চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

দেশে একটি বিরোধী দল দরকার

একটা অস্থিরতার কাল পার করছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিন-রাত একাকার করা শ্রমের ফসল খাওয়ার জন্য দেশজুড়ে এক দুর্বৃত্তের দল সৃষ্টি হয়েছে। গত এক দশকের কিছু বেশি সময়ে বাংলাদেশ স্মরণকালের সর্বোচ্চ উন্নয়নের শিখরে এসেছে। অবকাঠামো, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তির ঢের উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উল্লম্ফন ঘটেছে দেশে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটেছে, দারিদ্র্য কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে, মাতৃমৃত্যু-শিশুমৃত্যুর হার কমেছে, শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে ব্যাংক রিজার্ভ বেড়েছে, প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। ১৯৭১ সালে যে বাংলাদেশকে মার্কিনীরা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে অভিহিত করেছিলো, সেই পশ্চিমারাই আজ বাংলাদেশের স্বর্ণালী ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত।

এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ অবদানে। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর দূরদর্শী পদক্ষেপের কারণেই বাংলাদেশ আজ এমন অবস্থানে। দেশের উচ্চ জনসংখ্যাকে তিনি জনসম্পদে রূপান্তরের কাজটি করেছেন সফলতার সাথে। তিনি কাজের জন্য একটা চমৎকার টিম সৃজন করতে পেরেছেন। আবার সময়ে সময়ে তার টিমমেটদের পরিবর্তনের মাধ্যমে তিনি কর্মযজ্ঞে আরো গতি আনার উদ্যোগ নিয়েছেন।

কিন্তু এক দশকের এই উন্নয়নের গুড় খেয়ে যাবার লক্ষ্যে দুর্বৃত্তায়নের পিঁপড়ারাও আজ বেশ সক্রিয়। বরং ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যাচ্ছে, কাজের চেয়ে অকাজের লোকের সংখ্যাই বেশি। তারা দুর্নীতি করছে, লুটপাট করছে, সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন হয় এমন সব ধরনের কাজের মধ্যেই তারা রয়েছে। দুর্নীতিতে বৈশ্বিক চ্যাম্পিয়ানশিপ ঘোচানো গেলেও কার্যত দুর্নীতি কমেনি। চ্যাম্পিয়ানশিপ ঘুচেছে সম্ভবত অন্য দেশগুলোর দুর্নীতি বাড়ার কারণে। আমাদের কি কমেছে?

বরং এই দশ বছরে ব্যাংক লুটের ঘটনা বেড়েছে, শেয়ার বাজার সাফ করে দিয়ে হাজার হাজার মধ্যবিত্তের স্বপ্ন হত্যা করা হয়েছে। এমন ঘটনা নিশ্চয়ই বিশ্বে বিরল যে একটি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরাই ব্যাংকটিকে লুটে সাফ করে দিয়েছেন। ফারমার্স ব্যাংকের ক্ষেত্রে ঘটনাটি এমনই। শেষতক বাধ্য হয়েই ব্যাংকটিকে বাঁচাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাত চালাতে হয়েছে। নতুন নাম নিয়ে আস্থাহীন ব্যাংকটি আবার যাত্রা শুরু করেছে। ব্যাংক লুটপাটের সাথে জড়িত হিসেবে যেসব নামগুলো আসছে, তারা আবার মহাক্ষমতাধর। তাদের বিচার করার মতো শক্তিমান হতে পারলো না এখনও বাংলাদেশ। 

শেয়ার বাজার লুট হয়েছে দশ বছরে বারবার। বিএনপি আমলের এক মহা ক্ষমতাধরের সাথে মিলে চলতি আমলের আরেক ক্ষমতাধরের যুগল লুটপাটের অভিযোগ শোনা যায়। হাজার হাজার স্বল্প আয়ের মানুষের স্বল্প পুঁজিগুলো একত্রিত করে লুটে নিয়ে শেষ করে দেওয়া হয়েছে। কোনো বিচার নেই। নাকি বিচারের শক্তি অর্জিত হয়নি বাংলাদেশের?

বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতেও নানা লুটের কাহিনী এখন সামনে আসছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোতেও দস্যুদের লোলুপ দৃষ্টি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সহ-প্রকল্প আবাসিক ভবনে একেকটি বালিশ তুলতে ৭৬০ টাকা খরচের গল্প তো এখন দেশের চুরি-দুর্নীতির রূপকে পরিণত হয়েছে। অপ্রয়োজনীয় আরো কতো কতো খাত বানিয়ে নিয়েও দুর্বৃত্তের দল নিত্যনতুন চুরির আয়োজন করে চলেছে মহাসমারোহে। এদেরও বিচার কই?

দেশ থেকে অর্থ লুটে নিয়ে বিদেশে পাচারের মচ্ছবও চলছে। দেদারসে টাকা চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের ফাঁকে টাকা যাচ্ছে, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে টাকা যাচ্ছে। পাচারকারীদের আরো যে কতো পথ জানা আছে! শুধু বিচারের পথ জানা নেই কারোই। যদিও আমাদের সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী বলে গেছেন, এসব কোনো টাকাই না। কিন্তু অন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দুর্নীতি ও পাচার যদি অর্ধেকও রোধ করা যেতো, তবে প্রবৃদ্ধি গিয়ে ঠেকতো ১২ শতাংশে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ১২ তো দূরের কথা, দুই অঙ্কের কোটায় প্রবৃদ্ধি ছোঁয়া মানেই তো বিরাট ব্যাপার। সরকারপ্রধান ও তার টিমমেটদের পরিশ্রম ও দূরদর্শিতার এই ফসল খেয়ে যাচ্ছে কতিপয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুর্বৃত্ত।

খুন-ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে স্মরণকালের সর্বাধিক। বাংলাদেশ যেন এখন ধর্ষণের রঙ্গমঞ্চ। উদাহরণ দিয়ে বলার প্রয়োজন নেই, সাম্প্রতিককালের তনু থেকে নুসরাত ঘটনাগুলো সবাই জানি। এখানেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের যোগসাজশ। জামায়াতের সাথে মিলে আওয়ামী লীগ নেতার অপরাধচক্র। সাথে যুক্ত আছে অসৎ পুলিশকর্তারাও। কারাগারের মধ্যেও আজ নিরাপদ নয় কেউ। সম্প্রতি পঞ্চগড় কারাগারে এক আইনজীবীকে আগুনে পুড়িয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রাম কারাগারেও এক আসামিকে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনার অপরাধীরা রাষ্ট্রের চেয়েও কি শক্তিশালী যে তাদের বিচার হবে না?

আজকের বাংলাদেশে একের পর এক সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েই চলেছে। যে আওয়ামী লীগের উপর দেশের সংখ্যালঘুদের নিরন্তর আস্থা, সেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-এমপিদের দ্বারাও তারা জমি-ভিটা-মাটি হারাচ্ছেন, নির্যাতিত হচ্ছেন। নিরব দেশত্যাগের সংখ্যা কোনোভাবেই কমানো যাচ্ছে না। আজকের বাংলাদেশে কৃষক তার ধানের দাম পাচ্ছেন না, পাটকলের শ্রমিকদের মাসের পর মাস মজুরি বন্ধ থাকার কারণে রাস্তায় নেমে অবরোধ করতে হচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে- কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু উন্নয়নের এই সুফল যাচ্ছে সমাজের উঁচুতলায় অবস্থানকারী কিছু মানুষের ঘরে। নিচুতলার মানুষরা সুফল থেকে যোজন যোজন দূরে। উঁচুতলা আর নিচুতলার মধ্যে ব্যবধান ঘোচানোর মতো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই।সংরক্ষিত নারী আসন-মনোনয়নপত্র

নির্বাচনী প্রক্রিয়াও আজ জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। সম্প্রতি স্থানীয় সরকারগুলোর যতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার কোনোটিতেই কোনোভাবেই সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রমুখী করা যাচ্ছে না। নির্বাচনী ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থাহীনতা আজ এতোটাই বেড়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়ার সাথে সাথে জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশে দুর্বল হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কার কথা হচ্ছে, দেশের সব জামায়াতকর্মী এখন ভিড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাতার নিচে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবান অংশ, মন্ত্রী-এমপিসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিরা দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাবলয় পোক্ত করার লক্ষ্যে জামায়াত-বিএনপি’র দুর্বৃত্তদের দলে দলে আওয়ামী লীগে ভিড়িয়েছেন এবং ভিড়াচ্ছেন। এই হঠাৎ আগন্তুক নব্য আওয়ামী লীগাররা স্থানীয় পর্যায়ে আরো বেশি অপরাধপ্রবণতা ও জনবিরোধী কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে। এদের বিরুদ্ধে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলছেন। কিন্তু তাতেও জামায়াতের আওয়ামীকরণের স্রোত বন্ধ হচ্ছে না।

দেশে দক্ষিণপন্থী ইসলামি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করার নামে আওয়ামী লীগ তাদেরকে আজ কোলে তুলে নিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের মতো ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রবিরোধী অন্ধকারের শক্তির কাছে আওয়ামী লীগ বারবার নত হয়েছে। এমনকি তাদের দাবি অনুযায়ী দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মতো মৌলিক কাঠামোতেও আওয়ামী লীগ ছুরি-কাঁচি চালিয়েছে। আওয়ামী লীগের এই দক্ষিণপন্থী ঝোঁক কেবল তার নিজের জন্যই নয় শুধু, বাংলাদেশের জন্যই এক মহাবিপদসঙ্কেত।

দেশে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা লাগলেও সে তেড়ে উঠে বলে, ধাক্কা দিলেন কেন? জানেন না আমি আওয়ামী লীগ করি? দেশে আওয়ামী লীগের বাইরে এখন যেন কেউ আর নেই। এই যে আওয়ামী লীগের এতো বাড়বাড়ন্ত, এটাই ভয়ের, দুশ্চিন্তার। কারণ সরকারি দল আওয়ামী লীগ কিন্তু দেশে কোনো বিরোধী দল নেই। বিরোধী দল না থাকাটা গণতন্ত্রের জন্য খুব ভয়ঙ্কর। তাতে সরকারি দলের জন্যও বিপদের আশঙ্কা থাকে। কারণ ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মতো কেউ থাকে না। এখন সবাই তো কেবল তেলবাজিতে মত্ত আছে। ভুল ধরিয়ে দেওয়া বা সমালোচনার কেউ নেই। ফলে ভুলের ফাঁদে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে সরকারি দলের।

কিন্তু বিরোধী দল নেই কেন? সরকার কি তবে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না? চরম নিপীড়নের পথে কি হাঁটছে শেখ হাসিনার সরকার? বিষয়টি কিন্তু তেমনও নয়। আসলে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতে এই বাংলাদেশের জন্ম। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরে এসেও মুক্তিযুদ্ধই রয়ে গেছে এ জাতির সমস্ত চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতি আর অস্তিত্বের শিকড় হিসেবে। এখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিই এখন বিরোধী দল। তারা একটা সময় দেশি-বিদেশি নানা শক্তির মদদে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির উপর প্রবল আক্রমণ হেনে তাদেরকে দুর্বল করতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু নানা সংগ্রাম আর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত দশককাল জুড়ে দেশ মুক্তিযুদ্ধ-অভিমুখী পুনর্যাত্রা করেছে। যদিও স্বাধীনতাবিরোধী শত্রু চক্র এখনও প্রচণ্ড মাত্রায় সক্রিয়। কিন্তু বাংলাদেশে খুব সহজে আর একাত্তর-বিরোধী কোনো শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

ফলে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনীতির প্রধান প্লাটফর্ম জামায়াতে ইসলামি কিংবা তাদের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রধান মিত্র বিএনপি আজ যে বিধ্বস্ত অবস্থায় আছে, সেখান থেকে আর সহসাই কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। আর ক্রমাগত জনবিরোধী রাজনীতি করতে করতে তাদের জনবিচ্ছিন্নতা কেবলই বেড়েছে।অপরদিকে সংসদের আনুষ্ঠানিক বিরোধী দল যারা আছে, জাতীয় পার্টি, তারা যে প্রকৃত অর্থে বিরোধী দলই নয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ নির্বাচনে জিতে পাওয়া আসন নিয়ে বিরোধী দলের আনুষ্ঠানিকতা গ্রহণ করলেও যে তাদের দ্বারা কার্যকর বিরোধী দল হওয়া সম্ভব নয়, সে তো পাগলেও বোঝে। তার উপর কোনো ধরনের রাজনৈতিক আদর্শহীন একটি দল যে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে পারে না, তারও জ্বলজ্বলে প্রমাণ জাতীয় পার্টি। ক্যান্টনমেন্টজাত এই দলটির সুপ্রিমো হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের চলমান বয়সজনিত শারীরিক অসুস্থতাই তা স্পষ্ট করে দিচ্ছে। ফলে এরশাদের জীবনাবসানের পর এই দলটির অস্তিত্ব আর খুব বেশি দিন থাকবে না।

অন্য যেসব বিরোধী দল আছে, তাদের মধ্যে মধ্যপন্থী অধিকতর উদারপন্থী দলগুলো হলো ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, আ স ম আব্দুর রবের জেএসডি ইত্যাদি। এরাও গত জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে জামায়াত-বিএনপি’র সাথে ঐক্য করে নিজেদেরকে সেই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির কাতারেই দাঁড় করিয়েছে।

অন্যদিকে বামপন্থীদের অবস্থাও এই জমিনে বেশ সঙ্গীন। ভারতীয় উপমহাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা লাভের একশ বছর পূর্তি হবে আগামী বছর। কিন্তু এই শতবর্ষেও বামপন্থীরা বাংলাদেশে দৃশ্যমান কোনো শক্তি হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। মতাদর্শিক দ্বন্দ্বের নামে কার্যত নেতৃত্বের ঠুনকো দ্বন্দ্বে তারা ভাঙতে ভাঙতে শত টুকরো হয়েছে। তার পাশাপাশি সঠিক সময়ে সঠিক রাজনীতির সূত্র তারা এ যাবতকালেও ধরতে পারেনি। ফলে মানুষের অন্তরের ভাষা অনুধাবনে বারবার ব্যর্থতার কারণে তারা খুব সহজেই যে একটা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে- এমন শুভ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের বামপন্থীরা এই সময়ে এসে মোটের উপর আবার দুই ভাগে বিভক্ত। এদের মধ্যে সরকার সমর্থক ১৪ দলীয় জোটের বাইরে থাকা বামপন্থীরা অনেক ক্ষেত্রে ন্যায্যতার প্রশ্নে সরব হলেও একদিকে জনভিত্তি গড়তে না পারা, অন্যদিকে ক্ষেত্রবিশেষে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির সাথে পরোক্ষ ঐক্য গড়ার কারণে দাঁড়াতে পারছে না। এদের একাংশ সাম্প্রতিক বিভিন্ন সময়ে ওই ঐক্যফ্রন্টের দিকেই ঝুঁকেছে। অতি সম্প্রতি ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছেন। সরকারের বাইরে থাকা বামপন্থীদের কেউ কেউ বিএনপি-জামায়াতের ওই সম্প্রসারিত জোটে সামিল হতেও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

