প্রাচ্যের বাঙালি পুরাণের সাথে তুলনা করলে বাঙালির গর্ব শেখ হাসিনা সার্থক অরুন্ধতী। আর পাশ্চাত্যের পুরাণে শেখ হাসিনা সেই আগুন পাখি ফিনিক্স। পবিত্র শক্তি অরুন্ধতী। কাল রুদ্রের অভিশাপ থেকে রাণী অরুন্ধতী তার রাজ্যকে বাঁচাতে নিজের ইচ্ছায় আগুনে পুড়ে মৃত্যু বরণ করে। আর তার আগুনে পোড়া ভষ্ম দিয়ে তৈরী হয় কাল রুদ্রকে বধ করার মৃত্যুবাণ যার নাম অরুন্ধতী।
অন্যদিকে প্রাচীন গ্রিক পুরাণে ফিনিক্স এক পবিত্র আগুন পাখি। বিপদে পাখিটি এক সময়ে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ওই পাখির ছাই ভস্ম থেকেই জন্ম নেয় আবার পাখি। অরুন্ধতী পুনর্জন্ম নিয়ে বধ করে অশুভ শক্তিতে তেমনি আগুন পাখি অপবিত্রতা ধ্বংস করতে ছাই ভষ্ম থেকে আবার জন্ম নেয়।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ হাসিনাকে নিয়ে ‘হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল’ ঠিক যেনো অরুন্ধতী আর আগুন পাখিরই জেরক্স কপি। জীবন স্বপ্ন আর রূপকথার মত। কখনো সখনো জীবন যেনো রূপকথা ও কল্পনাকেও হার মানায়।
‘হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল’ এর শুরুতে আটপৌরে শেখ হাসিনার সাদামাটা ঘরকন্নার জীবন। এখানে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন তাঁর মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের। মায়ের ডাক নাম রেণু। সেখানে আছে বঙ্গবন্ধু তাকে গভীর ভালবাসার চিঠিতে প্রাণের রেণু বলে তার মাকে ডেকেছেন।
তার মা সবসময় বাবা বঙ্গবন্ধুর জীবনে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। এমনকি মৃত্যুও তাদের দুজনকে এক সাথে বেঁধে দেয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা’তেও আছে গ্রামের সহজ সরল এক নারী অপার মমতা, সহ্য আর অগ্নি পরীক্ষা দিয়ে দৃঢ় হাতে সংসার আগলে রেখেছেন।
টুঙ্গিপাড়া সবুজ শ্যামল গ্রামে বেড়ে ওঠেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। প্রেরণার উৎস হয়ে সবসময় বাঙালিদের মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সঙ্গী হয়ে তাকে শক্তি আর সাহস দিয়ে ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছেন।
আধুনিক রমণীর প্রতীক তিনি কিন্তু উচ্চ শিক্ষিত বলতে যা বোঝায় সেই শিক্ষা তার ছিল না। শেখ কামাল এবং সুলতানা খুকির সম্পর্ক মেনে নেওয়ার মাধ্যমে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এর আধুনিক মন মানসিকতার প্রমাণ পাওয়া যায়। সুলতানা খুকির ক্রীড়া দক্ষতার সুখ্যাতি ছিল দেশজোড়া। শেখ কামাল পছন্দ করতো তাকে। খেলাধূলার পাশাপাশি খুকি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্রী। কিন্তু সেই সময় একটি মেয়ে খেলাধূলা করে সেটা সহজভাবে নেয়ার মত রক্ষণশীল মধ্যবিত্ত সমাজ তখনো তৈরি হয়নি। সম্বন্ধ পাকাপাকি হলে শেখ হাসিনা তখন ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে বলছেন, মা, মেয়েটিকে কিন্তু বিয়ের পরও খেলতে দিতে হবে। তাতে তিনি আপত্তি করেননি। বাংলাদেশের কোন রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে এই রকমের কোন ফিল্ম তৈরি করার সাহস কেউ করেনি। তাই তৈরি হয়নি এবং এই রকমের সুযোগও আসেনি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরিবারে এমন আধুনিক মানুষ আছেন বিশেষ করে সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম একজন প্রণেতা বাংলাদেশের।
