বাঙালি জাতি গৌরবের জাতি, বাঙালি জাতি সংগ্রামের জাতি, বাঙালি জাতি ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতি। সে হিসেবে বাঙালির অর্জনও উল্লেখ করার মতই। পৃথিবীর বুকে নিজেদের জাতকে অনন্য বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন এবং অন্যদের জন্য উদাহরণস্বরূপ হিসেবে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি আমরা। আজকের এ অবস্থানে আসার জন্য আমাদের পূর্ব পুরুষরা কত যে ত্যাগ ও কষ্ট সহ্য করেছেন ইতিহাস ঘেটে দেখলে তার কার্যকারণ তথা মর্মার্থ অনুধাবন করা যায়। আমাদের পূর্ব পুরুষরা আমাদের কি দিয়েছেন? একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছেন, একটি স্বাধীন পতাকা সহ মানচিত্র পেয়েছি, স্বাধীন দেশের স্বাধীন ভাষা দিয়েছেন তথাপি স্বাধীন ভাবে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি পূর্ব পুরুষদের বদৌলতে। আমরা আজ যা অর্জন করেছি বা যা দেখতে পাচ্ছি তা কিন্তু স্বাধীনতা ব্যতিরেকে কখনোই সম্ভব হতো না।
আমরা যারা নতুন প্রজন্ম রয়েছি তাদের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রাম বা স্বাধীনতার জন্য কোন যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। তাই দেশের প্রতি ভালবাসা দেখানোর পূর্ব শর্ত হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা দেশের সার্বিক সংগ্রামের পিছনে যেই সব বাঙালির অসামান্য অবদান রয়েছে তাদের প্রতি নিবিষ্ট চিত্তে সম্মান জানানো, তাদের আত্নার শান্তি কামনা করা। দেশপ্রেমিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলাদেশ সরকারও নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন যা অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং নতুন প্রজন্মের কাছে পূর্বোক্ত ইতিহাস ও ইতিহাসের সাথে জড়িত সাহসী বাঙালিদের প্রতিচ্ছবি সামনে নিয়ে আসবে।
আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। এ দিবসে জাতির যেইসব শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হত্যা করা হয় তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করছি। ধিক্কার জানাই সেইসব নরকের কীটদের প্রতি, যারা পাকিস্তানিদের সাথে যোগসাজশে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার নীলনকশা করেছিল। বিচার দাবি করছি ঐসব হায়ানাদের যারা একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালির প্রথিতযশাদের হত্যার পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের বিজয় যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র সেই সময়ে আরেকটি নারকীয় হত্যাকান্ডের সূচনা করে থাকে হায়েনা বাহিনী। পাকিস্তানিরা যখন বুঝতে পেরেছিল পরাজয় আসন্ন সেই সময়ে এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় বাঙালিদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যার নীলনকশা করা হয় যাতে বিজয় লাভের পর বাঙালিরা আর মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে। সেই নীলনকশা বাস্তবায়নে এ দেশের কুটিলরা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছিল তা না হলেও আরো আগেই আমরা অগ্রগতির সূচকে এগিয়ে থাকতাম।
হত্যার তালিকায় ছিল প্রথিতযশা শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, চিকিৎসক সমাজসেবক তথা সমাজের প্রতিষ্ঠিত মানুষ, যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সফলতার নমুনা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর যু্দ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়তে এ সব মহান মানুষেরা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারলেই দেশের অগ্রগতির মাত্রা আরো মসৃণ হতো। দেশ অনেক আগেই প্রবৃদ্ধির হারে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে, জিডিপি ও জিএনপি হারে তথা সামগ্রিক উন্নয়নে আরো সক্ষমতা লাভ করত। এ সকল ক্ষেত্রেই যেন বাধাগ্রস্থ করতে পারে বাঙালিদের সেই নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য হত্যা করা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। মিরপুরের বধ্যভূমিতে লাশের পর লাশ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে। সারা দেশব্যাপী এ রকম নিধনযজ্ঞ চালানো হয় বিজয়ের দুই একদিন আগে। সব পরিসংখ্যান সেভাবে সংরক্ষণে রাখা হয়নি কিংবা সে সময় রাখার সুযোগ ও ছিল না। তাই নাম না জানা অনেক প্রথিতযশাদের হত্যা করা হয় এবং অনেককে আর পাওয়া যায়নি যুদ্ধের পরে।
