ভোর তখন সাড়ে ৬টা। হোটেল থেকে সাদা পাঞ্জাবী পরে ঈদের নামাজের জন্য বের হয়েছি। লক্ষ্য দিল্লীর ঐতিহ্যবাহী জামে মসজিদ। দ্রুত যাব মেট্রোরেলে চড়ে। নয়াদিল্লী রেল স্টেশনের ভেতর দিয়ে হেঁটে মেট্রোস্টেশনে যাচ্ছি। এসময় সামনে পড়লো এক পুলিশ সদস্য। কোথায় যাচ্ছি জানতে চাইলে ঈদের নামাজের কথা বলতেই তার কৌতূহলী প্রশ্ন, ‘আজ ঈদ হ্যায়?’
এমন আশ্চর্যজনক প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার মধ্যদিয়ে নয়াদিল্লীতে ঈদের দিন শুরু হলো। কিছুটা বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, ভারতে প্রায় ২৫ কোটি মুসলমানের বসাবস থাকলেও দেশের একজন পুলিশ সদস্য মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ কখন হচ্ছে তা জানে না। অথচ বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতিটি ধর্মীয় উৎসব সম্পর্কে আমরা শুধু ধারণাই রাখি না, নিজেরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করি। তারপরও আর কোন কথা না বাড়িয়ে ঐতিহ্যবাহী দিল্লী জামে মসজিদে ঈদের নামাজের জন্য রওয়ানা হলাম।
দুর্দান্ত মেট্রোরেলের বিপরীতে রিক্সা বিড়ম্বনা
পুলিশের বিব্রতকর প্রশ্নোত্তর শেষে দ্রুত মেট্রোতে উঠে পড়লাম। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ছেড়ে দিলো ট্রেন। দুর্দান্ত বাহন। বিশেষ করে মেগাসিটির জন্য। খুব সহজেই দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছার জন্য উপযুক্ত বাহন। চলন্ত ট্রেনে আমি ঢাকার স্বপ্ন আঁকছি। আহা! আমরাও পেতে যাচ্ছি এমন মেট্রো সার্ভিস। ২ ঘণ্টার যানজটের পথ মাত্র ৫ মিনিটে অতিক্রম করা যাবে!
কল্পনার জগতে থাকাবস্থাতেই ট্রেন চাঁদনী চক স্টেশনে এসে গেছে। সময় লাগলো মাত্র ৫ বা ৬ মিনিট! তখন প্রায় ৭টা বাজে। দ্রুত স্টেশন থেকে বের হয়ে রিক্সা নিলাম জামে মসজিদের জন্য। রিক্সাওয়ালা যেটি করলো সেটাকে অন্যায় বলবো নাকি ন্যায় বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না। জামে মসজিদে না নিয়ে ফতেহপুরি মসজিদ থেকে খানিক দূরে নামিয়ে দিলো। আর তিন মিনিটের ভাড়া রাখলো ৩০ রূপি!
জামে মসিজদে ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ হাতছাড়া
দিল্লীতে ঈদ পালন করা হতে পারে বুঝার পর থেকে মনে মনে ভেবে রেখেছি দিল্লী জামে মসজিদে নামাজ পড়বো। ভারতের বৃহত্তম এই মসজিদটি নির্মিত হয় ১৬৫০ হতে ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দে। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে নির্মিত স্থাপত্যের একটি সেরা নিদর্শন এটি।
শাহজাহানাবাদের সুরক্ষিত শহরে একটি মসজিদের প্রয়োজনীয়তার জন্য সম্রাট শাহজাহান জামে মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ করতে পাঁচ হাজার শ্রমিকদের টানা ছয় বছর সময় লেগেছিল। তৎকালীন শ্রমিকদের প্রতিদিন ১ পয়সা করে মজুরি দেওয়া হত। এই প্রকল্পটির জন্য দশলাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছিল, এমনকি এই মূল্যের মধ্যে পাথর এবং মার্বেলের মূল্য বিবেচনা করাই হয়নি।
