অপরাধী বলুন আর সন্ত্রাসী বলুন। তাদের কোনো দল নেই। ধর্ম নেই, কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। অপরাধীরা অপরাধীই। সন্ত্রাসীরা সন্ত্রাসীই। এরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যেকোন সময়, যেকোন ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাসীন কোন নেতার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করে। রাজনীতির মাঠে টিকে থাকতে হলে একজন রাজনৈতিক নেতার বাহিনী খুব প্রয়োজন। বাহিনী থাকলে রাজনৈতিক নেতা নিজকে শক্তিশালী মনে করেন।
যে নেতা যে এলাকায় রাজনীতি করেন, সে এলাকাতে তার একটা বিপক্ষ শক্তি গড়ে ওঠে। সেটা নিজের রাজনৈতিক দলের হোক, বা বিরোধী মতের হোক। মোটকথা তার বিপক্ষ শক্তি। এ বিপক্ষ শক্তিকে দমন করার জন্য রাজনৈতিক নেতারা সন্ত্রাসী, অপরাধীদের লালনপালন করে থাকেন। না হয় তাকে পরাজয় মেনে নিয়ে রাজনীতির মাঠ থেকে চিরবিদায় নিতে হবে। সেজন্য এই রাজনৈতিক নেতারাও তাদের কাজে লাগান। সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোও রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে নানান ধরণের অপকর্ম করে যায়। গুম, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজির মতো নিত্যদিনের ঘটনাগুলো এজন্যই ঘটছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটা বিষয় লক্ষ্য করা গেছে, সংগঠিতভাবে গড়ে উঠছে অপরাধী চক্র। এসব অপরাধী চক্র অপরাধ করে, রাজনৈতিক সুবিধা নিয়েই শেষ পর্যন্ত ছাড় পেয়ে যায়। সেটা আপনি বর্তমান সরকার ব্যবস্থা বলুন আর বিগত সরকার ব্যবস্থাগুলোর কথা বলুন, সবটাতেই।
রাজনৈতিক নেতা মনে করেন, ছেলেটা আমার জন্যইতো কত কী করলো, আমার পিছনে পিছনে দৌঁড়েছে, যখন তখন আমার জন্য স্লোগান দিয়েছে। বিপদ থেকে যে কোনভাবে ছেলেটাকেতো বাঁচাতে হবে। বা নেতার লালিত যে বাহিনী, সে বাহিনী সংঘবদ্ধভাবে যদি কোন ক্রাইম করে এবং যদি প্রশাসনের হাতে ধরা খায়, লবিং করে হলেও তো তাদের রক্ষা করতে হবে। না হলে তো আমি নিজেও মাঠে টিকতে পারবো না। সে চিন্তা থেকে নেতা অর্থ দিয়ে হোক, শক্তি দিয়ে হোক আইনজীবী ভাড়া করে ওই সন্ত্রাসী বাহিনীকে, কোন ক্রিমিনালকে জেল হাজত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন। এভাবে অপরাধী এবং অপরাধ চক্র পার পেয়ে যায়।
এখন যদি কোন একটা অপরাধের ঘটনা ঘটে। একদল বলে ওরা ওমুক দলের, আরেক দল বলে এদের কোন দল নেই, এরা অপরাধী। স্বাভাবিকভাবেই ধরুন, যারা সমাজে দুর্বল, তারা কী সমাজে বড় কোন অপরাধ ঘটাতে পারে? না। বরং বরাবরই সবলরা সমাজে অপরাধী কাজে বেশ সক্রিয়। ঠিক আজকাল যে ঘটনাগুলো ঘটছে, এ সবের পেছনে নিঃসন্দেহে একটা ক্ষমতা এবং রাজনৈতিক শক্তি কাজ করছে।
কিছুদিন আগেই সিলেটের মুরারিচাঁদ কলেজে (এমসি কলেজ) স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গেলে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গণধর্ষণের শিকার হন এক নারী। এই অপরাধী চক্র এই সাহসটা কোত্থেকে পেল? তাদের একটা রাজনৈতিক পরিচয় আছে। যদিও আগেই বলেছি তারা অপরাধী, তাদের অপরাধকে পাকাপোক্ত করবার জন্য রাজনৈতিক দল বা নেতার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখছেন। কিন্তু, এটা স্বীকার করতে হবে যে রাজনৈতিক শক্তি না থাকলে, এত বড় একটা ঘটনার সাহস তারা কখনোই পেত না। বিগত সময়ের ঘটনার চিত্রে চোখ ফেরালে এমন চিত্রই চোখে পড়বে।