নতুন প্রজন্মকে আমাদের সেইসব বিভীষিকাময় দিনের তথ্য সম্বন্ধে জানাতে হবে, যেন দেশের জন্য তাদের আবেগ, অনুভূতি ও ভালবাসা সুতীব্র হয়। তবে এটাও লক্ষ্য রাখতে হবে, সে আবেগ অনুভূতি যেন কখনই লোক দেখানো না হয়। কারণ, লোক দেখানো আবেগ দিয়ে আর যাই হোক প্রকৃত দেশপ্রেম তথা দেশের প্রতি আবেগ ফুটে উঠে না। আজকের এ নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য লোকদেখানো আবেগ প্রকাশ করাকে উদ্দেশ্য করেই।
এখন অনেকের কাছে লোকদেখানো আবেগই মুখ্য নিয়ামক হিসেবে উঠে আসছে। ২১ ফ্রেবুয়ারি ভাষা দিবসে প্রভাতফেরি করে আমরা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক দেই। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিবসে আমরা দিবসের তাৎপর্যকে প্রতিপাদ্য হিসেবে নিয়ে সম্মান জানানোর চেষ্টা করে থাকি। এটাই স্বাভাবিক এবং সকলেই এটি করে থাকে।কিন্তু তখনই মর্মাহত হই যখন শহীদদেরকে তথা শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মান জানানোর নামে অসম্মান করা হয়।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সম্মান জানানোর চেয়ে নিজেকে জাহির করার আকাঙ্খা ইদানিং প্রতিপাদ্য হিসেবে দেখা দিচ্ছে কেন? আজকের বুদ্ধিজীবী দিবসেও সকালে ঘুম থেকেই উঠে দেখি, পুষ্পমালা দেওয়ার সময় অনেকেই হাসিমুখে সেলফি তুলে ফেসবুকে ছবি আপলোড দিচ্ছে। বিষয়টি অনেক সময় দৃষ্টিকটু। হাসিমুখে ফেসবুকে ছবি দেওয়া বুদ্ধিজীবীদের অসম্মান জানানোরই নামান্তর। দিবসের মর্মার্থ না বুঝে উদযাপন করাও যুক্তিসংগত নয়। আর আপনাকে তো কেউ জোর করে বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরে নিয়ে যাচ্ছে না? আপনার-আমার কোনো আচরণের কারণে বুদ্ধিজীবীদের কোনো অসম্মান হোক তা নিশ্চয় আমরা চাইবো না। আমরা কী একবারও সেই বিভীষিকাময় সময়টার কথা চিন্তা করেছি? আমি আপনি সে সময় থাকলে, কী ভূমিকা পালন করতাম? যে সব মানুষ দেশের স্বাধীনতার পক্ষে থেকে জোরালো ভূমিকা পালনের পাশাপাশি বর্হিবিশ্বে জনমত গড়ে তোলার জন্য অদম্য গতিতে কাজ করেছেন, তাদেরকে আমরা অসম্মান করি কোন সাহসে? আজকের এই দেশে আমি আপনি স্বাধীনভাবে সবকিছু করতে পারছি একমাত্র তাদের অবদানের কারণেই।আসলে বিবেককে জাগ্রত করা উচিত সকলের। তা না হলে কাঙ্খিত পরিবর্তন আসবে না কখনোই।
কী নির্মম ছিল সেই দিনগুলি! একটিবারের জন্য কি আমরা সেই দিনগুলিকে স্মৃতিপটে ভাসাই? তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের কর্মের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত একেকজন রত্ন ছিলেন। ইচ্ছে করলেই পাকিস্তানিদের সাথে তারা হাত মেলাতে পারতেন। কিন্তু দেশের প্রতি অসীম ভালবাসা, দায়িত্ববোধ তাদেরকে বাংলাদেশ অর্জনের পিছনে ভূমিকা রাখতে প্রেরণা দিয়েছিল। সেই সব বুদ্ধিজীবীদের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের সময় যখন কোন বাঙালি হাসিমুখে সেলফি তুলে পোষ্ট দেয় “বুদ্ধিজীবী স্মরণে” তখন কি মনে হয় আপনার?
১৪ ডিসেম্বরের রাতের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা সম্পর্কে জেনে বুঝে বুদ্ধিজীবীদের সম্মান জানানো হলে, কখনোই সেলফি তোলার মতো লোক দেখানো দিবসটি উদযাপন করতো না কেউই। এর দায় কার? রাষ্ট্রের না জনগণের? স্বাধীনতার পরে একটা দীর্ঘসময় রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল স্বাধীনতা বিরোধীরা। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস যে সম্মানজনক, তা যেভাবে প্রকাশ করার কথা ছিল সেভাবে হয়তো সকলের কাছে প্রকাশ পায়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা দিবসটিকে যে মর্যাদার সহিত তথা আবেগের ন্যায় উদযাপন করে থাকেন, তাদের মতো না হলেও কোনভাবেই শহীদদের ত্যাগকে অসম্মান জানানো হয়, এমন কিছু করার অধিকার নেই আমাদের?
কাজেই, দিবসের মর্মার্থ না বুঝে দিবস উদযাপন করা হবে সঠিক কাজ। তাই সকলের প্রতি অনুরোধ থাকবে প্রকৃত ইতিহাস জেনেবুঝে আমাদের অনুভূতি প্রকাশ করা। পাশাপাশি এ বিষয়ে সরকারিভাবে ঘোষণাও আসতে পারে যাতে করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কোনভাবেই অসম্মান করা না হয়, অসম্মানকারীদের জন্য শাস্তির বিধান ও রাখা যেতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)।