চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ধর্ষণের দায় কি তবে শয়তানের?

সংবাদপত্রের একটি চমকপ্রদ হেডলাইন, আমি ধর্ষণ করিনি ‘শয়তান আমাকে দিয়ে ধর্ষণ করিয়েছে’ কথাটি একজন মসজিদের ইমামের৷ হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার আলাপুর গ্রামের মসজিদের ইমাম মানিক মিয়া ধর্ষণের অভিযোগে সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়ে এমন কথা বললেন। পুলিশের কাছে তিনি বলেছেন, আমি ধর্ষণ করিনি ‘শয়তান আমাকে দিয়ে ধর্ষণ করিয়েছে।’ পুলিশ দাবি করেছে, মানিক মিয়া ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন। রাতে ইমাম মানিক মিয়া তার ঘরে এক কিশোরীকে আশ্রয় দেন। অতঃপর আশ্রয়দাতা হতে ধর্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন৷ এরপর রক্তক্ষরণরতা ধর্ষিতা মেয়েটিকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নেয়া হয়।

ঘটনার পর শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি আনিসুর রহমান এক অভিযান চালিয়ে মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তার করেন।
গ্রেপ্তারের পর মানিক মিয়া পুলিশকে জানায়, রাত ৯টার দিকে এক কিশোরী তার কক্ষের দরজায় এসে ধাক্কা দেয়। দরজা খুললে ওই কিশোরী বলে সে বাড়ি থেকে অভিমান করে চলে এসেছে। রাত যাপনের জন্য সে তার কাছে আশ্রয় চায়। তিনি মেয়েটিকে আশ্রয় দেন। কিন্তু মাঝরাতে শয়তানের পাল্লায় পড়ে তিনি এই কিশোরীটিকে ধর্ষণ করে ফেলেন। উল্লেখ্য মেয়েটি রাত যাপনের জন্য অন্য স্বজনের বাড়ি যাচ্ছিল। পথে আলাপুর গ্রামের মসজিদের ইমাম মানিক মিয়া মেয়েটিকে রাতের বেলা একা দেখে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। ধর্ষণের ফলে মেয়েটির রক্তক্ষরণ শুরু হলে সে বাড়ি ফিরে গিয়ে ঘটনাটি পরিবারের লোকজনকে জানায়। পরে স্বজনরা তাকে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেন৷

ইমাম মানিক মিয়ার এই শয়তান তত্ত্বের কী ব্যাখ্যা দেবে আইনবিদরা? তবে কি মূল অপরাধী মানিক মিয়া নয় মূল অপরাধী শয়তান। এই শয়তানের বিচার করবে কোন সাধুর আদালত?

মসজিদ মাদ্রাসায় এসব হচ্ছেটা কি?সংবাদ পত্রে প্রতিদিনই ইমাম ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের অপকর্মের বিষয় শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষক ছাত্রীকে ধর্ষণ করছে ও পুড়িয়ে মারছে। মুক্তিপণের জন্য তিন বছরের শিশুকে হত্যা করছে। বলাৎকার করেও ছাত্র হত্যা করছে তারা। আবার এইসব ব্যক্তিরাই কথায় কথায় অন্যের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগ আনে। আল্লাহ রসুলের বদনাম করলে কল্লা কাটতে তেড়ে আসে। কিন্তু তারা নিজেদের এতসব জঘন্য অপকর্মে নীরব কেন? এরা কি আল্লাহ রসুলের দোহাই দিয়ে আল্লাহ রসুলেরই বদনাম করছেনা? যার পিছনে শতশত ধর্মপ্রাণ মুসল্লি নামাজে শরীক হয় সেই ব্যক্তিই যদি কিশোরী ধর্ষণ করে ও ছেলে শিশুর উপর বলাৎকার করে সেটা কি ধর্মনেতার মুখোশে ধর্মেরই অপমান নয়? ধর্ষক সিরাজ উদ দৌলাও কি তবে দায়ী নয়? সেও কি শয়তানের প্ররোচনাতেই নুসরাত জাহান রাফিকে ধর্ষণ করল? সুতরাং দায়টা সিরাজের নয় সেটাও কি শয়তানেরই? ধর্মীয় নেতারা সেজন্যই কি এ ব্যাপারে নীরব? এর কি ব্যাখ্যা দেবেন আল্লামা আহমদ শফী? তিনি কি অতীতে নারীদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে এসব লম্পট ইমাম ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের অপকর্ম লিপ্সাকে উস্কে দেননি?

