পূণ্যময় চরিত্রের স্ফুরণ ‘দানশীলতা’র মতো একটি অনন্য অসাধারন গুণ অর্জনের মাস মাহে রমজান। মাহে রমজানে রোজা পালন মানুষকে দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা ও মহত্বের শিক্ষা দেয়। পবিত্রতম এ মাসটি ক্ষুধার্তদের কষ্টানুভূতির মাস, দুঃখীর দুঃখ মোচনে সমব্যথী হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসার মাস। এ রমজান নবীর নির্ধারিত রোজার ফিতরা আদায়, যাকাত প্রদানসহ নানা ধরনের দান-সাদকাহর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের উপযুক্ত মাস।
মানবতার সর্বোত্তম আদর্শ রাসুলে কারীম (সা.) এর জীবনের সর্বাধিক মহিমান্বিত অভ্যাস ছিল বিপুল হারে উদারচিত্তে দান করা, এ গুণ ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তার এ মনোমুগ্ধকর কার্যের সর্বোচ্চ প্রকাশ দেখা যেত রমজানের পবিত্র মৌসুমে। ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত একটি হাদিসে এসেছে, ‘লজ্জার আবরণ খসে যাওয়ার পূর্বেই প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যেত রাসুলের দানের কল্যাণ। যেমন মুক্ত বসন্তের শীতল প্রবাহিত বায়ু পৌঁছে যায় ঘরে ঘরে, খরতাপ দগ্ধ জমিতে, যার পরশে আন্দোলিত হয় প্রতিটি প্রাণ।’ [বোখারি: ৩২২০, মুসলিম: ৬১৫৮]। আত্মিক পরিশুদ্ধতায় মহান রব্বে রাহিমের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার সেতু নির্মিত হয়। অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজানে দানের আধিক্যের কারণেই সেই আত্মিক শুদ্ধতার প্রাচুর্যতা ঘটে। [ফাতহুল বারি, ইবনে হাজার,খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৪১]।
হিসেব নিকেষের খাতা নিয়ে বসলে দেখা যাবে, কাউকে দান করায় পক্ষান্তরে লাভ আমাদেরই। এর দ্বারা আমাদের গুণাহের মেঘমালা ঝরে গিয়ে অগণিত সাওয়াব আমল নামায় অবিরত জমা হতে থাকে। মহান আল্লাহ তায়ালা এ কথা বিভিন্ন উদাহরণের সাহায্যে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। যেমন সূরা বাকারার ২৬১ নং আয়াতে মুমিনের দানকে তুলনা করেছেন, একটি শস্য দানার সাথে। যা থেকে পরবর্তীতে পর্যায় ক্রমে একশ থেকে মোট সাতশটি পর্যন্ত শস্যদানা পাওয়া যায়। আবার একই সূরার ২৬৫ নং আয়াতে দান-সাদকাহকে তুলনা করেছেন উঁচু টিলায় অবস্থিত বাগানের সাথে। যেখানে বৃষ্টিপাতের কারণে ফল দ্বিগুণ পরিমাণে পাওয়া যায়। অনুরূপ মাহে রমজানে দান-সাদকাহ’র কারণে মুমিনের নেক আমলের পরিমান বহু বহু গুণে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা আত্মমর্যাদাশীল অথচ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত, তারা প্রকাশ্যে সাহায্য চাইতে লজ্জাবোধ করলেও তাদের তরে দানের ভালোবাসার হাত প্রসারিত করা সিয়াম সাধনার মুল দাবী। সে জন্য নবী (সা.) ইরশাদ করেন, মাস সমূহের মাঝে রমজান মাসের সাদকাহ হচ্ছে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ। (সুনান আত-তিরমিযী, যাকাত অধ্যায়, হাদীস নং-৬৩৩)।
শুধু প্রথাগত রোজা পালন করে, দানশীলতা ও বদান্যতার চর্চা না করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রিয়জন হওয়া অকল্পনীয়। সত্যের দিশারী খলিফা ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রা.) বলেন, ‘নামাজ মানুষকে আল্লাহর পথে অর্ধেক পৌঁছে দেয়। রোজা তাকে আল্লাহর ঘরের দরজার কাছে পৌঁছায়, আর দান-খয়রাত তাকে খোদ আল্লাহর ঘরে পৌঁছে দেয়।’
বলা যায়, জান্নাতে প্রবেশের জন্য দান-সাদকাহ সর্বোচ্চ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। দানশীলতার এ সিঁড়ি বেয়ে খাঁটি মুমিন-মুত্তাকীর স্থরে উপনীত হওয়ার সুবর্ণ এ সুযোগ এ মাসে সানন্দে গ্রহণ করাই হবে ঈমানদারের জন্য শ্রেয়তর উপায়। কারণ যার সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়া বা খোদাভীতি সৃষ্টি হলো না, দানশীলতা ও বদান্যতার গুণাবলী তৈরি হলো না, হাদীসের ভাষ্যে তার রোজা পালন নিছক উপবাস ছাড়া আর কিছু নয়। বলা চলে সে ব্যক্তি রোজার প্রকৃত দাবী পুরণে ব্যর্থ। প্রত্যাশা সবিশেষ, মহান রব্বে কারীম আমাদের প্রত্যেককে সাধ্য মতো হৃদ্যতাপূর্ণ মনোভাবের সাথে দুঃস্থ মানবতার সেবায় অধিক হারে দান-সাদকাহ ও ব্যয় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : মুফতি আবুল কাশেম মোহাম্মদ ফজলুল হক উপাধ্যক্ষ, কাদেরিয়া তৈয়্যেবিয়া কামিল মাদরাসা