এছাড়া রাদওয়ান মুজিব এবং নসরুল হামিদ বিপু এই ডকু ফিল্মটি প্রযোজনা করেছেন সিআরআই এর মাধ্যমে যা সত্যিকারভাবে একটি বিষ্ময়কর ঘটনা। আমরা যারা মিডিয়াকর্মী কবিতা লিখি সাংষ্কৃতিককর্মী প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংষ্কৃতির সাথে জড়িত আমরা এতোদিন ধরে যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার হত্যাকান্ড ৭ মার্চের ভাষণ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সম্পর্ক নিয়ে অনেকটাই আমরা জানতাম কিন্তু এতোটা গভীরভাবে জানতাম না যদি এ ডটার’স টেল না দেখতাম।
ইন্দিরা গান্ধী আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আদর করছেন, তাকে খাইয়ে দিচ্ছেন। যে যে দলের রাজনীতি করুক না কেন, বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের সাথে যে অমানবিকতা আচরণ করা হয়েছে তা এই সেলুলয়েডের ফিতায় না এলে এতো সুচারুভাবে আমরা অনুধাবণ করতে পারতাম না। এই সিনেমাটি পারিবারিকভাবে আমার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও বন্ধু বান্ধবদের সাথে ষ্টার সিনেপ্লেক্স এ উপভোগ করেছি।
এটি দেখার জন্যে ষ্টার সিনেপ্লেক্সের মালিক মাহবুবুর রহমান আমাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছেন। টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই আমি তার কাছে ঋণী। ছবিটা দেখার পরে আমার ছোট বাচ্চা খুব কাঁদছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে তারা দুই বোন যে কতো অসহায় ছিলেন কষ্টে ছিলেন! তা আমি আমার নিজের মধ্যে অনুভব করেছি একজন পিতা হিসেবে যে, আমি মারা গেলে আমার সন্তানরা কি করবে? এইভাবে নৃশংস হত্যাকান্ড!
খুনি মোশতাকের যে চেহারা তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে তা যথার্থ। তাজউদ্দিন আহমেদ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ার পরে শেখ হাসিনা বলেন- মোশতাক কাকা তো আছেন? তখন বঙ্গবন্ধু বলেন- তুমি বুঝবা না।
মোশতাক কি জিনিস। ও আমার বুকে ছুরি মারার জন্যে তৈরী হয়ে আছে। এইভাবে গল্প বলার মাধ্যমে সব ঘটনা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয়েছে তা বিষ্ময়ের। এই গল্প বলে বলে ইতিহাস জানানো এটি ভাল ধারণা। এর পেছনে পরিচালক পিপলু খান আর গাউছুল আলম শাওন জাতীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত ষ্ক্রিপ্ট রাইটার বিশেষ করে আয়নাবাজির জন্যে এদের ভুমিকা অনন্য।
ফিল্মটি দেখার পরে কয়েকটি কথা কানে বাজে এখনো তা শেখ রেহানা বলেছেন- এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। তার দুই সন্তান পুতুল ও জয়কে মানুষ করতে তার সংগ্রাম এবং তাদেরকে নৈনিতালে নিয়ে যাওয়া। শেখ রেহানা বলেছেন- সৎ বোনের চেয়েও খারাপ আচরণ করেছি আমি এই ছেলে মেয়েদের মানুষ করার জন্যে। এক রকম জোর করে কেড়ে নিয়ে গেছি যাতে করে ওদের পড়াশোনা হয়।
তবে আজকে সজিব ওয়াজেদ জয় আর সায়মা ওয়াজেদ পুতুল যে সারাবিশ্বে পরিচিত তা শেখ রেহানার জন্যে হয়েছে। এটি এক কন্যার কাহিনী না, দুই কন্যার কাহিনী সারা বাংলাদেশের কাহিনী মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আর বঙ্গবন্ধুর কাহিনী। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে প্রগতিশীল সব মানুষের কাহিনী এই ডটার’স টেল। কে কোন দল করলো, কে কাকে ভোট দিলো সবার উর্দ্ধে এই কাহিনী। জাতীর পিতাকে হত্যা নৃশংসভাবে এই ফিল্মে দেখানো হয়নি। বাচ্চাদের কথা ভেবে নৃশংসতাকে এড়িয়ে যাওয়া এটিও পরিচালকের সুবিবেচনার পরিচয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে সংগ্রাম, তিনি যে কতো কষ্ট করে এইখানে এসেছেন, এখানেও বিভেদ ছিল। আওয়ামী লীগের সব বিভেদ পার করে শেখ হাসিনা যে আসতে পেরেছেন এই পর্যায়ে তা সত্যিই বিষ্ময়ের।
