসগোল্লা নামে ডাকে কাঠমোল্লারা। অন্য ধর্মের যাজকরাও কম যাননা। সবাই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এদের হাত থেকে রেহায় পায়না বাচ্চা ছেলে থেকে শিশু কন্যারাও।
আসলে, ধর্ম চর্চা কিংবা ওয়াজ নসিহতে মেয়েদের নিয়ে রসের গল্প বন্ধ করা দরকার। দরকার সামাজিক মূল্যবোধ, মেয়ে মানুষকে -মানুষ হিসেবে সম্মান করার জন্য সামাজিক বিপ্লব। শুদ্ধাচার দরকার। সব ক্ষেত্রে। ইউরোপের বেশীর ভাগ দেশ বিশেষ করে জার্মানির ৫০ ভাগ মানুষের কোন ধর্ম নেই। তবে ধর্মহীনরা এখানে বকধার্মিকদের চেয়ে শতভাগ নিষ্ঠা আর সততা নিয়ে জীবন যাপন করে। এখানে মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষ বিপুল স্বাধীন। মনুষ্যত্বের মুক্তি কিংবা মনুষ্যত্বের উন্নতি ঘটলে ধর্মীয় জীবনে এমনিতেই শান্তি আসবে। এজন্য উল্টা -পাল্টা ওয়াজ নসিহতের দরকার নাই।
অনেকেই মনে করে ইউরোপে মন যা চায়, তা-ই করা যায়। আসলে তা নয়। এখানে খারাপ মানুষ নাই, ধর্ষণ হয়না, তেমনটা না। তবে অনেক কম। এখানে নারী পুরুষ আলাদা না সবাই মানুষ। আইনের শাসন আছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সবাই সবাইকে সম্মান করে। সুযোগ থাকলেও কারো সম্মতি ছাড়া জোর করে কিছু করা অন্যায়। এটা ওরা ছোটকাল থেকেই শিখেছে। আর আমাদের দেশে মাদ্রাসা, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, মিডিয়া হাউস, কর্পোরেট হাউস, সরকারি প্রতিষ্ঠান,পাহাড়, সমতল, গির্জা, মন্দির,প্যাগোডা সবজায়গায় নারীর অসম্মান, মানুষের অসম্মান নিয়মিত ঘটনা। মানুষ মানুষ হয়ে উঠুক তাহলেই অনাচার কমবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)