চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

দুর্দান্ত বাংলাদেশের সিরিজ জয়ের উৎসব

সিরিজ জিততে গড়তে হতো রেকর্ড। সেন্ট কিটসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রথম দল হিসেবে তিনশ রানের লক্ষ্য টপকাতে হতো। স্বাগতিকদের সেই রেকর্ডটা করতে দেয়নি বাংলাদেশ। শুরুতে ম্যাচসেরা ও সিরিজসেরা তামিমের সেঞ্চুরি আর মাহমুদউল্লাহর অপরাজিত ফিফটিতে বড় সংগ্রহ গড়ার পর দুর্দান্ত বোলিংয়ে ১৮ রানে ম্যাচ জিতে নিয়েছে লাল-সবুজরাই। সঙ্গে ২-১ ব্যবধানে তিন ওয়ানডের সিরিজও। প্রথম ম্যাচে ৪৮ রানে জিতেছিল মাশরাফীর দল।

টেস্ট সিরিজে অসহায় আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশের এই ঘুরে দাঁড়ানো নয় বছর পর একটি ভুলতে বসা স্বাদের উপহার দিয়েছে। বিদেশের মাটিতে যে ৯ বছর পর সিরিজ জিতল বাংলাদেশ। ২০০৯ সালের আগস্টে জিম্বাবুয়ে সফরে ৪-১এ জেতা সিরিজের পর এটিই প্রথম। আর দেশ-বিদেশ মিলিয়ে দুই বছর পর সিরিজ জয়।

সেন্ট কিটসে আগে ব্যাট করে সিরিজের শেষ ম্যাচে নির্ধারিত ওভারে ৬ উইকেটে ৩০১ রান তোলে বাংলাদেশ। যাতে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে প্রথমবার তিনশ ছুঁয়েছে টাইগাররা। উইন্ডিজের বিপক্ষে আগের সর্বোচ্চটি ছিল ২৯২ রান, ২০১২ সালে খুলনায়। আর স্বাগতিকদের মাটিতে আগের সর্বোচ্চ ছিল এই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে করা ২৭৯ রান।

জবাব দিতে নেমে ৫০ ওভারে ৬ উইকেটে ২৮৩ রানের বেশি এগোতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই মাঠে আগে ৭বার হয়েছে তিনশ বা তারচেয়ে বেশি রান। কোনো দলই তিনশ তাড়া করে জিততে পারেনি। এখানে রান তাড়ার রেকর্ডটা অবশ্য স্বাগতিকদের অধিকারেই। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২৬৬ রান তাড়া করে ৪ উইকেটে জিতেছিল উইন্ডিজ।

শনিবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই যেন পণ করে নেমেছিলেন হারার আগে হারবেন না! একই মন্ত্র নিজেদের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন বাংলাদেশের বোলাররাও। উইকেট আনার শুরুটা করেন আগের দুই ম্যাচেও ব্রেক থ্রু এনে দেয়া মাশরাফী।

প্রথম দুম্যাচে যেখানে তিরিশের কোটাই পেরোয়নি উইন্ডিজের উদ্বোধনী জুটি, সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে সেখানে পেরিয়ে গেল ফিফটি। সেখানেই ত্রাতা টাইগার অধিনায়ক। সিরিজে তৃতীয়বারের মতো আউট করেছেন লুইসকে।

তখন ক্রমেই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার হুঙ্কার ছুড়ছিলেন ক্রিস গেইল, সঙ্গী লুইস থাকেন মন্থর। তারপরও ১০.১ ওভারে ৫৩ রান তুলে ফেলে স্বাগতিকরা। মাশরাফীর অফস্টাম্পের বাইরে করা অফ-কাটারটি লাফিয়ে ওঠে হঠাতই, লুইসের ব্যাট ছুঁয়ে জমা পড়ে মুশফিকের গ্লাভসে। ৫৩ রানের জুটি ভাঙে। বাঁহাতি ওপেনার ৩৩ বলে করে যান ১৩ রান।

গেইল পরেও চালিয়ে যান। ফিফটি তুলে নেয়ার পথে হোপকে নিয়ে ৫২ রানের আরেকটি জুটি গড়েন। বিপজ্জনক হয়ে ওঠা এই বাঁহাতি লংঅন দিয়ে রুবেলকে উড়িয়ে মারতে যেয়ে মিরাজের হাতে ধরা পড়েছেন। থামে ছয় চার পাঁচ ছক্কায় ৬৬ বলে ৭৩ রানের ইনিংস। পঞ্চম ছক্কাটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গেইলের ৪৭৬তম। তাতে স্পর্শ করেছেন পাকিস্তানের শহিদ আফ্রিদির সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ড।

আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান শিমরন হেটমায়ারকে নিয়ে পরে লড়াইয়ে এগিয়ে যান শাই হোপ। তাদের ৬৭ রানের জুটি ভেঙে হেটমায়ারকে(৩০) বোল্ড করে মিরাজ বাংলাদেশকে ম্যাচে ফেরান। স্টাম্পের বল লেগে সজোরে হাঁকাতে যেয়ে বোল্ড হেটমায়ার।

মিরাজের বলে কাইরন পাওয়েলকে জীবন দিয়েছিলেন সাব্বির। টাইগার অফস্পিনারকে লংঅন দিয়ে উড়িয়ে মারতে যেয়ে ২ রানে থাকা পাওয়েল বেঁচে যান। সেটি কাজে লাগাতে পারেননি। ৩৮তম ওভারে একটি বল কাভারে ঠেলে দৌড় দিয়ে অন্যপ্রান্তের ব্যাটসম্যান হোপের সাড়া পাননি। মাশরাফী থ্রো ধরে স্টাম্প এলোমেলো করে দেন মিরাজ। বাঁহাতি পাওয়েল তখন ৪ রানে।

