মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্ণ হয়ে ৪৬ বছরে পা রাখতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে উন্নয়ন ও গণমাধ্যমকর্মী মোহাম্মদ গোলাম নবী আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন-ব্যর্থতা ও করণীয় বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখছেন চ্যানেল আই অনলাইন পাঠকদের জন্য। পর্ব-৪ (ডিসেম্বর ৩, ২০১৬)
এক.
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতালের নাম ছিল- ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। এই হাসপাতাল তৈরিতে মূল চেতনা ছিল- আর্তমানবতার সেবা করা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী ডাক্তাররা দেশমাতৃকার সেবার জন্য সংগঠিত হন। ১ হাজারের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশী ডাক্তাররা মিলে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন গঠন করেন। ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। দেশকে সেবা করার মহানব্রত নিয়ে ২৯ বছর বয়সী তরুণ ডাক্তার জাফরুল্লাহর নেতৃত্বে আরো কয়েকজন প্রবাসী ডাক্তার দেশে ফিরে চলে যান যুদ্ধ এলাকায়; এবং সেখানে মুক্তিযুদ্ধে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। পাশাপাশি ভারতে আশ্রয় নেওয়া বাংলাদেশীদেরও তারা চিকিৎসা দিতেন।তাদের মূল কাজের ক্ষেত্র ছিল মুক্তিযুদ্ধের ২ নাম্বার সেক্টর। এই সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ত্রিপুরা রাজ্যের স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে কথা বলে ৫০ হাজার রুপির ব্যবস্থা করেন এবং পরবর্তীতে সেই অর্থে স্থাপন করা হয় ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’। শুরুতে স্থানান্তর করা যায় এমন একটি ২৫ শয্যার সেই হাসপাতাল ছিল সেটি, যার সিট সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং একসময় এটি ৪৬০ শয্যার হাসপাতালে পরিণত হয়। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এক অনন্য নজির স্থাপন করার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখন যেন পচন ধরেছে। এই দেশের গরিব দুঃখী মানুষেরা বলেন হাসপাতালগুলোতে সেই আগের ডাক্তার নেই। সেই চিকিৎসাও নেই। এদিকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে গ্রামের বিত্তশালী মানুষটি পর্যন্ত এখন চিকিৎসার জন্য পাশের দেশ ভারত থেকে শুরু করে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এমনকি আমেরিকা, ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। সঠিক হিসেব নেই, তবে বিভিন্ন ধরনের হিসেব থেকে বলা হচ্ছে যে, বাংলাদেশীরা প্রতি বছর বিদেশে চিকিৎসা নিতে গিয়ে অন্ততপক্ষে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছেন যা বাংলাদেশের মোট বাজেটের ৮ ভাগের এক ভাগ। এমনটা হওয়ার কারণ কী? আর এই অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায়ই বা কী?
দুই.
চট্টগ্রামে বসবাসরত খুব নামকরা এক বাংলাদেশী নাগরিক একবার ফেসবুকে লিখলেন- ‘বুকে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম রবিবার বিকেলে। সিম্পটম দেখে ইসিজি করানো হলো। তারপর সোজা সিসিইউ। কি নাকি অবজার্ভেশন দরকার। আলহামদুলিল্লাহ ছাড়া পেলাম পরদিনই। এখন নাকি ইটিটি করতে হবে। সবাই বলছে ভালো ডাক্তার দেখাও, আবার কারো মত এখানে কিছুই নয়। বিদেশে চলে যাও।’
দেখা যাচ্ছে যে, তিনি বুকে ব্যথা হওয়ায় চট্টগ্রামের এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। ডাক্তার লক্ষণ দেখে ইসিজি করান। তারপর তাকে সিসিইউ-তে নিয়ে যান পর্যবেক্ষণের জন্য। একদিন পর্যবেক্ষণে রেখে পরদিন রিলিজ করেন। জানান যে, ইটিটি করতে হবে। এই পর্যায়ে পরিবার পরিজন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরই আস্থা রাখতে পারছেন না। বলছেন, বিদেশ চলে যাও। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থাহীনতা সার্বজনীন হয়ে উঠেছে। কেউ যদি জরিপ করেন দেখতে পাবেন যে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর আস্থাশীল নন। সন্দেহ আর অবিশ্বাস নিয়েই তারা চিকিৎসা করান। ভাবটা এমন যে, বিকল্প নেই। কি করব?
দেশের ডাক্তার ও হাসপাতালগুলোর উপর মানুষের আস্থাহীনতার বিষয়টি রাতারাতি ঘটেনি। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের ভুল চিকিৎসা কিংবা দীর্ঘ চিকিৎসায় সুস্থ না হওয়ার হাজার হাজার ঘটনা এবং একই রোগীর বিদেশে চিকিৎসা লাভ থেকে সুস্থ হওয়ার ঘটনা থেকে ধীরে ধীরে মানুষ দেশের ডাক্তার ও হাসপাতালগুলোর উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে। মানুষের আস্থাহীনতা সঙ্কটের পর্যায়ে পৌঁছে যায় যখন পত্র-পত্রিকায় ভুয়া ডাক্তারের খবর প্রকাশিত হয়। যখন জানা যায় যে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে ওয়ার্ড বয় অপারেশন করে। এই ধরনের সংবাদ পড়ে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। এরপর যখন মানুষ জানতে পারে সরকারি মন্ত্রী এমপিরা সামান্য হাঁচি কাঁশির চিকিৎসা নিতে বিদেশে যাচ্ছেন তখন তাদের মধ্যে অসহায়ত্ব চরম আকার ধারণ করে। তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ রাগ ক্ষোভে ভেতরে ভেতরে গজরাতে থাকে। এসব কিছুই সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যকে বিপর্যস্ত করে।
তিন.
রায়হান (ছদ্মনাম) সাহেবের কাহিনীটি বলি। সন্তান অসুস্থ হওয়ার খবর পেয়ে মিটিং বাদ দিয়ে তড়িঘড়ি করে একদিকে নিজে হাসপাতালে ছুটেছিলেন এবং অফিস ম্যানেজার রাজধানীর একটি বড় হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করেছিলেন। রায়হান সাহেব অফিসে ফেরার আগেই তার সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, তার সন্তান অবজারভেশনে আছে। শঙ্কামুক্ত। মনে হচ্ছে বড় কিছু হয়নি। তবে তিনি সন্তুষ্ট নন। কারণ ডাক্তাররা তার ছেলেকে রিলিজ না করে আরো দু’দিন অবজারভেশনে রাখতে চাচ্ছেন। কিন্তু ঠিক কেন সেটা ঠিক ঠাক বলছেন না। বরং সিটি স্ক্যানসহ এমনসব টেস্ট করাতে চাচ্ছেন যা প্রচন্ড পেটে ব্যথা রোগীর জন্য করার কথা নয় কিন্তু আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন তকমা লাগানো সেই হাসপাতালটি বলছে মেডিকেল প্রটোকলের অংশ হিসেবেই তাদেরকে টেস্টগুলো করতে হবে। নতুবা রোগীর দায়িত্ব তারা নেবে না। এরপর জানা গেল আসল কাহিনী! বিল হয়েছে ৩৫ হাজার ৩৬০ টাকা। অস্বাভাবিক বিল দেখে তিনি বিস্তারিত জানতে চান। তখন দেখা গেল রোগীকে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু থেকে শুরু করে হেন টেস্ট নেই যা করা হয়নি। রায়হান সাহেব তখন নিজের সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিলেন। কারণ তিনি বুঝতে পারলেন আরো দুইদিন হাসপাতালে রেখে আরো অন্তত ২ লাখ টাকার বিল তাকে ধরিয়ে দিত। তখন সেই টাকা দিয়েই তাকে এখন থেকে ছাড়া পেতে হতো। বিল পরিশোধ না করা পর্যন্ত লাশ না দেওয়ার শত শত কাহিনী তো প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর আছে।
চার.
১৯৯১ সালে দেশে গণতন্ত্র আসার পর মানুষ ভেবেছিল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও উন্নতি হবে। দৃশ্যত অনেক উন্নতি হয়েছে। গত ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অন্য অনেক সেক্টরের মতো স্বাস্থ্য খাতেও বড় বড় হাসপাতাল হয়েছে। ঢাকায় অন্তত এক ডজন হাসপাতাল হয়েছে যেগুলোর রিসিপশন ফাইভ স্টার হোটেলের লবির মতো। সেই সব হাসপাতালে রোগী নিয়ে বিদেশ যাত্রার সামর্থ্য নেই গ্রাম থেকে আসা এমন গরিব রোগীদের কম্বল পেঁচানো বালিশ নিয়ে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখা যায়। তারা জমি জমা বিক্রি করে বড় হাসপাতালে শেষ চিকিৎসা করাতে এসে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফেরেন। তারপর তাদের আরো গরিব হয়ে জীবন কাটাতে হয়। স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার দিন আর ফিরে আসে না। গত ২৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনামলে এদেশে কতো লক্ষ লক্ষ মানুষ চিকিৎসা করাতে গিয়ে ফতুর হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে সেটা দেখার কেউ নেই। এরা বেশিরভাগ সময় এটাকে ভাগ্যের পরিহাস কিংবা কপালের লিখন বলে চালিয়ে দেন।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় গত ২৫ বছরেও কেন মানুষের কণ্ঠ উচ্চকিত হতে পারেনি? তার বোধহয় বড় কারণ হলো বাংলাদেশে গণতন্ত্র মানে ৫ বছর অন্তর ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠানো। জনগণের ভোটে কখনো আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায়। এবং দায়িত্ব পাওয়ার পর তারা স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ পরিচালনা করে। তারা ধরেই নেয় যে, পাঁচ বছর তারা যা করবে সেটাই ঠিক। আর এসময়ে জনগণেরও তেমন কিছু বলার থাকে না।
এরকম একটি স্বার্থচালিত গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় কতো কম সময়ে নিজের বেশি লাভ ঘরে তোলা যায় সেই প্রবণতায় অন্যান্যদের সঙ্গে চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সেবা ব্যবস্থায় যুক্ত ব্যক্তিরাও আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। যার ফলে মানুষ কাঙ্ক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা যে সেবা সেটাই ভুলতে বসেছে। বাঙালি অতিথিপরায়ণ ও অন্যের দুঃখে কেঁদে উঠা জাতি। অথচ এই জাতি ক্রমশ বেনিয়ার জাতে পরিণত হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকে অদক্ষ ও অসৎ মানুষগুলোর কারণে।
যে চেতনাকে বুকে ধারণ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল গত ৪৫ বছর ধরে চেতনার লাশের উপর নিজেদের স্বার্থের সৌধ গড়ার জন্য সিন্ডিকেট তৈরি করে নিয়েছে একদল স্বার্থবাদী মানুষ। ইউনিয়ন থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিবারের সিন্ডিকেটে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সহাবস্থান লক্ষণীয়। তারা কখনো আপন ভাইবোন, চাচাতো মামাতো ফুফাতো ভাইবোন কিংবা জামাই শ্বশুর, বেয়াই বেয়াইন কিংবা মামা ভাগ্নে। দেশটাকে জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয়ভাবে পরিবার দ্বারা শাসন করার যে অতুলনীয় ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে সেটা করার জন্যই যেন দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছিল বলে অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। এরকম একটি শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ সংগঠনই উন্নত নীতি ও অনুসরণীয় আদর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হওয়ার কথা নয়। আর সেটা হচ্ছেও না। একটা ‘খাই খাই’ পরিস্থিতি সবত্র। স্বাভাবিক কারণেই দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাও এই রাহুমুক্ত হতে পারেনি।
ভালো চর্চা যেমন আরো ভালোকে উৎসাহিত করে ঠিক তেমনি খারাপ আরো খারাপকে জাগিয়ে তোলে। মানুষের মধ্যে ভালো ও খারাপ দু’টোই থাকে। পরিবার, সমাজ ও স্কুলের সুশিক্ষা মানুষের মধ্যেকার ভালোকে বিকশিত করে, অন্যদিকে কুশিক্ষা খারাপকে বিকশিত করে। আমরা যেন কুশিক্ষার মিছিলে শামিল হয়েছি। এর প্রভাব এতোটাই সর্বব্যাপী যে, এটা এখন যে কুশিক্ষা সেটাও আর সাধারণ চোখে বোঝা যাচ্ছে না। কতোখানি কুশিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত আমরা যে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধে পর্যন্ত ভেজাল দিচ্ছি। দালালের দৌরাত্ম্য হাসপাতালের করিডোরে ছড়িয়ে দিয়েছি। সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো বেসরকারি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে যেখানে সরকারি হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তাররা অফিসকালীন সময়ে গিয়ে উচ্চমূল্যে চিকিৎসা দেন। আর সরকারি হাসপাতালে আয়া বুয়া আর ওয়ার্ড বয়রা ডাক্তারের প্রক্সি দেন।
আমার এই লেখা থেকে এমনটা ধারণা করার দরকার নেই যে, দেশের সকল ডাক্তার খারাপ। আমাকে কেউ মেরে ফেলার হুমকি দিলেও আমি সেকথা বিশ্বাস করব না। কারণ আমি বহু বছর ধরে উপজেলা হাসপাতালগুলোতে দেখেছি কতোটা সীমিত যন্ত্রপাতি নিয়ে সেখানকার ডাক্তাররা মানুষের পাশে আপনজনের মতো সেবা দিচ্ছেন। আমি ঢাকা মেডিকেলে যাতায়াতের সুবাদে দেখেছি তরুণ ডাক্তাররা কিভাবে রোগীর জীবন বাঁচাতে সাধ্যের সবটুকু ঢেলে দিচ্ছেন। আমি আবার এও দেখেছি যে, কিভাবে হাসপাতালের ওষুধ বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কিংবা অতি মুনাফালোভী ওষুধ কোম্পানির ফ্রিজ গাড়ির বিনিময়ে ডাক্তার রোগীর প্রেসক্রিপশনে নির্দিষ্ট কোম্পানির ওষুধের নাম লিখছেন। এসবই হচ্ছে নষ্ট রাজনীতির ফসল। শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকার ফল।
পাঁচ.