অপরদিকে সরকারের সাথে থাকা তথা ১৪ দলভুক্ত বামপন্থী দলগুলো রাজনৈতিক সঠিকতার প্রশ্নে যৌক্তিক জায়গায় থাকলেও কার্যক্ষেত্রে গত দশ বছরে সংগঠন হারিয়েছে অনেকখানি। বলা চলে, নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক অবস্থান নিতে না পারার কারণে কার্যত সরকারের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার ফলে আওয়ামী লীগই অনেকখানি বিলীন হয়েছে। এই নির্ভরশীলতা থেকে তারাও সহসাই আর বেরিয়ে আসতে পারবে না। এখন মুখে তারা যতই সরকারের সমালোচনা করুক না কেন, সরকারি জোটে থেকে সরকারবিরোধীতার এই গল্প মানুষ গ্রহণ করে না।

ফলে দেখা যাচ্ছে, বামপন্থা বলেন আর দক্ষিণপন্থা- কার্যত দেশে এই মুহূর্তে কোনো বিরোধী দলই নেই। অন্যভাবে বললে, দেশে এমন কোনো সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি নেই যার বা যাদের উপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে। দেখা যাচ্ছে, খোদ আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ নেতাকর্মীরাই আজ আওয়ামী লীগের ভুলত্রু টি ও জনবিরোধী কাজকর্মের প্রচণ্ড সমালোচনা করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

অপরদিকে রাজনৈতিক সাংগঠনিক কোনো প্লাটফর্মের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন কিছু কণ্ঠই আজ বিরোধী শক্তির ভূমিকা পালন করছেন। তবে রাজপথে সেই বিরোধী কণ্ঠও খুব একটা উচ্চকিত নয়। দেখা গেছে, ডাকসু এবং তার হল সংসদগুলোর নির্বাচনে বিজয়ী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের পরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিএনপি’র জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল নয়, বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন নয়, আবির্ভূত হয়েছে স্বতন্ত্র ছাত্রদের জোট। অর্থাৎ দেশের মানুষের সবচেয়ে সচেতন অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছেও সরকারি দলের বিপরীতে অপরাপর বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কোনোভাবেই আস্থার জায়গায় নেই। বরং সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা অন্য কণ্ঠগুলোই ঢের আস্থার জায়গা নিতে পেরেছে।

এই অবস্থা কিন্তু মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা বিরোধী কণ্ঠ যে কোনো সময় কোনো না কোনো অপশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে যেতেই পারে। ফলে বিরোধী কণ্ঠের জন্য একটা সাংগঠনিক প্লাটফর্ম খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে অবশ্যই সেই নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে হবে মুক্তিযুদ্ধকেই ভিত্তি করে। দীর্ঘদিন টানা ক্ষমতায় থেকে আর ক্ষমতার রাজনীতির অঙ্ক মিলাতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নানা বিচ্যুতি হলেও মোটের উপর তারা স্বাধীনতার স্বপক্ষ শক্তি। দলটি বঙ্গবন্ধুর আমলের সোশ্যাল ডেমোক্রেসির ধারা থেকে দূরে সরে গেলেও, ডানপন্থার দিকে খানিকটা ঝুঁকে পড়লেও মোটের উপর তারা এখনও আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনীতিরই প্রতিভূ।

ফলে আওয়ামী লীগের বিপরীতে যে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান এখানে দরকার তা কোনোক্রমেই বিএনপি-জামায়াতের বিকল্প শক্তি নয়, হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের উদার ধর্মনিরপেক্ষ সামাজিক গণতান্ত্রিক শক্তি। মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, কল্যাণ অর্থনীতি আর সব মানুষের জন্য একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যেই দানা বাঁধুক নয়া রাজনৈতিক মেরুকরণ। তাতে আওয়ামী লীগের জন্যও ক্ষতি নেই। তার চেয়ে বড় কথা, তাতে লাভ বাংলাদেশেরই।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)