ফেনী-নুসরাত-যৌন নিপীড়ন
মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা

শয়তান কেন হুজুরদের দিকে ছুটছে। তারা কি শয়তান তাড়ানোর দোয়া জানেননা? নাকি তারা এ দোয়া পড়েন না অথবা পড়লেও শয়তানের এতে কিছু হচ্ছেনা ব্যাপারটা কি সেরকম? কুমিল্লার চান্দিনায় আট বছরের শিশু ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষক মামুনুর রশিদকে (৩৫) হাতেনাতে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে এলাকাবাসী। অভিযুক্ত ওই শিক্ষককে উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের আলীকামোড়া দারুল কোরআন কমপ্লেক্স থেকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে তারা। আটক মাদ্রাসা শিক্ষক মামুনুর রশিদ চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার৷ আরবে হজ্জে গিয়ে হাজী সাহেবদেরকে শয়তানকে লক্ষ করে প্রস্তর নিক্ষেপ করতে দেখা যায়। এসব প্রস্তর সত্যিই কি শয়তানের গায়ে লাগে নাকি সেটা একটা স্রেফ প্রতীকী প্রথা মাত্র? মসজিদ মাদ্রাসায় কি প্রতিদিন শয়তানকে লক্ষ করে এই পাথর নিক্ষেপের প্রথাটা চালু করা যায়না?এমনটি চালু থাকলে হয়তো আজ শয়তান অভিযুক্ত হতোনা৷ আজ নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করে মসজিদে ফেলে রাখা হচ্ছে৷ মাদ্রাসায় পড়তে আসা ছাত্রীদেরকে ধর্ষণ করছে সেই মাদ্রাসারই শিক্ষক৷ মসজিদের ইমামের কাছে পাওয়া যাচ্ছে ইয়াবা। এসব কি শয়তানের তুখোড় প্রভাবের লক্ষণ নয়? মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা প্রতিদিন ক্লাস শুরুর আগে শয়তানকে লক্ষ করে প্রস্তর নিক্ষেপের রীতি চালু করতে পারে। শয়তান তাড়ানোর এই একটি মাত্র রীতিই যেহেতু আছে সেটা চালু করলে হয়তো কিছুটা সুফল আসতে পারে। এতে ধর্ষকামীরা কিছুটা হলেও সংযত ও ভয়ার্ত থাকবে নিশ্চয়ই। আর ধর্ষকদের তাদের ধর্ষণ অপকর্মের জন্য শয়তানকে দায়ী করার অজুহাতটারও অবসান ঘটবে তখন৷

মোল্লাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বললে অনেক আস্তিককেও তারা অবলীলায় নাস্তিক উপাধি দিয়ে দেয়। যেমন রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে যখন তারা নাস্তিকতার অভিযোগ আনলো তখন তিনি সস্ত্রীক ওমরাহ হজ্জ পালন করছিলেন। ইহকালে পাপ করলে পরকালে শাস্তিভোগ করতে হবে। ইহকালে পুণ্যকর্ম করলে পরকালে পুরস্কৃত হবে জান্নাতবাসী হয়ে। এই থিওরিই ধর্মের মূল। এ কথা অন্যকে বলে কিন্তু তারা নিজেরা কি তা মানে? একজন নাস্তিককে ইহজগতেই মেরে ফেলতে তারা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। তার উদাহরণ রাজীব হায়দার শোভন,অভিজিৎ,ওয়াসিকুল বারী সহ আরও অনেকেই। পরকালে বিশ্বাসী এই মহলটি কেন এই ব্যক্তিদের পরকালে সমর্পণ করতে পারলোনা? শয়তানের প্ররোচনায় যদি ধর্ষণ হয় আল্লাহতে অবিশ্বাস কেন নয়? কেন তারা এমনটি বলছেনা যে শয়তান তাদেরকে আল্লাহতে অবিশ্বাস করাচ্ছে?এক্ষেত্রে কথিত নাস্তিকের বিরোধিতা না করে কেন শয়তানের বিরোধিতা করছেনা তারা? তবে কি নিজেদের রক্ষার বেলায় এই শয়তান তত্ত্ব ও অন্যদের বেলায় তা নয়?ধর্ষণ

নরনারী পরস্পর সম্মতির ভিত্তিতে ব্যভিচারে লিপ্ত হলে যদি দোররা মারার বিধান হয় আর অসম্মতিতে ধর্ষণের কি বিধান? মসজিদ মাদ্রাসার পবিত্রতা নষ্টকারী এইসব ধর্ষকদের কেন শাস্তির ঘোষণা দিলোনা মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও আলেম সমাজ? আল্লামা শফী মাদ্রাসার এত খবর রাখেন এই খবরটা কেন রাখলেন না?অথবা রাখলেও তার কোন গুরুত্ব দিলেন না? নাকি এসব ধর্ষকদের বিচার পরকালে হবে এজন্যই এই নিরবতা৷ তবে মাদ্রাসা ও তাদের নিয়ে সামান্য সমালোচনাতেই তারা তেতে উঠে কেন? এ বিচারের ভারটাও কি পরকালকে দেয়া যেতোনা? ইহকালে নিজেদের রক্ষার জন্য শয়তানকে দায়ী করা আর অপরের বেলায় ইহকালেই গর্দান কাটা! এরকম ধর্মাশ্রয়ী সুবিধাবাদী কি ধর্মসম্মত?এসব কি ধর্মের নামে কুটিল অধর্মাচার নয়? ধর্মটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তারা? আরও রয়েছে সম্প্রদায়গত প্রতিহিংসা৷ কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রতি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে ক্ষ্যাপিয়ে তুলে বিভেদ ছড়ানো হচ্ছে৷ আহমদ শফী পঞ্চগড়ে গিয়ে বলে এসেছেন, ‘”কাদিয়ানী সম্প্রদায় মুসলমান নয়, তারা অমুসলমান। একই সাথে তাদেরকে যারা অমুসলমান মনে করেন না, তারাও অমুসলামান। কাদিয়ানীদের মেয়েকে বিবাহ করা যাবে না। একই সাথে কাদিয়ানীদের ছেলেদের সাথে মেয়েকে বিয়ে দেয়া যাবে না। কাদিয়ানীরা কাফের। যারা তাদেরকে কাফের মনে করেন না, তারাও কাফের। আমরা শেখ হাসিনা সরকারকে বলবো কাদিয়ানীদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষণা করার জন্য “।

কাদিয়ানী মসজিদে কি কখনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে? রাষ্ট্র কিসের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে? রা কেন কাদিয়ানী হল? সেটা দূষণীয় হলে কেন তাকে শয়তানের প্ররোচনা বলা হচ্ছেনা? এই শয়তান তত্ত্বটা তবে কার বেলা প্রযোজ্য ও কার বেলা প্রযোজ্য নয়?

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)