ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে কিভাবে ধার্মিকরা সোচ্চার হয় তার আরও একটি নজীর স্থাপন হলো নিউজিল্যান্ডে৷ দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আহ্বান জানালো এক মুসলিম যুবক৷ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী তার কর্মতৎপরতা দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন। সেই সূত্র ধরেই তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আহ্বান জানালেন এই যুবক।
ওই মুসলিম তরুণ প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী, আমি শুধু আপনার জন্যই এখানে এসেছি। গত তিনদিন ধরে আমি শুধু কেঁদেছি। আল্লাহর কাছে আপনার জন্য দোয়া করেছি, আশা করছি অন্য নেতারাও আপনার নেতৃত্বকে অনুসরণ করবেন। আমার আরেকটি আশা, একদিন আপনিও ইসলামে দাখিল হবেন এবং জান্নাতেও আপনার দেখা পাব আমি।’
অত:পর জেসিন্ডা যুবকটিকে বলেন, ইসলাম মানবতার শিক্ষা দেয়, আমার মনে হয় আমার মাঝে সেই মানবতা আছে৷ প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রেক্ষিতে যুবকটি কিছু বলেছে কিনা জানা যায়নি৷ তবে প্রধানমন্ত্রী এই অতি উৎসাহী যুবকের আহবানের যে সমুচিত জবাব দিয়েছেন তা বলা যায়৷
ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে নিরীহ মুসলমানদের উপর হামলা করেছে এক খ্রিস্টান শ্বেতাঙ্গ জঙ্গী৷ হামলাকারী নিশ্চয়ই ভেবেছে বিধর্মী হত্যা করে সে নিজ ধর্মের সেবা করেছে৷ সে হয়তো এমনটিও ভেবে থাকতে পারে যে তার এই কর্মে ঈশ্বর তাকে স্বর্গবাস দিয়ে পুরস্কৃত করবেন৷ এক ধর্মের আরেক ধর্মের প্রতি এমন মনোবৃত্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে ধর্মান্ধতার উত্থান৷ নাহলে এই মুসলিম যুবক ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে কেনইবা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে আহবান জানাবে?
আর এই যুবক কি করে নিশ্চিত হলো যে সে জান্নাতে যাবে? তবে কি জেসিন্ডা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলে জাহান্নামে যাবে?
পরধর্মের প্রতি এমন অতি নেতিবাচক ও নিজ ধর্মের প্রতি অতি ইতিবাচক মনোবৃত্তিই কি ধর্মনিরপেক্ষতার একমাত্র অন্তরায় নয়? অথচ বর্তমান পৃথিবীতে ধর্মে ধর্মে বিদ্বেষ ও অসাম্প্রদায়িক শান্তিপূর্ণ অবস্থানের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই৷ চমৎকার কথা বলেছেন জেসিন্ডা৷ তিনি বলেছেন, ইসলাম মানবতার শিক্ষা দেয়,আমার মনে হয় আমার মাঝে সেই মানবতা আছে৷ হ্যাঁ,এটাই মূল কথা৷ প্রতিটি ধর্মই মানবতার শিক্ষা দেয়৷ সে মানবতাকে ধারণ করলে কি জান্নাতে যাওয়া যায় না?
নিজ ধর্মই সব ধর্মের সেরা৷ নিজ ধর্ম প্রবর্তকই সব ধর্ম প্রবর্তকের সেরা৷ নিজ ধর্মগ্রন্থই সকল ধর্মগ্রন্থের সেরা৷ এমন ভাবনাই মানুষকে পরধর্মবিদ্বেষী করে তুলছে৷ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদের হত্যাকাণ্ডে ব্যথিত হওয়ার এবং মুসলমানদের পাশে দাঁড়ানোর অর্থ এই নয় যে তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে৷ মানবতা দ্বারা তাড়িত হলে কে কোন ধর্ম মানলো সেটা কোন কথা নয়৷ মুসলমানের পাশে মুসলমান দাঁড়াবে অথবা যে দাঁড়াবে তাকেও মুসলমান হতে হবে এটা কোন মানবতার শিক্ষা?
