সরকারের দুই বছর পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে দূরের সীমানাতেই তার চোখ রাখলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বেতার এবং টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীর ৩০ মিনিটের ভাষণে স্বভাবতঃই দুই বছর আগের নির্বাচন প্রসঙ্গ এসেছে একাধিকবার। বিএনপির ‘ভরাডুবি’ হওয়া পৌর নির্বাচন প্রসঙ্গও এসেছে। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ‘আনুষ্ঠানিকতার’ নির্বাচনের আগে কম সময়ের মধ্যে আরেকটি নির্বাচনের যে আশ্বাস ছিলো সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কিছুই বলেননি।
এমনকি তার সরকারের মন্ত্রী এবং দলের নেতারা ২০১৮’র শেষদিকে কিংবা ২০১৯ সালের শুরুর দিকে পরবর্তী নির্বাচনের যে কথা বলেন সেরকমও কিছু বলেননি প্রধানমন্ত্রী। তবে ভাষণের সময় তার পাশে ছিলো দলীয় প্রতীক নৌকা।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে দীর্ঘদিন পর কোনো জনসভায় বক্তৃতা করে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ‘গ্রহণযোগ্য’ একটি নির্বাচনের জন্য ‘সংলাপ’ বা আলোচনার যে প্রস্তাব দিয়েছেন সে বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীরব থেকেছেন।
এর আগে খালেদা জিয়ার জনসভার ছয়দিনের মাথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং সরকারের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আওয়ামী লীগের জনসভাতেও এ প্রসঙ্গে নীরব থেকেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার প্রস্তাব সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর নীরব থাকার মানে হতে পারে দুইরকম:
১. নির্বাচন বিষয়টি এ মুহূর্তে তার কোনো ধরনের বিবেচনার মধ্যেই নেই। প্রধানমন্ত্রীর দূরতম কোনো চিন্তাতে মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রসঙ্গ থাকলেও প্রধানমন্ত্রী এখনই কোনো মন্তব্য করে জাতীয় নির্বাচনের কোনো আগাম আলোচনা শুরু করতে চান না।
২. অন্যদের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মনে করেন সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হলেই কেবল দেশে আরেকটি নির্বাচন হবে। তাই এ মুহূর্তে এ নিয়ে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আগাম কোনো প্রতিক্রিয়া জানানোর চেয়ে নীরবতাই বেশি প্রজ্ঞার পরিচায়ক।
তারা বলেছেন, এ কারণেই প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক কোনো নতুন দিকনির্দেশনার চেয়ে সরকারের বর্ষপূর্তিতে জাতির উদ্দেশে ভাষণে সরকারের কার্যক্রম, সরকার পরিচালনায় কিছু নীতি-নির্ধারণী অবস্থান এবং তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সেখানে মূলতঃ সাতটি বিষয় উঠে এসেছে:
১. জাতির জনক, জাতীয় চারনেতা এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য শ্রদ্ধা। একুশে আগস্টে নিহতরা সহ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তখন এবং একবছর পর যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।
২. দুই বছর আগের নির্বাচন এবং গত বছর নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে খালেদা জিয়ার ৯২ দিনের ‘অস্বাভাবিক এবং প্রত্যাখ্যাত’ অবরোধকে কেন্দ্র করে ‘অগ্নি-সন্ত্রাসে’ ২৩১ জনের মৃত্যু, এক হাজার ১৮০ জনের আহত হওয়া, দুই হাজার ৯০৩টি গাড়িতে আগুন এবং ৭০ সরকারি অফিস ও স্থাপনা ভাংচুরের পর ‘৬৮ জনকে সঙ্গে নিয়ে রাজনৈতিক কার্যালয়ে আরাম-আয়েশ’ শেষে আদালতে হাজিরা এবং ‘নাকে খত’ দিয়ে খালেদা জিয়ার গৃহে প্রত্যাবর্তন।
৩. গত দুই বছরসহ গত সাক বছরে সরকারের সাফল্য।
৪. সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গি শক্তির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি।
৫. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার।
৬. খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ না করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষকারীদের কড়া সমালোচনা।
৭. দুই হাজার ২১ সাল নাগাদ মধ্য আয়ের এবং ২০৪১ সাল নাগাদ সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত বছর এরকম সময়ে এক অস্থির সময়ের বিপরীতে এবার শান্তিপূর্ণ এক অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে থাকার কারণেই দূরের দিকে তার চোখ রাখতে পেরেছেন।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কোনো প্রস্তাবে তাই ন্যূনতম প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রয়োজনও অনুভব করছেন না প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে, জাতীয় পার্টিকে বিরোধীদল বানিয়ে সংসদে তাদের ভূমিকার প্রশংসা করে জাতীয় সংসদকেই সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু করা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন তার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক।