চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দেশে সিভিল সোসাইটি বলে কিছু কি আছে?

সুশীলরা নানাভাবে নিজেদের বিতর্কিত করেছেন। সেই সুযোগে সরকার বাহাদুরও তাদের কোমর ভেঙে দিয়েছে। দেশে এখন বস্তুত সুশীল সমাজ বলে কিছু আর অবশিষ্ট আছে কি না, সেই প্রশ্ন তোলাই সঙ্গত।

ইংরেজি ‘সিভিল সোসাইটি’র যে বাংলা করা হয় সুশীল সমাজ, অনেকে সেটিকে পুরসমাজ, অরাষ্ট্রীয় সমাজ, জনসমাজ, লোকসমাজ বলতে পছন্দ করেন। তবে হালে বেশি প্রচলিত নাগরিক সমাজ। যদিও নাগরিক কারা এবং সংবিধান রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার মালিকানা যে জনগণ বা নাগরিকদের দিয়েছে, সেই ক্ষমতা কাঠামো ও প্রয়োগ নিয়েও যে বিস্তর বিভ্রান্তি ও জটিলতা রয়েছে-তাতে করে নাগরিক সমাজের ধারণাটিই ঘোলাটে হয়ে যায়।

২০০৭-০৮ সালে সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারে সুশীলদের একটি অংশ ছিলেন। ফলে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে নানা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যখনই নাগরিকদের কোনো অংশ নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন-যা সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েছে। তখন সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিগণ যেমন লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, কলামিস্ট বা তাত্ত্বিক সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বাক্যাক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিশেষ করে বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। একইভাবে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ- সিপিডির মতো সংগঠনকেও নাগরিক বা সুশীলদের সংগঠন বলে বিবেচনা করা হয়; তারাও অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে বক্তব্য দেওয়ায় বাচিক আক্রমণের শিকার হয়েছে। 

২.
সিভিল সোসাইটি বলতে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও কর্মস্থলের বাইরে এমন এক ধরনের সংঘবদ্ধ কর্মকাণ্ডকে বোঝায়, যেটি মুনাফা বা প্রশাসনধর্মী নয়; বরং যেখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে এক ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নানা শ্রেণিপেশার প্রতিনিধিত্বশীল নাগরিকরা একত্র হন।

বইপত্র ঘেঁটে যেটুকু জানা যায় তা হলো, সিভিল সোসাইটি ধারণার উদ্ভব উনিশ শতকে যখন গোষ্ঠীভিত্তিক সমাজের ধারণার বদলে সম্পত্তি ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। আরও পরিস্কার করে বললে, বুর্জোয়া বা মালিকশ্রেণি গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সিভিল সোসাইটির ধারণার উদ্ভব। অনেকেই মনে করেন বুর্জোয়া শ্রেণি আর সিভিল সোসাইটি অভিন্ন। যে কারণে মার্কস-এঙ্গেলসের ঘোষণা, ‘শ্রমিকশ্রেণি বা মেহনতি জনগণের কর্তব্য হলো এই সিভিল সোসাইটিকে উৎখাত করা।’ ফলে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যখন তাদের  সঙ্গে ভিন্ন মতপোষণকারী সুশীলদের সমালোচনা করেন, তখন মনে হতে পারে যে, তারা বোধ হয় মার্কস-এঙ্গেলস দ্বারা অনুপ্রাণিত!

দুর্ভাগ্যজনক হলো, এ মুহূর্তে আমাদের মাথার উপরে কোনো ছাতা অর্থাৎ কোনো অভিভাবক নেই। এমন কোনো একজন শিক্ষক নেই, যার কথা খোদ সরকারপ্রধানও গুরুত্ব দেবেন। এমন কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্ব নেই, যিনি জাতির যেকোনো দুঃসময়ে কোনো কথা বললে দলমতনির্বিশেষে সবাই সেটি গ্রহণ করবে। এখন যে জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা থেকে উত্তরণে আমাদের কী করণীয়, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কী করে দূরত্ব কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে পরামর্শ দেবেন, এমন কেউ কি আছেন এই সময়ে?

বরং রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের প্রভূত ক্ষতিসাধন করবে; ওই জনপদের বহু মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকিতে ফেলবে-এমন দাবি করে শুরু থেকেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতৃত্বে যখন আন্দোলন চলছে, তখন এই ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে প্রথিতযশা সাংবাদিকরাও যেভাবে নিজেদের ক্ষমতার কাছে সঁপে দিয়েছেন, তাতে এখন দেশের সুশীল সমাজের কী অবস্থা, তা খুব সহজেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।

সিভিল সোসাইটির একটা বড় অংশ শিক্ষক। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় এবং কোন যোগ্যতায় আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ হয়, কে বা কারা উপাচার্য হন বা হতে পারেন-তা কমবেশি সবার জানা। সুতরাং এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে কারো পক্ষেই আসলে ওই অর্থে সিভিল সোসাইটির ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়।

এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের (এনজিও) কর্তাব্যক্তিদেরও ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক এমন সব অনিয়মের খবর পাওয়া যায়, যার জন্য তারাও সব সময় ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে যায় এমন কথাবার্তা বলার ব্যাপারে খুব সাবধান থাকেন। এসব কারণে দেখা যাচ্ছে, যাদের নিয়ে সিভিল সোসাইটি গঠিত হবার কথা, তাদের কেউই আসলে বিতর্কের ঊর্ধে নেই।

একটি দৈনিক সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও বলেছেন, আমি মনে করি সিভিল সোসাইটি বলে কিছু নেই। কাউকে দেখতেও পাই না। এর বদলে কিছু ব্যক্তি, সংগঠন ও এনজিও আছে। যারা বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য- বিবৃতি দেয়, আন্দোলন করে। সিভিল সোসাইটি বলে ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর কোন ভিত্তি আদৌ দেখি না।

জনাব চৌধুরী আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোই একসঙ্গে থাকতে পারে না, তারা (সুশীল সমাজ) ঐক্যবদ্ধ থাকবে কিভাবে? আর যদি তারা একীভূত হয়েই যায় তাহলে তো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের কোনো তফাৎ থাকে না। তারাও রাজনৈতিক দল হয়ে যায়।

বাস্তবতা হলো, সুশীল সমাজ বলে আমরা যাদের চিনি জানি, তাদের অনেকেই কোনো না কোনো সরকারের তল্পিবাহক হয়ে সুবিধা নিয়েছেন। যেমন নানাবিধ ব্যবসার লাইন পেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন, বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছেন, গণমাধ্যমের লাইসেন্স পেয়েছেন বা অন্য কোনো উপায়ে সুবিধা পেয়েছেন। সিভিল সোসাইটির ব্যানারে নানারকম ফোরাম থাকলেও তাদের অনেকেই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অনুকূলে কাজ করে।

৩.
বলা হয়, একটি সমাজ বা রাষ্ট্র কতটা গণতান্ত্রিক অর্থাৎ সেই সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা আসলেই কতটুকু আছে, তার প্রধান মানদণ্ড হচ্ছে সেখানে ভিন্ন মতের চর্চা কতটুকু আছে? সুশীল সমাজ বা নাগরিক সমাজের মূল দায়িত্বটিই হলো তারা ভিন্ন মতের সৌন্দর্য দেখাবেন এবং ক্ষমতাসীনরা বুদ্ধিজীবীদের সেই ভিন্ন মত আমলে নিয়ে যতটুকু সম্ভব গ্রহণ করবেন। গ্রহণ না করলেও বুদ্ধিজীবীদের অন্তত গালাগাল করবেন না।

কিন্তু, আমরা বছর কয়েক ধরেই দেখছি, গালাগালি আর হুমকি ধমকির ভয়ে কিংবা কখনো ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা এবং কিছু নগদ সুবিধার লোভে বুদ্ধিজীবীরা মানে সুশীল সমাজের লোকেরা এমন কোনো বিষয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেন না, যা সরকারের কোনো বড় সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে। কিছু লেখক-শিক্ষক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মাঝে মধ্যে কথা বলেন টকশোতে, সংবাদপত্রে লেখেন-কিন্তু অনেক সময়ই তাদের একটা ভয় বা শঙ্কার ভেতরে থাকতে হয়। সব সময় যে সরকারের তরফে তাদের ওপর আক্রমণ আসে এমন নয়। দেখা যায়, যারা কথা বলেন না লেখেন, তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরাই সব সময় সব বিষয়ে খোলামেলা বলা বা লেখায় নিরুৎসাহিত করেন। বলেন, ‘সময় ভালো না’। এই সময় ভালো না অজুহাতে অনেক সময় নাগরিক সমাজ বা সুশীল সমাজ কিংবা বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে নীরব থাকেন অথবা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এমনভাবে কথা বলেন, যা আসলে কোনো পূর্ণাঙ্গ অর্থই তৈরি করে না। ফলে আমরা একদিকে বলি আমরা খুব গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছি; অন্যদিকে নাগরিক সমাজের কেউ কোনো সমালোচনা করলে তার গায়ে বিশেষ কোনো দলের বা গোষ্ঠীর তকমা লাগিয়ে দিই। ফলে এই সিল খাওয়ার ভয়েও অনেক সময় সিভিল সোসাইটি চুপ থাকে।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)