আমরা এখন যে বলছি উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ। তিনি তা কেন করতে পেরেছেন? কারন তার মধ্যে দুঃসাহস ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা যে আবার নেতৃত্ব দেবেন তা কি ভেবেছিল খুনিরা? খুনি মোশতাক বাহিনী যে উদ্দেশ্যে জাতির পিতার পরিবারকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল তাদের সেই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। ছবিতে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হয়েছে তা দেখানো হয়নি। আইনি প্রক্রিয়ায় যে বিচার হয়েছে তা ছবিতে থাকা দরকার ছিল। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের যে বিচার হয়েছে বা এখনো চলছে বিচার এই দিকও থাকা উচিত ছিল।
তবে পারিবারিক যে দৃশ্যগুলো যেমন, প্রধানমন্ত্রীর রান্না করা এবং তার নাতনীকে কোলে নিয়ে কথা বলছিলেন। এই সব কারণে মমতাময়ী মা বলা হয় শেখ হাসিনাকে।
টুঙ্গীপাড়ার দৃশ্যায়নে ক্যামেরায় কাজ অসাধারণ হয়েছে অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী ব্যাডমিন্টন খেলছেন তা মোবাইলে তালা ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। এক জায়গায় প্রধানমন্ত্রী বলেন- টুঙ্গিপাড়ার মত সুন্দর জায়গা পৃথিবীর কোথাও নেই। সেই জায়গা থেকে উঠে আসা শেখ মুজিব জাতির জনক হয়েছেন এবং তার কন্যা এখন বাংলাদেশের নেতৃত্বে আছেন। সামনে নির্বাচন, কে হারে কে জেতে তার ঠিক নেই।
কিন্তু অবশ্যই চাই- জাতীর জনকের কন্যা আবারো জয়ী হোন। আর এই ডকুফিল্ম দেখানো নির্বাচনের আগে তা ঠিক না, বলছে বিএনপি। এই কথা বলা তাদের উচিৎ না। কারণ ফিল্মটি বানানো হয়েছে একজনের জীবনী নিয়ে। যা খুব সুনির্মিত। এ ডটার’স টেল থেকে জানা যায়, তারা ১৯৫২ সালে প্রথম ঢাকায় আসেন। টুঙ্গিপাড়া থেকে তিন খোলের নৌকায় নদীপথে আসতে তাদের ৪ দিনের মত সময় লেগেছিল। পাকাপাকিভাবে তারা ঢাকায় আসেন ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি হলে কিভাবে মাত্র তিন দিনের নোটিশে তাদের বাড়ি ছেড়ে পথে বসতে হয়- এই হৃদয় ছোয়া গল্পে দর্শকের চোখ ভিজে ওঠে।
বঙ্গবন্ধু মুজিব স্বপ্নের স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ শান্তি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে জেলে হাঁপিয়ে উঠেছিলে। আর নিজের মানুষের হাতে নিজ বাড়িতে জাতীর জনককে নিমর্মভাবে স্বপরিবারে হত্যা কেউ ভাবতে পারেনি। কাছের আর দেশের মানুষকে তিনি নিজের জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসতেন আর অন্ধের মত বিশ্বাস করতেন। আর তাদের হাতের জাতীর পিতার পরিবারকে জীবন দিতে হলো। এ ছিল আমাদের চিন্তারও বাইরে- বলেন শেখ রেহানা।
সৌভাগ্যবান বলে সেই কালো রাতে শুধুমাত্র তারা দুইজন বেঁচে যান। কারন তখন তারা ছিলেন ইউরোপের বেলজিয়ামে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার কর্মসূত্রে দু’বোন তখন ছিলেন তার কাছে। সেদিনের ভোরটা ছিল দুঃস্বপ্নের মত। ওই দিন সকালে হঠাৎ টেলিফোনের রিং বাজার শব্দটাও বড় কর্কশ লেগেছিল শেখ হাসিনার কাছে।
টেলিফোনের ওই ভৌতিক সুর আজো যেনো তাড়া করে ফেরে প্রধানমন্ত্রীকে। ওই দিন থেকে দুই বোনের জীবনে নেমে আসে নরকের অন্ধকার। তারা মুখোমুখি হন নতুন বাস্তবতা। তার আগের রাতে সেই দেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল্লাহ তাদেরকে ক্যান্ডেল নাইট ডিনার করিয়েছেন তার পরের দিন বেলজিয়ামে নিযুক্ত সেই রাষ্ট্রদূতই বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে সাথে সাথে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন। গাড়িটি নষ্টের অজুহাতে তাদেরকে গন্তব্যে পৌঁছেও দেননি। নতুন বাস্তবতায় দুই বোন দিশেহারা হয়ে পদে পদে এই রকম সুবিধাবাদী আমলাদের চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হন।