ঠিক, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এখলাসপুরে ঘরে ঢুকে গৃহবধূকে ধর্ষণ চেষ্টা এবং ধর্ষনে ব্যর্থ হয়ে যে পাশবিক ও অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছে, এর যে ভিডিও গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ঘটনার ৩২দিন পর, এ ঘটনার পেছনে কী একটা রাজনৈতিক শক্তিকে আপনি কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারবেন? নির্যাতিত ওই গৃহবধূকে যখন নির্যাতন করা হচ্ছে, তখনই নির্যাতনকারীদের মুখ থেকে শুনা যাচ্ছে, ভিডিও কর, ভিডিও কর, ফেসবুক হবে ফেসবুক। মানে বিবস্ত্র অবস্থায় যে নারীকে যারা নারীর পরকীয়া অপবাদ দিয়ে এভাবে নির্যাতন করে ভিডিও করছে, সে ভিডিওটা তারা ফেসবুকে ভাইরাল করবে। ভিডিওতে ভুক্তভোগী ওই নারীকে বলতে শোনা গেছে, ‘আব্বারে আব্বা, তোদের আল্লাহর দোহাই, আমারে ছাড়। আমি কোরআন শরিফ নিয়া কইতে হারমু, আমার কাছে আর কেউ আসে নাই। আমার স্বামী আসছে।’
ওই নারীর একটা ছেলে আছে, একটা মেয়েও আছে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছেন, মেয়ের ঘরে সন্তানও হয়েছে। ওই নারী থাকতেন তার ভাইয়ের সঙ্গে, তার স্বামীর আরেকটা সংসার থাকলেও সে সংসারটাও চলছে, এ সংসারটাও। অথচ, এ নারীর স্বামীকে বেঁধেও তারা ধর্ষণ চেষ্টা করে এবং সেটাতে ব্যর্থ হয়ে এভাবে নির্যাতন করে ভিডিও করে। ঘটনার মাঝখানে মাঝে মাঝে ওই নারীকে কু-প্রস্তাব দিত বখাটেরা। একটা পর্যারে মোটা অংকের টাকাও দাবি করা হয়। তাতেও রাজি না হলে শেষমেশ বিবস্ত্র অবস্থায় নির্যাতনের সে ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় বখাটের দল। সারাদেশজুড়ে আজ এ ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। কিন্তু, যতক্ষণ পর্যন্ত খবরের শিরোনাম গরম, ততক্ষণ পর্যন্তই এ ঘটনার রেশ থাকবে। ক’দিন পরেই আমরা সব ভুলে যাব, যেভাবে আমরা ভুলে গেছি অতীতের সব ঘটনাগুলোকে।
৪-৫দিন আগেও নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থেকে ঘুরে এসেছি। আমার কাছে মনে হয়নি, ওই জনপদের কিছু মানুষ যে এত হিংস্র। এখন ভাইরাল ঘটনায় কেউ কেউ বলছেন, অপরাধীদের রাজনৈতিক একটা পরিচয় আছে। তারা সে শক্তিকে কাজে লাগিয়ে এমনটা ঘটিয়েছেন। আবার বলা হচ্ছে, অপরাধীদের কোন দল নেই, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হচ্ছে না। কিন্তু, এ ঘটনাটি যখন ঘটেছে, নিশ্চয় অপরাধ চক্রটি একটি রাজনৈতিক শক্তির বলেই এমন নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছে। যে অপরাধীদের প্রশাসন গ্রেপ্তার করেছে, তাদের শাস্তি হবে, বা হবে না। কিন্তু, যারা এ ছেলেগুলোকে অপরাধী বানাতে সহায়তা করেছে, তারাতো পার পেয়ে যাবে। সেজন্য অবশ্যই এ অপরাধ চক্রের পেছনে শক্তিতে কারা, তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা উচিত। না হলে অপরাধী ধর্ষকদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে না। এভাবে যেন আর কেউ ধর্ষকরূপে বড় হতে না পারে, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে অবশ্যই ঘটনার নেপথ্যের শক্তিকে আইনের আওতায় আনতে হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)