বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করে সংঘটিত কোন ঘটনা নয়। দীর্ঘসময়ের পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রের ফলাফল এই গর্হিত ঘটনা। এটি ভাবা ভুল হবে যে, গুটিকয় সামরিক অফিসারের ক্ষোভের কারনে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। এই ভয়ংকর ঘটনায় দেশীয় ষড়যন্ত্রী যেমন জড়িত ছিল, তেমনি ছিল বিদেশী সুবিধাভোগী। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল পাকিস্তান, আমেরিকা, চীন, সৌদি আরব এবং দেশীয় সুবিধাভোগী, পাকিস্তানপন্থী ও আওয়ামীলীগ বিরোধীদের সম্মিলিত একটি ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিশোধ ও তাঁবেদারী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা; আমেরিকা, চীন ও সৌদি আরবের স্বার্থ ছিল বৈশ্বিক রাজনীতির অংশ; আর দেশীয় দালাল- মুশতাক গং, ফারুক-রশীদ-ডালিম গং, অাওয়ামীলীগ বিরোধী ও পাকিস্তানপন্থীদের স্বার্থ ছিল নিজেদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করা।
তারপরও একজন রাষ্ট্রপতি, বৃহৎ একটি জাতি-রাষ্ট্রের জনককে হত্যা করা সহজ কোন কাজ ছিল না। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রীরা দু’টি সুবিধা বেশ ভালোভাবে পেয়েছিল- ১. বাঙালির উপর বঙ্গবন্ধুর অতল ভালোবাসা ও অগাধ বিশ্বাস এবং ২. আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ভালোমানুষির মুখোশ পরে থাকা নিরেট শয়তানের আধিক্য।
বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে নিজ সন্তানের মত ভাবতেন। তিনি ভাবতেই পারতেন না যে, বাঙালি কখনও তাঁকে হত্যা করতে পারে। তাই, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, স্বয়ং ইন্দিরা ও সামরিক বাহিনীর অনুগতরা তাঁকে সাবধান করার পরও তিনি তা এড়িয়ে গেছেন। অপরদিকে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ছিল এই ষড়যন্ত্রীরা। এরা বঙ্গবন্ধুর সামনে হাসিমুখে আনুগত্যের মুখোশ পরে থাকতো।
এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধুরন্ধরদের একজন খন্দকার মুশতাক, সে ছিল বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত একজন ব্যাক্তি, যে সরাসরি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিল। মুশতাকের বিশ্বাসঘাতকতার চরিত্র নতুন ছিল না, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও সে ষড়যন্ত্র করেছিল। ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরে মোশতাক কুমিল্লা হতে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমপি জহিরুল কাইয়ুমের মাধ্যমে কলকাতার মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ গ্রিফিনকে প্রস্তাব দেয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্ততায় যদি বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত করা যায় তবে সে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ হতে বিরত করে পাকিস্তানের সাথে ফেডারেশান গঠনের চেষ্টা করবে। মোশতাকের এই চক্রান্ত নসাৎ হয়ে গেলেও মার্কিনিদের সুনজর সে পায়; যার প্রমাণ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার ছিল সবচেয়ে লাভজনক, এতে সহজেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়া সামরিক বাহিনীর অফিসার রশীদ, ফারুক, ডালিম মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয় অক্টোবর থেকে নভেম্বরের মধ্যে, যখন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় সুনিশ্চিত। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে এদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা প্রমান করে এরা আসলে ছিল পাকিস্তানের চর। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী সামরিক বাহিনীর সিনিয়র অফিসার জেনারেল জিয়ার নামও এই তালিকায় আসে। মুক্তিযুদ্ধে জিয়ার বিতর্কিত ভূমিকা ছিল, যার কারনে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই তদন্ত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার প্রারম্ভে জিয়া ছিল পাকিস্তান অনুগত অফিসার। জিয়া মুক্তিযুদ্ধে তখনই অংশগ্রহণ করে, যখন তার সামনে এছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না। জিয়া ছিল একটি সম্পূর্ণ অাত্মকেন্দ্রিক-সুবিধাবাদী চরিত্র, যার মূল লক্ষ্যই ছিল নিজেকে সার্ভ করা। স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়ার ক্ষোভ ছিল, তাকে সেনাপ্রধান করা হয়নি। রশীদ-ফারুকের জবানবন্দী, সাংবাদিক লিফশুলজ ও কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জীর লেখনী হতে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এটি সুস্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জিয়া অবগত ছিল কিন্তু নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য ক্ষমতা থাকা সত্বেও সে এবিষয়ে কোন টুঁ শব্দ করেনি; যা প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু হত্যায় তার সম্মতি ও সংশ্লিষ্টতা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে বঙ্গবন্ধু-সরকার তাকে কূটনীতিক মিশনে ইউরোপে পাঠাতে চাইলে, জিয়া প্রভাব খাটিয়ে ও অনুরোধ করে, তা বাতিল করেছিল; কারন, সে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় দেশে থেকে এই গর্হিত ঘটনার সুবিধে লুফে নিতে চেয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর খুনি ও ষড়যন্ত্রীদের সাথে সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছিল। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে ছিল খুনি ও ষড়যন্ত্রীদের নিয়মিত যাতায়াত। ৭৪’র নভেম্বরে হেনরি কিসিঞ্জার ৮ ঘন্টার সফরে বাংলাদেশে আসেন। কিসিঞ্জারের এই সফরের পর হতে ঢাকাস্থ সিআইএ কর্মকর্তা ফিলিপ চেরি বঙ্গবন্ধুর খুনি ও দেশীয় ষড়যন্ত্রীদের সাথে নিয়মিত বৈঠক করতো। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা হতে ৭৪’র ডিসেম্বরে ও ৭৫’র মার্চে জানানো হয় যে, সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ও ক্যাভালরি ইউনিটের বেশকিছু অফিসার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু বাঙালির প্রতি ভালোবাসা-আস্থা ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে যথাযথ তথ্য সরবরাহে দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার ব্যর্থতার কারনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকার এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। দেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে একাংশের বিশ্বাসঘাতকতা ও আরেক অংশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা।
বিশ্বাসঘাতকতা, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, বিশ্বস্তদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ১৯৭৫’র ১৫ আগস্টের কলঙ্কজনক এই ঘটনার জন্ম দেয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড সংঘটিত হবার পর খুনি মেজর ডালিম রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশের ঘোষণা দেয়, তখন সামরিক বাহিনীর অনেক অফিসার বিশ্বাসঘাতক-খুনি নতুন এই সরকারের প্রতি অানুগত্য প্রকাশ করে, যা বাঙালির ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার নিকৃষ্টতম নজির। এদের মধ্যে ছিল কর্নেল আবু তাহের, আকবর হোসেন, মেজর শাহজাহান ওমর, জিয়াউদ্দিন, রহমতুল্লাহ সহ আরো অনেকে। বিশ্বাসঘাতকতার এই মিছিলে শামিল হয় অনেক রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তা। মানব ইতিহাসে এরকম নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার নজির বিরল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড ছিল না, এটি ছিল পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম জাতির স্বপ্নের মৃত্যু, আমাদের স্বাধীনতার মহানায়কের মৃত্যু, যার ফল আজো বাঙালি ভোগ করছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)