কিন্তু অন্যদিকে ওই দেশের সীমান্তের ওপারে আবার এক হৃদয়বান আমলার সহানুভূতিও তারা পান। মহানুভব সেই মানুষটি সিলেটের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। তিনি আর তার স্ত্রী দুজনে মিলে ওই অমানিশার অন্ধকারে সেদিন চরম উদার মানসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই তখন।
সারাদিন এক বোন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেন। অনেকে ওই কঠিন সময়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেও সাবেক যুগোস্লাভিয়ার অবিসংবাদিত নেতা মার্শাল টিটো তাদের পাশে ছিলেন ছায়ার মত। আর ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাত বাড়িয়ে দেওয়া। অসহায় দুই বোনের কাছে ছিল পরম দিশা। ভারতে আশ্রয় পেলেও সেখানে দুই কামড়ার ছোট্ট রুমে শুরু হয় তাদের বন্দি জীবন। নিজেদের পরিচয়ে তারা চলতে পারতেন না। নাম বদলে ছদ্মনামে তার এক রকমে পালিয়ে থাকতেন।
‘হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল’ এ রেহানা বলছেন, মিস তালুকদার আর মিসেস তালুকদার ছদ্মনামের আড়ালে নিজেদের নামটি পর্যন্ত বদলে ফেলতে হয়েছে। আরেকদিনের কথা তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে। একদিন দুইবোন আজমির শরীফে যান নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে। কিন্তু অবাক করে দিয়ে মাজারের খাদেম ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু যে মাজার শরীফ গিয়েছিলেন তা তাদের দেখান। তাদের মাজারে যাওয়ার ওই দিন ১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল ছিল একই তারিখ। কি অবাক কান্ড! কাকতালীয় ব্যাপার। দেশে ফিরে শেখ হাসিনা এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে গেছেন দল ও মানুষের কাছে। নোয়াখালীর বন্যাদুর্গত চরক্লার্কে গেলে পরে এক নারী বুকে টেনে একটা ডাব খেতে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার বাবাও আমাদের জন্য জীবনভর করেছেন তুমিও করছো মা।
তোমাকে আমরা ভুলব না। এই স্বীকৃতিকেই জীবনের প্রাপ্তি বলে জেনেছেন। তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে বাদ পড়েনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজপথে শহীদ নূর হোসেনের কথাও। ১০ নভেম্বর, ১৯৮৭ সালের গণবিক্ষোভের দিন কাছে ডেকে বলেছিলেন, তুমি শার্ট পরো। তোমাকে তো বাঁচতে দেবে না। নূর হোসেন বলেছিল, আপা একটু দোয়া করে দেন। গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়ে দেব। সেই নূর হোসেনের লাশও দেখেছেন একটু পর।
সবুজ গ্রাম টুঙ্গিপাড়ার খালে-বিলে হিজল গাছে গজানো অসংখ্য শেকড় ধরে জলে ঝাপাঝাপির স্মৃতি আমাদের হাওর এলাকার খালপাড় ভরতি হিজল করচের কথাই মনে করিয়ে দেয়। টুঙ্গিপাড়ার আলসেখানার সেই মেয়েটি কীভাবে এক পৃথিবী শোক কাটিয়ে, আলোর পথে নিয়ে আসলেন- এ ডটারস টেল এ যেন সে কথাগুলোই বারবার মনে করিয়ে দেয়।
এভাবেই একজন প্রত্যয়দীপ্ত সংগ্রামী সাহসী নারীর জীবন রাষ্ট্রের সমান হয়ে উঠে। গুণী শিল্পী দেবজ্যোতি মিশ্রের সঙ্গীত পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গান- আমার সাধ না মিটিলো আশা না পুরিলো সকলই ফুরায়ে যায় মা বারবার আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে। স্বপ্নের সোনার বাংলার জন্য সারাজীবন যে সংগ্রাম করলেন তাঁর জীবদ্দশায় তা অপূর্ণ থেকে যাবে-সেই খেদই যেন এই গানে ফিরে ফিরে আসে।