এই শিক্ষা পৃথিবীকে সামনের দিকে না নিয়ে কেবল উল্টো দিকে নিতেই সক্ষম নয় কি? এই হামলায় বিশ্বময় সর্বস্তরের মানুষের মাঝে এক আতঙ্কও সৃষ্টি হয়েছে যে কোথায় কি ঘটনা ঘটে যায় ও সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের হামলায় নিরাপরাধ মানুষের মৃত্যু হয়৷ ১৫ মার্চের এই হামলায় বাংলাদেশী ৫ জন সহ ৫০ জন লোক মৃত্যুবরণ করে ও অনেকে আহত হন। এই ঘটনার পর নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা মানববতার পক্ষাবলম্বন করে নিউজিল্যান্ডের ১% মুসলমানদের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন এবং তিনি বলেন শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাস নয়, বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলা নয়, মানবজাতির শান্তিময় বিশ্ব গড়তে হবে। যেখানে থাকবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সবার জন্য বাসপোযোগী পরিবেশ।
তার এই আহবানে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শই ফুটে উঠল৷ তিনি নিশ্চয়ই ১% ভোটের লোভে এমন কথা বলেননি৷ বলেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে৷ পৃথিবীর দেশে দেশে অতিউৎসাহী ধর্মান্ধরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ধর্মের প্রতি ধর্মের বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজে৷ সম্প্রতি মিশরের এক নারী অধ্যাপক কি বলছে শুনুন৷
মিসরের বিখ্যাত আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামপন্থী নারী অধ্যাপক সুদাহ সালেহ বলেছেন, আল্লাহ মুসলিম পুরুষদের অমুসলিম নারীদের ধর্ষণ করার অনুমতি দিয়েছেন। তাদের লজ্জা দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ এ অনুমোদন দিয়েছেন।
সংবাদমাধ্যম দি ইনকুইজিটরের বরাত দিয়ে জি নিউজ জানিয়েছে, যৌনদাসীদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পথ আল্লাহ মুসলিম পুরুষদের জন্য খোলা রেখেছেন, এটা বিধানসম্মত। তবে সুদাহ সালেহ বলেন, কেবল মুসলিম ও তাদের শত্রুদের মধ্যে বিধিসম্মত যুদ্ধের সময় যৌনসম্পর্ক স্থাপনের জন্য নারীদের দাসী করা যেতে পারে। শত্রুর উদাহরণ হিসেবে এ অধ্যাপক ইসরায়েলের নাম বলেন। তার মতে, ইসরায়েলের নারীদের যৌনদাসী বানানো এবং ধর্ষণ করা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য। একজন শিক্ষাবিদ যদি ধর্মের নামে এমন ভয়াবহ ধর্মবিদ্বেষ ছড়াতে পারেন তাহলে সাধারন মানুষ কী করবে? এসব ব্যক্তির প্রভাবেই কি আইএসের যৌনদাসী হতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হতে নারীরা ছুটে যাচ্ছে না? তার এই বক্তব্যে কি ইসরাঈলরা মুসলিমদের প্রতি আরও বেশি ক্ষিপ্ত হবে না?
ধর্মে ধর্মে বড়ত্বের লড়াই নয়৷ বর্তমান পৃথিবীতে এক ধর্ম হতে আরেক ধর্মে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও অপ্রয়োজনীয়৷ প্রয়োজন সবধর্মের স্বাধীনতা৷ তারা সংখ্যায় কতজন তা বিবেচ্য নয়৷ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে মানুষ সে শিক্ষাটাই পেতে পারে৷ প্রতি দেশে দেশেই এমন ধর্মনিরপেক্ষতার নজীর স্থাপন হোক৷ প্রতিটি দেশের মূলনীতি হোক ধর্মনিরপেক্ষতা৷দেশে দেশে গড়ে উঠুক ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ বাস্তবায়নের লড়াই৷ আর সেটা কেবল কাগজে কলমে নয় আদর্শিক চেতনায়৷
সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) বাংলাদেশ মানবাধিকার ও পরিবেশ আন্দোলনের আয়োজনে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার ভবিষ্যৎ: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে জবি উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান বলেন, শুধু নিজের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করে অন্য ধর্মকে বাতিল মনে করার মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। কতিপয় উগ্র ধর্মান্ধ ব্যক্তির কার্যক্রম মূলত ধর্মের অবমাননার স্বরূপ। এগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে প্রকৃত ধর্ম নিরপেক্ষ সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
এটা খুবই বাস্তবসম্মত ও সময়ের চাহিদাভিত্তিক আয়োজন ও বক্তব্য৷ এমন বক্তব্যকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হোক৷ বাংলাদেশে রয়েছে মুসলিম,হিন্দু,বৌদ্ধ,খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীরা৷ কোন ধর্মানুসারীরা সংখ্যায় কম ও কারা বেশি সে হিসাবে ধর্মকে মূল্যায়ন করা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শসম্মত নয়৷ মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে তাদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করতে হবে এটা কি ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের সাথে চরম সাংঘর্ষিক নয়? মানুষ আর ধর্মের সাথে ধর্মের শত্রুতা ও বড়ত্বের লড়াই দেখতে চায় না৷ চায় সকল ধর্মের ধর্মাচরণের পূর্ণ স্বাধীনতা৷ চায় যথাযথ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ও পৃথিবী৷ হ্যাঁ, একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষতাই পারে ধর্মান্ধ উগ্রবাদ,জঙ্গীবাদ ও ধর্মভিত্তিক সকল সন্ত্রাসবাদের শেকড় উৎপাটন করতে৷
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)