জামে মসজিদের বাস্তবিক নাম হল মসজিদ-ঈ জাহাঁ-নূমা। মূল পরিকল্পনা এবং নকশা ওস্তাদ খালিল দ্বারা করা হয়েছিল। মসজিদটিতে হরিণের চামড়ার উপর লিখিত কোরানের একটি প্রতিলিপি এখানে দেখা যেতে পারে। নয়া দিল্লীর চাঁদনী চক এ প্রসিদ্ধ লাল কেল্লার খুবই সান্নিধ্যে মসজিদটির অবস্থান। জামে মসজিদে একসঙ্গে ২৫ হাজার ব্যক্তি জমায়েতে নামাজ আদায় করতে পারে।
এমন একটি বিখ্যাত মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করার সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায়। কিন্তু তা আর হয়নি। রিক্সাওয়ালা জামে মসজিদের বদলে নিয়ে গেছে উল্টা দিকে! তবু কিছুটা পথ হেঁটে সামনে গিয়ে জানতে পারলাম জামে মসজিদে নামাজ শেষ।
ফতেহপুরি মসজিদে ঈদের জামাত
একদম নতুন অভিজ্ঞতা। কোথা থেকে কোথায় এসে ঈদ পালন! খুব অবাক ব্যাপার। বোধ হওয়ার পর থেকে কখনো দেশের বাইরে তো দুরে থাক, পরিবারের বাইরেও ঈদ পালন করা হয়নি। সেখান থেকে দিল্লীতে ঈদ! একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।
দিল্লীতে এসে বেশ আনন্দ সহকারে ঈদ পালন করবো মনে করেছিলাম। কিন্তু জামে মসজিদে নামাজ মিস তাতে ছেদ পড়লো কিছুটা। তবে দিল্লীর ঐতিহ্যবাহী ফতেহপুরি মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করাটাও মন্দ হয়নি।
এটিও সেই মোঘল আমলে নির্মিত মসজিদ। ১৬৫০ সালে সম্রাট শাহজাহান এর সময়। শত শত বছরের পুরনো মসজিদে ঈদের দিন মানুষের ঢল নেমেছে। মসজিদ পূর্ণ হওয়ায় হাজার হাজার মুসল্লি রাস্তায় নামাজ আদায় করেছেন।এসময় শুভ্রতায় ভরে উঠে বিশাল এলাকা। এ যেন এক অনাবিল ছবি। এমন ছবি আমাদের শোলাকিয়ায় দেখা মেলে। সকাল থেকে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেও ফতেহপুরি মসজিদে এসে বহু মুসল্লির সান্নিধ্য পেয়ে ভালো লাগলো।
বিকেলে কয়েকজন বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে সুন্দর সময়
খবর পেলাম বিবিসি বাংলার আরিফ আল মামুন ভাই দিল্লীতে ঈদ পালন করেছেন। বিকেলে দেখা হলো তার সঙ্গে। মামুন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য। আন্তরিকতার পরিমাণ তাই অনেক বেশি। এর মধ্যে সাংবাদিকতা বিভাগের আরো দু’জন ছোট ভাই রিফাত জামান ও নোমানের সঙ্গে দেখা। এ দু’জন সহ এবার ঈদে মোট তিনজনের সঙ্গে কোলাকুলি করার সুযোগ হয়েছে। তৃতীয় জন আমার সফর সঙ্গী মীর লোকমান।
বিকেলের এসময়টায় কিছুটা মনে হলো ঈদ। বেশ গল্প চলল। মামুন ভাই জামে মসজিদে ঈদের জামাত পেয়েছেন। রিফাত জামান ঈদের নামাজ পায়নি। তবে মসজিদে সেলফি তুলে বাড়িতে দেখিয়েছে ঠিকই। এসব তার কথা।
এভাবে কিছুক্ষণ গল্প চলল। অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি হলো। আরিফ আল মামুন ভাইয়ের অভিজ্ঞতার ঝুলি বড়। তিনি জানালেন, দিল্লীতে ঈদই নয় শুধু দিপাবলী ছাড়া কোন পূজা উপলক্ষেও তেমন কোন উৎসব হয় না।
আসলেই তাই। ঈদের আমেজ বলতে তেমন কিছুই ছিল না দিল্লীতে। প্রচুর মুসল্লি, বিশাল ঈদের জামাত হলেও তা মসজিদে এসে নামাজ পড়া পর্যন্তই। প্রায় ২৫ কোটি মুসলামনদের ভারতে এমন নীরস ঈদ ভাবতেই অবাক লাগছে।
আমি নিশ্চিত বলতে পারি, পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের ও সুন্দর ঈদ পালিত হয় আমার বাংলাদেশে।
ছবি: সাইফুল্লাহ সাদেক