সব হারানো শোকে শাড়ির আঁচলের কোণে যখন শেখ হাসিনা অশ্রু মুছেন এজিদের পাষাণ হৃদয়ও কেঁদে উঠবার কথা। তাই এটা শুধু একজন ব্যক্তি শেখ হাসিনার জীবনের গল্প নয়; এ যেন শত ঘাত প্রতিঘাত, ঝড় ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ, কন্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে, হাল না ছেড়ে, শেষ না দেখে- অসম সাহসী যুদ্ধে লড়ে ঘুরে দাঁড়ানো আশাবাদী এক বাংলাদেশের গল্প। জীবন কখনো কাল্পনিক গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রেরও অধিক।
‘হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল’ দেখতে দেখতে মনে পড়ে শেখ হাসিনার জীবন অরুন্ধতী আর পুরাণের সেই আগুন পাখি ফিনিক্স এর মতন। প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের সিআরআই নির্বাহী পরিচালক সাব্বির বিন শামস বলেন, আমাদের চেনা জানা শেখ হাসিনার অজানা অদেখা গল্পগুলোই এর মূল উপজীব্য।
আমরা শেখ হাসিনাকে বহুবার দেখেছি রাজনীতির মঞ্চে। তাকে হাসতে দেখেছি, কাঁদতে দেখেছি। কিন্তু কখনও দেখিনি একান্ত নিভৃতে একা মানুষটাকে; একটি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে। আমরা তার গল্পটা জানি না। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একা এতগুলো দিন সেই ভীষণ কষ্টের বোঝা একা বয়ে চলেছেন যিনি, তারও তো একটা গল্প আছে।
এই ডকুমেন্টারিতে সেই অদেখা মানুষটার অন্য জীবনের গল্প জানবে সবাই।’ নির্মাতা পিপলু খান বলেন, শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সম্পর্ক, তার সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা, বাবার রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তার অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়টি। তাছাড়া শেখ রেহানার কথাও এখানে খুব স্বাভাবিকভাবে চলে আসে।
কারণ তারা দুই বোন হরিহর আত্মা। পরস্পরের জীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্লোরিফাই করতে নয়। কোনো রাজনৈতিক বিষয়কে বিবেচনায় নিয়েও নয়, বরং একটি দেশের ইতিহাসের একটি সময়কে ৭০ মিনিটে তুলে আনতে চেষ্টা করা হয়েছে।
ছবিটির পরিবেশক গাউসুল আজম শাওন বলেন, এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর নির্মিত কোনো প্রামাণ্যচিত্র নয়। এটা বঙ্গবন্ধু কন্যার ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র। যাতে ৭৫- এর আগে ও পরের শেখ হাসিনাকে সবাই জানতে পারবেন। ডকুফিল্মটিতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার আবেগঘন কণ্ঠ আর দৃশ্যায়নে ফুটে উঠেছে, বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালে নৃশংস হত্যার পর বিষাদপূর্ণ সময় ও দুই বোনের নির্বাসিত জীবনসংগ্রামের চিত্র।
শেখ হাসিনা কখনও বঙ্গবন্ধু কন্যা, কখনো জননী, কখনো বোন, কখনো গণমানুষের ত্রাতা রূপের বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে এ প্রামাণ্যচিত্রে। আর এই উদ্যোগের অন্যতম একজন প্রযোজক বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতি আমাদের অনেক দায় আছে।
এ দায় থেকেই এই কাজটি করা। শেখ হাসিনা যে অসাধ্য সাধন করেছেন তার কিছু চিত্র এখানে পাওয়া যাবে। কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নয়, ইতিহাসের প্রতি পুরোপুরি নির্মোহ থেকে এটি নির্মিত হয়েছে। সবার ভাল লাগলে আমাদের এই চেষ্টা সার্থক হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)