চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দেশে কেন কমছে চামড়ার দাম?

তৈরি পোশাক শিল্পের পর চামড়া শিল্পই দেশের অর্থনীতির জন্য দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচ্য। তবে সম্ভাবনাময় এ খাতের প্রধান কাঁচামাল চামড়ার দাম গত ৭ বছরে সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের ট্যানারিগুলোর পরিবেশ দূষণের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া রপ্তানি কমে যাওয়া, সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তর, ট্যানারিপল্লীতে সিইটিপি সমস্যা, জমির দলিল হস্তান্তরসহ নানা বিষয় নিয়ে চামড়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব, অবকাঠামোগত সমস্যা, সঠিক পরিকল্পনার অভাব, চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে চামড়ার দাম কমে যাচ্ছে।

ফলে এ শিল্প থেকে গত ২ বছরে অব্যাহতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমছে।

তবে তারা বলছেন, এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ট্যানারির পরিবেশ উন্নত করতে হবে। ট্যানারি পল্লীর বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করাসহ এর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে চামড়াখাত ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু এর জন্য আরো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ৭ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়লেও বিপরীত স্রোতে রয়েছে চামড়ার দাম।

ঢাকায় ২০১৩ সালে যেখানে গরুর চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৮৫ থেকে ৯০ টাকা, সেখানে এ বছর এই চামড়ার দাম ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় নেমে এসেছে। অর্থাৎ অর্ধেকে নেমে এসেছে। একই সময় খাসির চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। দুই ভাগ কমে এ বছরে এর দাম নেমে এসেছে ১৮ থেকে ২০ টাকায়।

ফাইল ফটো

চামড়ার দাম কেন কমছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে চামড়া ব্যবহার কমে গেছে। ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পের ট্যানারি স্থানান্তরের পরই মূলত এই শিল্পের দৈন্যতা শুরু হয়। এর আগে ভালই রপ্তানি হতো।

‘২০১৭ সালে চামড়াজাতীয় পণ্য রপ্তানি ছিল ১৩০ কোটি ডলার। সেই রপ্তানি এখন ৯৪ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে এক দিনে ২২২টি ট্যানারি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই ট্যানারিগুলো তখন সাভারে গিয়ে উৎপাদন করার মত প্রস্তুত ছিল না। এ কারণে যেসব বিদেশি ক্রেতা ২০/৩০ বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতো তারা ওই সময় পণ্য না পাওয়ায় এদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

এরপর নতুন করে অন্য সমস্যা দেখা দিল অর্থাৎ চীন-আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ৩০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়েছিল। এসব কারণে চামড়ার দাম দিন দিন কমে যাচ্ছে।’

তবে চামড়ার দাম আবারো ঘুরে দাঁড়াবে জানিয়ে সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, এর জন্য ট্যানারির পরিবেশগত মান উন্নত করতে হবে। চামড়ার উপর আন্তর্জাতিকভাবে একটা সনদপত্র দেয়া হয়। এর নাম হচ্ছে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি)। আন্তর্জাতিক চামড়া বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে এসে ট্যানারি পল্লী পরিদর্শন করার পর ওই সনদপত্র দিবে। এরপর আশাকরি এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে।

চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে পরিবেশ দূষণ মূল কারণ বলে জানিয়েছেন হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন। তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বিশ্ব বাজারে চামড়ার বাজার কম নয়। কিন্তু এখন ইউরোপ-আমেরিকা বাংলাদেশের কাছ থেকে চামড়া জাতীয় পণ্য নিচ্ছে না। যেমন বাংলাদেশের প্রধান বাজার ছিল ইউরোপের ইতালি, জার্মানি, স্পেন, হল্যান্ড, ফ্রান্স। কিন্তু পরিবেশগত দূষণের ফলে তারা এখন আর পণ্য নিচ্ছে না। কারণ সিইটিপি ঠিক হয়নি, ডাম্পিং স্টেশনগুলো কমপ্লিট হয়নি। ফলে নদী দূষণসহ নানা সমস্যা হচ্ছে।

এছাড়া ক্রেতারা নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। যেমন অ্যাপেক্স, বে জাতীয় ব্র্যান্ডের জুতা বিদেশিরা কিনছে। কিন্তু তাদের শর্ত অনুযায়ী এসব পণ্য তৈরি করতে হলে তাদের পছন্দমত দেশ থেকে চামড়া কিনে আনতে হবে। এক্ষেত্রে কোথায় থেকে চামড়া কিনতে হবে সেই দেশের নাম ও কোম্পানির নামসহ বলে দেয়া হয়। এ কারণে এসব বড় বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশের চামড়া কাজে লাগাতে পারছে না।

তিনি বলেন, ৭০ সেন্ট বা ৫৯ টাকায় বাংলাদেশের এক ফুট চামড়া বিক্রি করা যায় না। অথচ ক্রেতাদের শর্ত পূরণ করতে এসব ব্র্যান্ড অন্য দেশ থেকে ২ ডলার ২০ সেন্ট বা ১৮৬ টাকা দিয়ে এক ফুট চামড়া কিনছে।

তবে এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ট্যানারির পরিবেশ উন্নত করতে হবে। পরিবেশ দূষণ রোধ করা ও ট্যানারি পল্লীর বিদ্যমান সমস্যা সমাধান করাসহ এর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য আরো এক থেকে দেড় বছর সময় লাগতে পারে।

হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও চামড়া ব্যবসায়ী আলী হোসেন বলেন, কৃত্রিমভাবে গরু মোটাতাজা করা হয়। এছাড়া এখন গরম। ফলে এসব গরুর চামড়া বেশি সময় টেকসই হয় না। ৪ থেকে ৬ ঘন্টার মধ্যে চামড়ায় লবণ না দিলে পঁচে যায়। তাই কিভাবে দীর্ঘ সময় চামড়া সংরক্ষন করা যায় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।

তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান চামড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে ওয়েট ব্লু চালু (চামড়া কাঁচা থাকা অবস্থায় প্রক্রিয়াজাত করা যাতে ৬ মাসের মধ্যে চামড়া না পঁচে অর্থাৎ চামড়া সংগ্রহের পরই তাতে লবণ দেয়ার প্রক্রিয়া) করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে ওয়েট ব্লু চালু করা হয়নি। এই প্রক্রিয়ায় চামড়া নষ্ট না হওয়ার আগেই দ্রুত বিক্রি করে দেয়া যায়। তাই সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির তথ্যমতে, দেশে সারাবছর ১ কোটি ১০ লাখের মত গরু-মহিষ জবাই হয়। শুধু কোরবানিতে প্রায় ৫৫ লাখ গরু-মহিষ, আর ৩৫ থেকে ৪০ লাখের মতো ছাগল জবাই হয়।

এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক রবিউল আলম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, এখন বাংলাদেশের চামড়া রপ্তানি হয় না বললেই চলে। তাই দিন দিন দাম কমে যাচ্ছে। চামড়া খাতকে শক্তিশালী করতে এখন সরকারের প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়ছে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া খাত থেকে ৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যদিও এ সময়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯১ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। এ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ এবং আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ আয় কমেছে। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আগের অর্থবছরের (২০১৭-১৮) একই সময়ে এ খাত থেকে আয় হয়েছিল ৯১ কোটি ৬৭ লাখ ডলার।