২০১০ থেকে ২০১৯। শেষ হচ্ছে আরো একটি দশক। আসছে জানুয়ারিতে নতুন বছরের সাথে সাথে নতুন দশকে পা রাখতে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। সেইসঙ্গে বিগত দশ বছরের খতিয়ান নিয়েও বসবেন অনেকে। চলচ্চিত্রেও হবে সেই হিসেব-নিকেষ।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দশক বলা হচ্ছে শেষ হতে যাওয়া দশকটিকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ফলে ডিজিটাল ফরম্যাটে চলচ্চিত্র নির্মাণ যেমন সহজ হয়েছে, সেই সঙ্গে সঙ্গে দেখার মাধ্যমটিতেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এখনকার দর্শক শুধু আর সিনেমা হলের ভরসায় থাকছেন না!
পরস্পর বিরোধী এই দশকে তবু নির্মিত হয়েছে বেশকিছু আলোচিত বাংলা ছবি। যে ছবিগুলো দর্শক দেখেছেন, প্রশংসাও করেছেন।
দশক শেষে দেশে-বিদেশে আলোচিত এমন দশ ছবির তালিকা রইলো এখানে। যে ছবিগুলোর বেশির ভাগই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রশংসিত হয়েছে:
১. রানওয়ে:
চলতি দশকের শুরুতেই মুক্তি পায় তারেক মাসুদের আলোচিত ছবি ‘রানওয়ে’। দেশীয়,আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক আর্থসামাজিক আবহ একটি সহজ-সরল ছেলেকে কীভাবে উগ্র ও জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়তে সাহায্য করে এবং তা তার নিজের জীবনে, পরিবারে ও সমাজের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে—এমন ভাবনার কাহিনীচিত্র ‘রানওয়ে’। ২০০৫-০৬ সালে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনাগুলোই নির্মাতাকে এই সিনেমা নির্মাণে উৎসাহিত করে বলে তৎকালীন সময়ে গণমাধ্যমকে বলেন প্রয়াত তারেক মাসুদ। ২০১০ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি দর্শক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
২. ডুবসাঁতার:
প্রখ্যাত নির্মাতা নুরুল আলম আতিকের প্রথম সিনেমা ‘ডুবসাঁতার’। রেণু নামের এক নারীর সংগ্রামের গল্প ‘ডুবসাঁতার’। যে অনেক বিপন্নতার মাঝেও হাল ছাড়ে না। প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করে চলে। ডিজিটাল ফরম্যাটে নির্মিত এই ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন জয়া আহসান। এছাড়াও অভিনয় করেছেন শেহজাদ চৌধুরী, অমোক ব্যাপরী, ওয়াহিদা মল্লিক জলি, শাহরিয়ার শুভ, বোংশু হোর, শ্রাবন্তী দত্ত তিন্নি, স্বাধীস খসরু, সুষমা সরকার, স্বাগতাসহ আরও অনেকে।
৩. টেলিভিশন:
২০১৩ সালে মুক্তি পাওয়া মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত বহুল আলোচিত ছবি ‘টেলিভিশন’। চলচ্চিত্রটি নির্মাণাধীন থাকাকালে গুটেনবর্গ ফিল্ম ফেস্টিভাল-এ চিত্রনাট্যের জন্য পুরস্কার লাভ করে এবং মুক্তির আগেই জিতে নেয় ২০১২ সালের ‘এশিয়ান সিনেমা ফান্ড ফর পোস্ট প্রোডাকশন’ পুরস্কার। এছাড়া ১৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘এশিয়ান সিলেক্ট’ ক্যাটাগরিতে সেরা ছবি হিসেবে ‘নেটপ্যাক পুরস্কার’ এবং অষ্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১৩ এশিয়া-প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডে (অ্যাপসা) ফার্স্ট জুরি গ্র্যান্ড পুরস্কার অর্জন করে টেলিভিশন।
৪. শুনতে কি পাও!:
চলতি দশকে দেশে ও দেশের বাইরে বাংলা ভাষায় নির্মিত সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রগুলোর একটি কামার আহমাদ সাইমনের ‘শুনতে কি পাও!’। ২০১৪ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটি পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রামাণ্য উৎসব জার্মানীর ডক-লাইপজিগের ৫৫তম আসরে উদ্বোধনী রাতের ছবি ছিলো। এরপর বিশ্বের বৃহত্তম প্রামাণ্য আসর ইডফা, এশিয়ার অন্যতম আসর ইয়ামাগাতায়, জিতে নেয় ইউরোপের অন্যতম প্রামাণ্য উৎসব প্যারেস সিনেমা দ্যু রিলের শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার ‘গ্রাঁপ্রি’, মুম্বাইয়ে শ্রেষ্ঠ সিনেমাটোগ্রাফিসহ শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার ‘স্বর্ণশঙ্খ’, ফিল্ম সাউথএশিয়ার ‘জুরি পুরস্কার’। প্যারিসের মর্যাদাপূর্ণ শতবর্ষী ছবিঘর লুক্সারে হয় ছবিটির একটি দর্শকনন্দিত প্রদর্শনী। লাইপজিগ থেকে লুক্সার পর্যন্ত ছিল ‘শুনতে কি পাও!’