মিরাজের বলেই রুবেলের হাতে ৩৬ রানে জীবন পাওয়া হোপ থেমেছেন ৬৪ রানে। ৯৪ বলের ইনিংসটি থামাতে এগিয়ে আসতে হয় মাশরাফীকে। আবার অফকাটারে সাফল্য। ডিপ মিডউইকেট দিয়ে টাইগার অধিনায়ককে বাউন্ডারি ছাড়া করতে যেয়ে সাকিবের তালুবন্দী হোপ।

হোপ ফিরলেও ত্রাস হয়ে দেখা দিয়েছিলেন রোভম্যান পাওয়েল। ঝড়ো ফিফটি তুলে চোখ রাঙাচ্ছিলেন। ২৭ বলে পঞ্চাশ তুলে নেন। বাংলাদেশের বিপক্ষে উইন্ডিজের কোনো ব্যাটসম্যানের যেটি দ্বিতীয় দ্রুততম ফিফটি। প্রথমটি ব্রায়ান লারার, ২৬ বলে। পাওয়েল শেষপর্যন্ত ম্যাচটা ছিনিয়ে নিতে পারেননি। ৫ চার ও ৪ ছক্কায় ৪১ বলে ৭৪ রানের অপরাজিত ইনিংসটি তাই পরাজিতের খাতায়।

এদিন ২ উইকেট নিয়ে মাশরাফীই সেরা। যদিও ১০ ওভারে ৬৩ রান খরচ হয়েছে তার। মিরাজ ১০ ওভারে ৪৫ রানে ও মোস্তাফিজ সমান ওভারে ৬৩ রানে একটি করে উইকেট নিয়েছেন। সাকিব ১০ ওভারে ৪৫ দিলেও উইকেটশূন্য। বাকি উইকেটটি রুবেলের।

এর আগে ব্যাটিংয়ে দারুণ শুরু করে বাংলাদেশ। যদিও সমালোচনার মুখে একাদশে টিকে যাওয়া এনামুল হক বিজয় বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। এই ডানহাতি হোল্ডারের অফস্টাম্পের একটু বাইরে করা লাফিয়ে ওঠা বল পুল করতে গিয়ে ক্যাচ দেন মিডঅনে। ৩১ বলে মাত্র ১০ রানের অবদান তার।

সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ান তামিম ও সাকিব। দ্বিতীয় উইকেটে ৮১ রান যোগ করেন ৯৬ বলে। সিরিজে আগের দুই ম্যাচে এই দুজনের জুটিতে এসেছিল ২০৭ ও ৯১ রান। গত ১০ ইনিংসে দুজনে তিনবার সেঞ্চুরি জুটি আর পাঁচবার ফিফটির জুটি গড়লেন।

আগের দুই ম্যাচের মতো এদিন অবশ্য ফিফটি পাননি সাকিব। ৩ চারে ৪৪ বলে ৩৭ রানে ফিরেছেন নার্সকে স্লগসুইপ খেলতে যেয়ে পলের ক্যাচ হয়ে। নার্সের বলেই বাজে শটে বোল্ড হয়েছেন গত ম্যাচে নায়ক হতে হতে সুযোগ হাতছাড়া করা মুশফিক (১২)।

তবে একপ্রান্তে তামিম আগলে ছিলেন এদিনও। মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে ৪৬ বলে ৪৮ রানের জুটি গড়ার পথে সেঞ্চুরি তুলেছেন। ফিরেছেন ১২৪ বলে ১০৩ রানে। ৭ চার ও ২ ছয়ের ইনিংসটি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১১তম শতক।

গায়নায় সিরিজের প্রথম ম্যাচে ১৩০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন তামিম। পরের ম্যাচে ৫৪। সিরিজে সবমিলিয়ে ২৮৭ রান। এক সিরিজে দুটি সেঞ্চুরি করলেন দ্বিতীয়বার। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে দুটি সেঞ্চুরি ও একটি ফিফটি করেন এ বাঁহাতি। সেবার তিন ম্যাচে করেছিলেন ৩১২ রান। সফরকারী দলের পক্ষে উইন্ডিজে তিন ম্যাচের সিরিজে সর্বোচ্চ রানও এখন তামিমের। আগের রেকর্ডটি ছিল ড্যারেন লেহম্যানের (২০৫)।

তামিম ফেরার পর চমক হয়ে আসেন ছয় নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামা মাশরাফী। মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে ৫৩ রানের জুটি গড়েন ৭ ওভারে। ৪ চার ও এক ছক্কায় ২৪ বলে ৩৬ করে কাজের কাজটা সেরে যান অধিনায়ক।

তিনশর পথে বাকি কাজটুকু এগিয়ে নেন ৪৯ বলে ৬৭ রানে অপরাজিত থাকা মাহমুদউল্লাহ। শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশ যে ৯৬ রান তুলল, তাতে রিয়াদেরই অবদান বেশি। ৫ চারের সঙ্গে ৩ ছক্কার ইনিংস তার। শেষদিকে সাব্বির ৯ বলে ১২, মোসাদ্দেক ৫ বলে অপরাজিত ১১ রানের অবদান রাখলে তিনশ ছোঁয় বাংলাদেশ। যে সংগ্রহটি শেষপর্যন্ত এনে দিল সিরিজ জয়ই।