গোটা দেশ যখন দু’জন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর আদালতের দেয়া দণ্ড ‘ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু কার্যকর’ দেখার অপেক্ষায় রয়েছে রয়েছে, তখন বিএনপি নামক দলটির মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ন্যায় বিচার পাননি বলে মন্তব্য করেছেন। শুধু তাই নয়, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের জন্য সাকা চৌধুরীর ‘কমিটমেন্ট’ ছিল বলে মন্তব্য করেছেন!
ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত, নাশকতা আর নানা গুজবে দেশে যখন একটা চরম থমথমে পরিস্থিতি, তখন একজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী এবং দণ্ডিত ব্যক্তি সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য অত্যন্ত হতাশাজনক। ক্ষুব্ধ হওয়ার মতও বটে। দেশটা যদি পাকিস্তান হতো তাহলে সাকার এই ‘কমিটমেন্ট’এর পক্ষে যে কেউই সায় দিতেন, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের পক্ষে সাকার কমিটমেন্ট? এর চেয়ে বড় প্রহসন আর কী হতে পারে? হায় বিএনপি, রাজাকারপ্রেমের দেউলিউয়াত্ব থেকে দলটির বুঝি মুক্তি নেই!
রিপন সাহেব কি তবে তারেক রহমান রচিত ‘নতুন স্বাধীনতার ইতিহাস’ থেকে উদ্ধৃতি দিলেন? এমন ডাহা মিথ্যাচার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হিটলারের বিশ্বস্ত সহচর ও তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসকেও যেন হার মানায়! বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলটির নেতাদের এ কোন অধঃপতন! এরপরও কি এই দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল বলে দাবি করবেন?
আসলে এটাই এই হল ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া’র দল, এই হল দলটির আসল রূপ। এরাই নাকি ক্ষমতায় গেলে রাজাকার ও একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার করবে !
বিএনপিকে আর কিভাবে প্রমাণ করতে হবে যে বর্তমান বিএনপি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে? বাংলাদেশের সামনে আসলেই ঘোর দুর্দিন অপেক্ষা করছে! জেনে এবং বুঝে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে যে দল এমন নির্জলা মিথ্যাচার করে, সেই দলের কাছ থেকে দেশবাসী আর কি আশা করতে পারে? দেশের স্বাধীনতার জন্য যদি সাকা’র ‘কমিটমেন্ট’ থেকে থাকে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা তো অপরাধী ছাড়া আর কিছু নয়! এই দলটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান দল! ভাবতেই লজ্জা লাগে!
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী নাকি এসব অপরাধ করেননি। তিনি সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। যদি তাই সত্য বলে মানি, তাহলে তো রিপন সাহেবের কথা আরও ডাহা মিথ্যা হিসেবেই প্রমাণিত হয়! উনি যদি দেশেই না থাকেন, তাহলে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বে সাকা চৌধুরীর ‘কমিটমেন্ট’ থাকে কীভাবে?
হায়রে বিএনপি, হায় বিএনপির দেউলিয়া রাজনীতি! একাত্তরের এই নরঘাতকের পক্ষে আদালতে নকল ও মিথ্যা কাগজপত্র দিয়ে চরম জোচ্চুরি করে তা ধরা পড়ার পরও যারা এই ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গায়, তাদের বিচার হবে কোন আদালতে?
বিএনপির উচিত ছিল সত্যকে মেনে নেয়া। মিথ্যাকে আকড়ে থাকার মধ্যে লজ্জা ছাড়া আর কিছু নাই। অথচ দলটির মুখপাত্র সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত একজন দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে ‘ দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের জন্য সাকা চৌধুরীর কমিটমেন্ট ছিল’ বলেন তখন বলতে ইচ্ছে করে, ধরণী দ্বিধা হও, বিএনপির লজ্জা তো ঢাকবার নয়, আমরাই না হয় নিজেদের লুকাই!
বিএনপিতে কী তবে ‘সাকা-ডাইজেসনের’ মাধ্যমে নতুন নতুন রাজাকারের আবির্ভাব ঘটছে? কোন নব্যরাজাকার ছাড়া স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের সাথে সাকার ‘কমিটমেন্ট’-এর গন্ধ খুঁজে বেড়াবে কে?দেশ ও জাতির সাথে তারা এমন ঠাট্টা বিদ্রূপ করার দুঃসাহস যারা দেখাচ্ছেন, এই নবাবির্ভূত রাজাকারদের হাত থেকে দেশকে রক্ষার শপথ কী আমরা নেব না?
মনে রাখতে হবে, যুদ্ধাপরাধের বিচার আমাদের মানবিক দায়বদ্ধতার বিষয়। এটা কোনো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য নয়– বরং ৩০ লাখ শহীদের রক্তের ঋণ শোধ, তাদের পরিবারবর্গের দুঃসহ যাতনা লাঘব, সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি যুদ্ধ নামক অভিশাপ থেকে মানবজাতিকে মুক্ত করার জন্য। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের রায় কার্যকর করা জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ক্ষুদ্র একটি অংশ ছাড়া সবাই চায় এ বিচার হোক ও রায় কার্যকর হোক।
কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে যখন থেকে এই বিচার ও রায় বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাস্তব রূপ পেতে শুরু করে, তখন থেকে তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের নানামুখী কুটচালের শিকার হচ্ছে। আমরা দেখেছি, জামায়াতি টাকার কাছে (তাদের নিযুক্ত লবিস্টদের কাছে) পশ্চিমা মিডিয়া, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন কীভাবে বিক্রি হয়ে গেছে। জামায়াতি টাকা দীর্ঘদিন ধরেই পশ্চিমাদের মুখে কথা বলছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জামায়াতের সঙ্গী হয়েছে বিএনপি। জামায়াত-বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা বিদেশে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে। তারা বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন ভাড়া করেছে এই বিচার বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তারা পরাস্ত হয়েছে। শুভশক্তির জয় হয়েছে এবং হচ্ছে।
কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার জাতিকে দায়মুক্ত করেছে। এজন্য সরকারের জন্য কোন প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো, যারা অতীতে এই গণদুষমনদের গাড়িতে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তমাখা পতাকা উড়িয়ে ঘুড়ে বেড়ানোর সুযোগ দিয়েছে, দলের নেতা বানিয়েছেন, শেষ দিন পর্যন্ত তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে এবং গাচ্ছে, তাদের কি আমরা ক্ষমা করে দেব? তাদের ব্যাপারে কী আমরা কোন সিদ্ধান্তই নেব না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)