চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণহীন এবং এর কারণ

বিগত চার দশক ধরে পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বরং ছোট ভূখন্ডের এ দেশটিতে রীতিমতো জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে। অধিক জনসংখ্যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে জন জীবনে।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল ১১ কোটি ১৪ লাখ। ১০ বছর পর ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী দেশে জনসংখ্যা ১২ কোটি ৪৩ লাখ। আর বাংলাদেশের জনসংখ্যা বর্তমানে ১৬ কোটি ৪৬ লাখ  ৫০ হাজার।
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) হিসাব মতে, দেশে প্রতি ১১ সেকেন্ডে একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে। আর প্রতি মিনিটে জন্মাচ্ছে গড়ে ৮টি শিশু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি মিনিটে সারা পৃথিবীতে জন্মায় ২৫০ শিশু। এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশেই জন্মাচ্ছে ৯ জন।
পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সংক্রান্ত সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব, যথাযথ উদ্যোগহীনতার অভাব সর্বোপরি দেশে নানাবিধ সমস্যা বিরাজমান থাকায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।  জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে খুব শীঘ্রই দেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটবে এবং জাতীয় জীবনে নেমে আসবে মহাবিপর্যয়। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য মতে, সক্ষম দম্পতিদের ৪৪ শতাংশই পরিবার ছোট রাখতে কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করছেন না।
বস্তুত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পরিবারের দম্পতির মধ্যে এক ধরণের সচেতনতা ও তাগিদবোধ থাকতে হয়, কিন্তু তা না থাকায় এবং সরকারি জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি কার্যক্রম অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
অন্য দিকে আমাদের দেশে শিক্ষার হার খুব কম। নারী শিক্ষার হার সেক্ষেত্রে আরো পিছিয়ে। নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাও নেই, বাল্যবিবাহের সমস্যাসহ পুরাতন ধ্যানধারণা অত্যন্ত প্রকট। এ সমস্ত সামাজিক সমস্যার কারণে এবং শহুরে-উচ্চবিত্ত-শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সচেতনতাবোধ তৈরি হলেও হতদরিদ্র, ভূমিহীন, উদ্বাস্তু মানুষ পরিবারের সদস্য সংখ্যা সীমিত রাখার ব্যাপারে আন্তরিকভাবে তাগিদবোধ না করার কারণে বাড়ছে জনসংখ্যা।
জনসংখ্যাকে শুধু নিয়ন্ত্রণের দৃষ্টি দিয়ে না দেখে বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে যেমন শিক্ষার হার বিশেষত নারী শিক্ষার হার বাড়ানো, দেরীতে বিয়ের ব্যবস্থা করা, পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর সঠিক সরবরাহ, পুরনো ধ্যানধারণা পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
 জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পুরুষের যে ভূমিকা হওয়া উচিত ছিল তা আমাদের সমাজে নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারকারীদের শতকরা ৯৫ ভাগই নারী। অন্যদিকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পুরুষের ভূমিকা মাত্র ৫ শতাংশ। যদি এ অবস্থা হয় তবে পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা যে শুধু অবহেলিত তাই নয়, তারা নিগৃহিত এবং তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোকে গলা টিপে জনসংখ্যার উর্ধ্বগতি রকেট আকারে ছুটেছে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য আগে যে রকম ব্যাপক হারে গণমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করা হতো, বর্তমান সময়ে তা হয় না। ফলে নবদম্পতি অথবা যারা সন্তান ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন দম্পতি তাদের অনেকের কাছেই বিভিন্ন প্রকার জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা যেমন জানা নেই, তেমনি কোথায় গেলে কি ধরণের সেবা পাওয়া যাবে সে ব্যাপারেও তারা অজ্ঞ। সাথে লজ্জাবোধ তো আছেই। অর্থাৎ ব্যাপক হারে যে আচরনগত পরিবর্তন কার্যক্রম (বিসিসি) পরিচালিত হবার কথা তা মাঠ পর্যায়ে না থাকায়  দেশে জনসংখ্যা কমানো সম্ভব হয়ে উঠছে না।