৫. জালালের গল্প:
বাংলাদেশের তিন ধরনের সামাজিক পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার গল্প নিয়ে নির্মিত আবু শাহেদ ইমনের প্রথম ছবি ‘জালালের গল্প’। ছবিটি বাংলাদেশে মুক্তি পায় ২০১৫ সালে। ১৯তম বুসান চলচ্চিত্র উৎসবের এশিয়ান সিনেমা ফান্ড জিতে নেয়া এই ছবিতে অভিনয় করেন তৌকীর আহমেদ, মোশাররফ করিম, মৌসুমী হামিদ, আরাফাত রহমানসহ অনেকেই। মুক্তির পর ছবিটি দর্শকের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের বেশকিছু চলচ্চিত্র উৎসবেও পুরস্কার ও প্রশংসা অর্জন করে ছবিটি।
৬. অজ্ঞাতনামা:
তৌকীর আহমেদ পরিচালিত সবচেয়ে আলোচিত ছবির নাম ‘অজ্ঞাতনামা’। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছবিটি। তবে প্রচার প্রচারণার অভাবে প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি বেশিদিন না চললেও টেলিভিশন সম্প্রচার ও পরবর্তীতে অনলাইন প্লাটফর্মের বদৌলতে দর্শকের মধ্যে তুমুল আলোচিত হয় ছবিটি। ছবিতে অভিনয় করেন শহীদুজ্জামান সেলিম, নিপুন আক্তার, মোশাররফ করিম, শতাব্দী ওয়াদুদ, ফজলুর রহমান বাবু ও আবুল হায়াতের মতো শক্তিমান অভিনেতারা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জনসহ ‘অজ্ঞাতনামা’ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও প্রশংসা কুড়ায়।
৭. স্বপ্নজাল:
বক্স অফিসে খুব একটা সাফল্য না পেলেও তুমুল আলোচনায় ছিলো ‘মনপুরা’ খ্যাত নির্মাতা গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘স্বপ্নজাল’। দুই ভিন্ন ধর্মের দুই তরুণ-তরুণীর প্রেম নিয়ে ছবিটির প্রেক্ষাপট থাকলেও হিন্দু-মুসলমানের সুক্ষ্ম রাজনীতির কথাও উঠে আসে ছবির গল্পে। এই ছবির মধ্য দিয়ে নতুন রূপে আবির্ভূত হন ঢাকাই ছবির তারকা চিত্রনায়িকা পরীমনি। ছবিতে তার বিপরীতে অভিনয় করেন ইয়াশ রোহান। এটিই তার প্রথম ছবি।
৮. কমলা রকেট:
২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া অন্যতম একটি ছবি ‘কমলা রকেট’। এই ছবির রিভিউ লিখতে গিয়ে চলচ্চিত্র সমালোচকরা ‘কমলা রকেট’-কে বাংলাদেশের ‘বাস্তবানুগ এবং স্মার্ট’ ছবি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ছবির নির্মাতা নূর ইমরান মিঠু। এরআগে নাটক, চলচ্চিত্রে অভিনয় কিংবা নাটক পরিচালনা করতে দেখা গেলেও এটিই তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা। কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের ‘মৌলিক’ ও ‘সাইপ্রাস’ নামের দুটি গল্প অবলম্বনে ‘কমলা রকেট’-এর চিত্রনাট্য করেছেন শাহাদুজ্জামান ও মিঠু। ছবির গল্পে‘কমলা রকেট’ মূলত একটি স্টিমারের নাম। এই স্টিমারটিই পুরো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। ছবিতে অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ, মোশাররফ করিম, জয়রাজ প্রমুখ। ছবিটি বিশ্বের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। অর্জন করেছে একাধিক পুরস্কার ও।
৯. মাটির প্রজার দেশে:
যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, শিকাগোর দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র উৎসব, ইতালির কারাওয়ান চলচ্চিত্র উৎসব ও ইন্দোনেশিয়ার রয়্যাল বালি চলচ্চিত্র উৎসবসহ ২০টির বেশী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব অংশ নেয়া বাংলাদেশি সিনেমা ‘মাটির প্রজার দেশে’। ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটির নির্মাতা বিজন ইমতিয়াজ।
১০. লাইভ ফ্রম ঢাকা:
নতুন সময়ে নতুন নির্মাতার নতুন স্বাদের গল্প ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’। মুক্তির আগে থেকেই বেশ আলোচিত এই ছবিটি। কম বাজেটে বিশ্ব নন্দিত ছবি যে নির্মাণ সম্ভব, এই ছবিটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছবির নির্মাতা আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ। ৯৪ মিনিট ব্যাপ্তির এই ছবিতে দেখানো হয়েছে শেয়ার বাজার ধসে স্বর্বস্ব খুঁইয়ে ঢাকা থেকে পালাবার পথ খুঁজে ফেরা এক আংশিক প্রতিবন্ধী যুবকের গল্প। যে নৈতিকতা ও আত্মরক্ষার মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে। পরিচালনার পাশাপাশি গল্প ও চিত্রনাট্যও লিখেছেন আবদুল্লাহ মোহাম্মাদ সাদ। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন মোস্তফা মনোয়ার। ২০১৬ সাল থেকে বিশ্বের নামকরা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শীত ও পুরস্কৃত হয়েছে সিনেমাটি। দেখানো হয়েছে বিশ্বের প্রাচীন ও গৌরবময় চলচ্চিত্র উৎসব লোকার্নোর ৭১তম আসরেও।