এই অবস্থা উত্তরণের একটি উপায় হতে পারে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী পরিবারগুলোর উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়সহ যে যেখানে আছে সবসময়ই সরকারি হাসপাতাল ব্যবহার করা। তাহলে সেই হাসপাতালের চিকিৎসকদের পক্ষে দায়িত্ব পালন করার বিকল্প থাকে না। কিন্তু সেটা তারা করেন না বলেই ডাক্তাররাও সুযোগ নেন। আর এক্ষেত্রে হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ভূমিকা হয় লক্ষণীয়। সবমিলিয়ে একটি চক্র গড়ে উঠেছে দেশে যাকে অসাধু চক্র বলা যায়। সেই চক্র আরো উৎসাহিত হয় যখন দেশের রাষ্ট্রপতি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন সিঙ্গাপুরে। মন্ত্রীরা যান থাইল্যান্ডে। কিংবা আমেরিকায়। অর্থ ও বিত্তশালীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতাদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাত্রা যুক্তিসঙ্গত না করা পর্যন্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনার হাত থেকে সাধারণ মানুষের নিস্তার নেই। তাদের আস্থাও ফেরানো যাবে না।
ছয়.
ঢাকার বড় বড় হাসপাতালগুলোর কাণ্ড কারখানা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আরো কথা হবে। প্রশ্ন হলো এই ধরনের বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখভালের দায়িত্ব কার কিংবা কাদের? শোনা যায় বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলো একদিকে ডাক্তারদের উচ্চ বেতন দেন এবং অন্যদিকে তাদের উপর নির্দেশ থাকে রোগী পেলেই ল্যাবরেটরি টেস্ট ধরিয়ে দেয়ার। একটি হাসপাতালে একবার এক রোগীকে আড়াই দিনে ২৬ বার ডায়াবেটিকের ব্লাড সুগার টেস্ট করা হয়েছিল। অন্য এক হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গিয়ে ১৬ দিনে ৮ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করতে না পারায় লাশ নিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকতে হয়েছিল এক মৃত রোগীর আত্মীয়স্বজনদের। তারপর টাকা জোগাড় করে লাশ নিতে পেরেছিল। এর বিপরীতে হালুয়াঘাটে জয়রামকুড়া মিশন হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর রোগী তার সাধ্যমতো টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকার হিসেব নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। আর মাসে মাসে কিংবা তার সুবিধামতো সপ্তাহে সপ্তাহে এসে বাকি টাকা ফেরত দিয়ে যায়।
যারা বলেন দেশের সব কিছু খারাপ তাদেরকে বলব নিজের চারপাশে ভালো করে দেখুন। বেশিরভাগ মানুষই ভালো। খারাপের সংখ্যা আসলে কম। কিন্তু তারা ক্ষমতাশালী এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ করে। দেশে এখন রাজনীতিবিদ নেই। আমরা যাদেরকে রাজনীতিবিদ হিসেবে চিনি তারা মূলত রাজনীতিতে বিনিয়োগকারী। যাকে সোজা বাংলায় বলে ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক ব্যবসায়ী। আমরা যাদেরকে সেভাবে চিনি না তাদের মধ্যেই প্রকৃত রাজনীতিবিদরা লুকিয়ে আছেন। তাদেরকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। দেশ পরিচালনার ভার তাদের হাতে তুলে দিতে হবে। যারা দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন। আর তখনই হয়তো দেশের হাসপাতালগুলোর পচন ধরা বন্ধ হবে। দেশের সকল হাসপাতাল বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল ‘বাংলাদেশ হাসপাতাল’ এর মতো আর্তমানবতার সেবায় কাজ করে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি করতে সহায়তা করবে।
সবাই সুস্থ থাকুন। দেশকে ভালোবাসুন। দেশের মানুষকে ভালোবাসুন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)