প্রায়শই পরিবার পরিকল্পনার পদ্ধতির স্বল্পতার কথা শোনা যায়, যা পদ্ধতি গ্রহণকারীদের নিরুৎসাহিত করে। ফলে তারা পদ্ধতি গ্রহণ বন্ধ করে দেয়। আর এর অনিবার্য ফলশ্রুতি হচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তাছাড়া যে সকল নারী ইনজেকশন, ক্যাপসুল অথবা আইইউডি ব্যবহার করে তাদের শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে সেই সমস্যা সমাধানের জন্যে তাৎক্ষনিকভাবে ক্লিনিক্যাল সেবা পাওয়া যায় না। এ ধরণের অভিযোগ সর্বত্র। ফলে মহিলারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার ছেড়ে দেন এবং সহজেই সন্তান সম্ভবা হয়ে পড়েন।
এদিকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বাড়ার বর্তমান হার গত যে কোন সময়ের তুলনায় বেশি। পাশাপাশি বাড়তি জনসংখ্যার নেতিবাচক চাপ পড়ছে দেশের সবখানে। তাতে সরকার জনসংখ্যা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি কার্যক্রম, সহ উন্নয়নমূলক কাজে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে।
অন্যদিকে দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের তথ্য মতে, সক্ষম দম্পতিদের ৪৪ শতাংশই পরিবার ছোট রাখতে কোনো পদ্ধতি ব্যবহার করছেন না। জাতীয়ভাবে ১৭ দশমিক চার শতাংশ দম্পতির পরিবার পরিকল্পনার চাহিদা অপূর্ণ রয়েছে। মেয়েদের গড় বিয়ের বয়স ১৬ দশমিক চার বছর। এক-তৃতীয়াংশ মহিলা ২০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মা হয়ে যাচ্ছেন।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, দেশের জনসংখ্যা নীতি হালনাগাদ করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়র থাকলেও এই সেক্টর থেকে বেশ কয়েক বছর ধরে কোন উদ্যোগ নেয়া হয় নি। উপরন্তু পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে দক্ষ জনশক্তি যারা এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন তাদের অনেকে অবসরে গিয়েছেন। অথচ সেই পদগুলো আজ পর্যন্ত উপযুক্ত কর্মকর্তা/কর্মচারী দিয়ে পূরণ করা হয়নি। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সকল উচ্চ পদগুলোতে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা যোগদান করছেন। অন্যদিকে টেকনিক্যাল পদগুলো ননটেকনিক্যাল লোক দিয়ে পরিচালনা করায় পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। যেমনি মুখ থুবড়ে পড়েছে জাতীয় পুষ্টি কার্যক্রম।
শুধু তাই নয় দেশের অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি দারিদ্রতা বাড়ানোর পাশাপাশি জাতীয় বাজেট ব্যবস্থাপনাসহ সরকারের সব কাঠামোতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ না থাকায় জনসংখ্যা যেমন দ্রুত বাড়ছে,তেমন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জনসমস্যা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ক্রমাগত ভূমিহীনের সংখ্যা বাড়ছে, বাস্তুহারা হয়ে পড়ছে মানুষ। একই সঙ্গে বেকারত্ব, খাদ্য সংকট তো বটেই, চিকিৎসা সংকট, বাসস্থান সংকট প্রকট আকার ধারণ করছে। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে সব ধরণের অপরাধ।
বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে সন্তান নেবার হার কম হলেও নিম্নবিত্ত পরিবারে সন্তান ধারণের হার এখনো আশংকাজনক। বেশ কিছু ছিন্নমূল পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের ধারণা একটি সন্তান মানে একটি আয়ের উৎস। সন্তানের সংখ্যা বেশি হলে তাদের প্রতিদিনের আয়টাও বেশি হয়। আর এমন আয়ের সুযোগ তারা ছাড়তে চান না। তাই তারা বাড়িয়েই চলেছেন পরিবারে সদস্যসংখ্যা।
দেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবী। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে আগামীতে দেশের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনাই অকার্যকর হয়ে পড়বে সন্দেহাতীতভাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)